Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মৃণাল সেন ফোন করলেন মান্নাদা-কে

কয়েকঘণ্টার মধ্যে মান্নাদার জন্য স্টুডিয়ো বুক করলেন মৃণাল সেন। লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীমান্নাদা টাকার খামটা দিতে মুক্তি রায়চৌধুরী অবাক হয়ে গেলেন। তার পরে মান্নাদা যে-কথা বললেন, সে-কথা আজ অবধি কোনও গীতিকারই বোধহয় শোনেননি। অসীম কৃতজ্ঞতায় মুক্তিদির চোখে জল এসে যায়। মুক্তি রায়চৌধুরী একজন স্কুলশিক্ষিকা। মান্নাদার জন্য বেশ কিছু অসাধারণ গান লিখেছেন।

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

মান্নাদা টাকার খামটা দিতে মুক্তি রায়চৌধুরী অবাক হয়ে গেলেন। তার পরে মান্নাদা যে-কথা বললেন, সে-কথা আজ অবধি কোনও গীতিকারই বোধহয় শোনেননি। অসীম কৃতজ্ঞতায় মুক্তিদির চোখে জল এসে যায়।

মুক্তি রায়চৌধুরী একজন স্কুলশিক্ষিকা। মান্নাদার জন্য বেশ কিছু অসাধারণ গান লিখেছেন। এর মধ্যে ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে’ গানটি তো সকলের একেবারে হৃদয়ের গান। মান্নাদারও খুব প্রিয়। দেশে-বিদেশে প্রায় সব অনুষ্ঠানে তাঁকে গাইতে হয়। দর্শকদের অনুরোধ আসবেই। তা ছাড়া ‘সিংগার’স চয়েস’ হিসেবেও গানটি মান্নাদার পছন্দের তালিকায় থাকত।

মুক্তিদি থাকেন বার্নপুরে। গান-বাজনার মূল কেন্দ্র কলকাতা থেকে অনেক দূরে। মান্নাদা যখনই ওই দিকে, মানে দুর্গাপুর, রানিগঞ্জ, আসানসোল, বার্নপুরে অনুষ্ঠান করতে যেতেন, তখন মুক্তিদি সমস্ত কাজ ফেলে সেখানে ছুটে যেতেন। সামনে বসে মান্নাদার গান শোনা, আর একটুখানি দেখা। এর বেশি আর কী চাই? কিন্তু এমন একটা ঘটনা যে ঘটতে পারে তা আশাই করেননি তিনি। গ্রিনরুমে মান্নাদার সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর মান্নাদা একটা খাম বাড়িয়ে দিলেন। মুক্তিদি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এটা কী দাদা!’’ মান্নাদা বললেন, ‘‘এটি আপনার পারিশ্রমিক মিসেস রায়চৌধুরী।’’ মুক্তিদি অবাক! বললেন, ‘‘পারিশ্রমিক কীসের জন্য?’’ এ বার মান্নাদা খুব সিরিয়াস—‘‘দেখুন, আপনারা যাঁরা গানটা সৃষ্টি করেন, তাঁদের অনেকেই নানা ভাবে বঞ্চিত হন। বিশেষ করে আর্থিক ভাবে। এই যে আপনার লেখা গান আমি অনেক অনুষ্ঠানেই গাই, যেমন আজও গাইলাম, আপনারা তো কিছুই পান না। তা ছাড়া আপনি থাকেনও অনেক দূরে। রিয়েলি, সাম টাইমস আই ফিল গিল্টি। এই টাকাটা আপনার প্রাপ্য। প্লিজ ‘না’ করবেন না মিসেস রায়চৌধুরী।’’ কী করে না করবেন? খামের ভিতরে মান্নাদা যেটি দিলেন, সেটি নিছক ‘টাকা’ নয়, এক খাম ‘সম্মান’।

এখন ‘আইপিআরএস’ (ইন্ডিয়ান পারফর্মিং রাইটার্স সোসাইটি) এ বিষয়ে কাজ করছে, কিন্তু নিয়মের জটে অনেকেই এই সংস্থার সদস্য হতে পারেননি। কিছু দিন আগে সুরকার অসীমা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। শুনে খুবই আগ্রহী হলেন। কত জনপ্রিয় গানের সুরকার তিনি। কিন্তু ওই যে নিয়ম! ৩০টি সিডি বা ক্যাসেট (ন্যূনতম) জমা দিতে হবে, বা অন্য প্রমাণপত্র। ‘চৌরঙ্গি’, ‘মেমসাহেব’, ‘ফুলশয্যা’, ‘তনয়া’-সহ আরও বহু ছবি এবং পুরোনো বেসিক গানের প্রমাণপত্র এখন কোথায় পাবেন অসীমাদি?

মান্নাদা যখন যেমন ভাবে সম্ভব হয়েছে, গানের মূল স্রষ্টাদের, মুক্তি রায়চৌধুরীর মতো, স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মুক্তিদির ক্ষেত্রে শুধু একবার নয়, যতবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে মান্নাদার, খামটি দিতে ভুল করেননি। মুক্তি রায়চৌধুরীর প্রসঙ্গ যখন এলো, আর একটি গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না।

মান্নাদা অন্য গীতিকারদের লেখা গান গাওয়ার সময় পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেমন ‘ভয়’ পেতেন, সে সব ঘটনা আগেও লিখেছি। ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে’ গানের রেকর্ড প্রকাশ হবার পরে, মান্নাদা একদিন হাসতে হাসতে মুক্তিদিকে বললেন, ‘‘আপনি তো জানেন না কত সিক্রেসির মধ্যে এই গানটা রেকর্ড করলাম। পুলক আগে জানতেই পারেনি। হা হা হা!’’ খুব অল্প ক্ষেত্রে হলেও, প্রবল ‘বাধা’য় ইচ্ছে থাকলেও কিছু গান মান্নাদা গাইতে পারেননি। মুক্তিদির লেখা ‘মুখ যেন ভেজা জুঁইফুল’ গানটি গাইবেন বলে মান্নাদা সুরও করে ফেলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ‘অজানা’ কারণে গানটি গাইতে পারেননি। তবে এ ধরনের ঘটনা কমই ঘটেছে। সব বাধা ‘কৌশল’য়ে অতিক্রম করে পছন্দের গানটি মান্নাদা গেয়েছেন। গীতিকার বা সুরকারদের নামটা বড় করে দেখেননি।

মান্নাদা চরম ব্যস্ততার মধ্যেও শুধু গানের জন্য নিজে অনেক কষ্ট করেও অন্যকে অ্যাকোমোডেট করতেন। মৃণাল সেন তখন ‘কোরাস’ ছবিটি তৈরি করছেন। সত্তর দশকের মাঝামাঝি। মান্নাদার কেরিয়ারের চূড়ান্ত ব্যস্ততার সময়। আক্ষরিক অর্থেই ‘এক সেকেন্ড’ সময়ও তাঁর কাছে নেই। মৃণাল সেন যে-ধরনের ছবি তৈরি করেন, তাতে গানের ব্যবহার বেশি থাকে না। কিন্তু সিচুয়েশন চাইছে বলে ‘কোরাস’ ছবির জন্য দুটি গান ভেবে রেখেছেন। ‘আহা মুশকিল আসান করো’ এবং ‘কোনও কালে এক রাজা’। গানদুটো লিখেছেন মোহিত চৌধুরী, সুর করেছেন প্রশান্ত ভট্টাচার্য। সবার ধারণা, মান্নাদা গাইলেই গানদুটির সঠিক জাস্টিস হয়। মৃণালবাবু মুম্বইয়ে ফোন করলেন। মান্নাদা বললেন, ‘‘কলকাতায় যাচ্ছি। গিয়ে কথা হবে।’’ কলকাতায় এসে মান্নাদা নিজেই ফোন করলেন এবং সত্যি কথাটাই বললেন—‘‘আমার যা শিডিউল, মনে হয় না এবার গাইতে পারব। তবু গানগুলো আপনি একটা ক্যাসেটে পাঠিয়ে দিন।’’ মৃণালবাবু একটু নিরাশ হয়ে গেলেন। খুব আশা ছিল মান্নাদা গাইবেন। পরের বার এসে গাইলে কোনও লাভ হবে না। তত দিনে এই সিচুয়েশনের শ্যুটিং হয়ে যাবে। গানগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হল। ব্যস! আর কোনও খবর নেই।

কথা, সুর পছন্দ না হলে মান্নাদা কিছুতেই গাইবেন না। সবাই ধরে নিল, মান্নাদার গান পছন্দ হয়নি। কয়েক দিন বাদে মান্নাদা ফোন করলেন মৃণালবাবুকে। বললেন, ‘‘শুনুন, গান তো আমার পছন্দ হয়েছে। কয়েক দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। কালই ফিরে যাচ্ছি মুম্বইয়ে। যদি কাল সকাল সাতটা নাগাদ রেকর্ডিঙের ব্যবস্থা করতে পারেন, তবে এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে গানগুলো গেয়ে দিয়ে যেতে পারি।’’

প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। একদিনেরও কম সময়ে স্টুডিয়ো বুকিং করা, যোগ্য মিউজিশিয়ানদের পাওয়া, স্টুডিয়োতে ওই অল্প সময়ের মধ্যে মিউজিক পার্টি তৈরি করে মান্নাদাকে দিয়ে গাওয়ানো—অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু একটা সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, শুধু মান্নাদা গাইবেন বলে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মৃণালবাবু রেকর্ডিঙের ব্যবস্থা করলেন। মান্না দে-র গান পাওয়ার জন্য সব কিছু করা যায়। মান্নাদাও ভাবতেন শুধু গানের জন্য সব কষ্ট স্বীকার করা যায়।

এই কষ্ট স্বীকারের কথা মান্নাদা মাঝে মাঝে কত হাল্কাভাবে বলতেন। একবার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় মান্নাদাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আপনি তো শচীনদার সহকারী ছিলেন। সেই সময় ...’’ কথা শেষ করেছেন কী করেননি, মান্নাদা কথাটা লুফে নিয়ে বললেন, ‘‘অ্যাসিস্ট্যাট মানে? শুধু গানবাজনা নয়, শচীনদার সব ব্যাপারেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলাম—এই ধরুন শচীনদার বাজার করা, বাজারের থলে বওয়া, শচীনদাকে কলা কিনে দেওয়া, হাসির কথা বললে শচীনদাকে তারিফ করা...আর গানবাজনার একটা ব্যাপার তো আছেই। বরঞ্চ শচীনদার একটা গল্প শুনুন। রেকর্ডিং চলছে। আমি শচীনদাকে অ্যাসিস্ট করছি। মিউজিশিয়ানরা তৈরি হচ্ছে। তখন তো বাজনা আর গান একসঙ্গে তৈরি হতো। আগে বাজনা তৈরি হয়ে গেল, তারপর সিংগার গাইবেন—এই কনসেপ্টটা তৈরি হয়নি। রেকর্ডিং টেকনোলজি তখন ওরকম ডেভেলপ করেনি। এদিকে প্রায় তিন ঘণ্টা হয়ে গেল মিউজিক তৈরিই হচ্ছে না। আমিও উসখুস করছি। তাই দেখে শচীনদা মিউজিশিয়ানদের গিয়ে বললেন, শুনো শুনো মানা কী কইত্যাসে! তোমাগো কাম তো শ্যাষ হইত্যাছে না। তাইলে গানটা আগে গাইয়া নিক। তুমরা পরে বাজনা বাজাইয়ো।

বুঝুন অবস্থা! বাস্তবে তো তা সম্ভব ছিল না।’’

এমনও অনেক বার ঘটেছে যে, মান্নাদা গাইবার পরে ইম্প্রোভাইজড হয়ে গানটি এমন দাঁড়িয়েছে যে পরিচালক ছবিতে গানের সিচুয়েশন নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকী হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকও। সলিল চৌধুরীর সুরে মান্নাদা গাইলেন ‘আনন্দ’ ছবির টাইটেল সং যোগেশের লেখা ‘জিন্দেগি...কভি তো রোলায়ে।’ গানটা এমন চমৎকার হল যে, আগের ভাবনা পাল্টে পরিচালক এই গানের জন্য একটা নতুন সিচুয়েশন তৈরি করে ফেললেন। সমুদ্রপারের সেই অপূর্ব দৃশ্য। ওই গান ও তার পিকচারাইজেশন আজও অপূর্ব লাগে। এটা সৃষ্টি হতে বাধ্য হয়েছিল মান্নাদার অসামান্য গায়কির জন্য। মান্নাদা সম্পর্কে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় একটি মূল্যবান কথা বলেছিলেন—স্বতন্ত্রতা। কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র শিষ্য, তাঁর কাছে সঙ্গীতশিক্ষা, গান নিয়ে সর্বক্ষণ ওঠা-বসা। অথচ মান্নাদা তাঁর গানে কাকার এতটুকু প্রভাব পড়তে দেননি। কাকার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন একেবারে নিজস্ব মান্না দে ঘরানা। তাই মান্নাদা যখন রাগাশ্রয়ী গান করেন, যেমন ‘আয়া কাঁহাসে ঘনশ্যাম’, শাস্ত্রীয় পণ্ডিতরা ‘সাবাস সাবাস’ করে ওঠেন। আবার সাধারণ শ্রোতারাও ফোনেটিক সাউন্ডে তন্ময় হয়ে যান। সেদিনও হতেন, আজও হন।

আসলে মান্নাদা এক সন্ন্যাসী গায়ক। কোনও প্রত্যাশা নেই। উদ্দেশ্য একটাই—খুব সুন্দর ভাবে গানটি পরিবেশন করা। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘আশীর্বাদ’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেলেন অশোককুমার, মান্নাদা পেলেন শ্রেষ্ঠ গায়কের সম্মান। পুরস্কার আনতে কেউই যেতে পারেননি। ওঁদের অনুমতি নিয়ে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় তাঁদের হয়ে পুরস্কার-স্মারক গ্রহণ করেন। দুর্ভাগ্যবশত মান্নাদাকে এই বিরল সম্মানের স্মারকটি দিতে হৃষীকেশবাবু ভুলে গিয়েছিলেন। বহু দিন বাদে আলমারিতে স্মারকটি দেখে তাঁর মনে পড়ে যায়—‘এই রে! এটি তো মান্নাদাকে দেওয়া হয়নি।’ অথচ এর মধ্যে কত বার মান্নাদার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে। মান্নাদা একবারও সেটা চাননি। কী করে চাইবেন? তাঁর তপস্যায় আছে শুধু নিজেকে উজাড় করে দেওয়া—গানে গানে আর মানুষের ভাললাগায়। অন্য কিছু নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE