Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

গুলির শব্দ আর যৌনতার গন্ধ

এখানে বাঁকে নিজেকে বাবুর শিষ্য মনে করে। লোককে খুনের খেলাতেও শামিল হয় দু’জনে। আবার সেই খেলা খেলতে গিয়েই বাবু-বাঁকে কখনও একই পক্ষে লড়াই করে। আবার কখনও তারা হয়ে যায় চরম প্রতিদ্বন্দ্বী।

ছবির একটি দৃশ্য

ছবির একটি দৃশ্য

রূম্পা দাস
শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৭ ১১:২০
Share: Save:

বাবুমশাই বন্দুকবাজ

পরিচালনা: কুষাণ নন্দী

অভিনয়: নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, দিব্যা দত্ত, বিদিতা বাগ, যতীন গোস্বামী

৫.৫/১০


উত্তরপ্রদেশের গ্রাম্য এলাকা মানেই ধূ ধূ খেত, মাটির বাড়ি, খড়ের চাল, বিস্তৃত আকাশ। আর তার মাঝেই আকাশ বিদীর্ণ করা বন্দুকের আওয়াজ। পানের পিক, যৌনতার আদিম গন্ধ আর চড়া দাগের রাজনীতি এখানে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। আর সেই অন্ধকার জীবনের বুনো গল্পকেই ‘বাবুমশাই বন্দুকবাজ’-এ বুনেছেন পরিচালক কুষাণ নন্দী।

গল্পটা দুই বিহারীর— বাবু আর বাঁকে। দু’জনেই পেশায় কনট্র্যাক্ট কিলার। আর দু’জনেই ক্ষমতাবানদের হয়ে খুন করতে সিদ্ধহস্ত। টাকা উপার্জনের চেষ্টায় খেলার ছলে বাবু আর বাঁকে খুন করতে নামলেও, একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। শেষ অবধি এই লড়াইয়ের হাসির রেখা কার মুখে— সেটাই টেনে নিয়ে যায় পুরো গল্পটাকে।

উত্তরপ্রদেশে রাজনীতি মানেই মোটা দাগের। সেখানে হাসতে হাসতে অবলীলায় খুন করা যায় উল্টো দিকের মানুষটাকে। এই গল্পে সেই রকম ক্ষমতার লড়াইতেই জড়িয়ে রয়েছেন জিজি (দিব্যা দত্ত)। জিজির হয়ে খুন করতে নেমে বাবু (নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি) প্রেমে পড়ে পেশায় মুচি ফুলওয়া-র (বিদিতা বাগ)। অন্য দিকে বাঁকের (যতীন গোস্বামী) প্রেমিকা জসমিন (শ্রদ্ধা দাস) নানা অনুষ্ঠানে বলিউডের রিমিক্সে নাচ-গান করে।

এখানে বাঁকে নিজেকে বাবুর শিষ্য মনে করে। লোককে খুনের খেলাতেও শামিল হয় দু’জনে। আবার সেই খেলা খেলতে গিয়েই বাবু-বাঁকে কখনও একই পক্ষে লড়াই করে। আবার কখনও তারা হয়ে যায় চরম প্রতিদ্বন্দ্বী।

এই গল্প আর এক বার চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়, যে ক্ষমতাবানেরা সমাজের নিচুতলার মানুষদের হাতে বন্দুক ধরিয়ে উপরে তুলে আনে, শেষ পর্যন্ত কোথাও গিয়ে তাদের হাতেই মৃত্যু হয় ক্ষমতাবানদের। গ্রামের পুলিশ অফিসারের প্রায় গণ্ডাখানেক পুত্রসন্তান থাকার পরও একটি মাত্র কন্যাসন্তানের আকাঙ্ক্ষা যেন সমাজকে সরাসরি খোঁচা দেয়।

সেন্সর বোর্ড প্রাথমিক ভাবে ৪৮টি কাটের দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত আটটি কাটের পর ছাড় দেয় ছবিটিকে। এই কাটের দুটো মূল কারণ ছিল। একটি, ছবিতে ব্যবহার হওয়া অকথ্য গালিগালাজ আর অন্যটি অবশ্যই যৌনতা। উত্তর ভারতের গ্রাম্য ভাষার প্রয়োগ ছবির প্রতিটি চরিত্র বেশ মুনশিয়ানার সঙ্গে করলেও বেশির ভাগের মুখ দিয়েই বন্দুকের মতোই গালির ছররা বেরিয়েছে। আর ছবিতে এমন কোনও পূর্ণবয়স্ক নারীকে দেখানো হয়নি, যার শরীর প্রদর্শন করানো হয়নি। একদম শুরুতে রাজনীতিকের বউয়ের শরীরে তেলমর্দন, মুচি ফুলওয়ার সঙ্গে বাবু আর বাঁকের যৌনতা ও শরীরী প্রেম, কথায় কথায় জিজির বুকের আঁচল ফেলে হাওয়া করা কিংবা ফুলওয়া-জসমিনের শরীর দেখানো নাচ— সর্বত্রই শরীরী গন্ধ। কিন্তু কোথাও কোথাও সেই গন্ধেও তো বমি পায়! যখন ফুলওয়া শুরুতেই বাবুর পাঁচ টাকার জুতো সারিয়ে পঁচিশ টাকা আদায় করে শুধু তার ক্লিভেজ দেখানোর মূল্য হিসেবে, তখনই বোঝা যায় ছবির সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক কতটা। এ যেন রীতিমতো টিকিট কেটে হলে ঢুকে মেকি যৌনতা প্রদর্শনের ছলাকলার সাক্ষী হওয়া।

‘বদলাপুর’-এর ঠান্ডা মাথার খুনি লায়েক কিংবা ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’-এর ফয়জল খানকে মনে পড়ে? হাতে বন্দুক, হিমশীতল চোখের ক্রিমিনালের চরিত্রে এর আগেও পা গলিয়েছেন নওয়াজ। কিন্তু বিশেষ করে ‘বাবু’ চরিত্রটির কাছ থেকে আলাদা কোনও প্রত্যাশা না রাখাই ভাল। নওয়াজ বরাবর নিজের অভিনয়ে দাগ রেখে যান। ‘বাবুমশাই...’-এ গালি আর গুলিবর্ষণ, প্রিয়জন হারানোর কান্না, নেশাগ্রস্ত লাল চোখ, সম্পর্কের বিশ্বাসঘাতকতা— সব ক্ষেত্রেই নওয়াজের অভিব্যক্তি যথাযথ।
তবে এটা যে নওয়াজের সেরা অভিনয় নয়, তা কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায়।

বিদিতা বলিউডের প্রতিষ্ঠিত মুখ নন। তবে সত্যি কথা বলতে, ক্লিভেজ আর নির্মেদ কোমর দেখানো ছাড়া ছবিতে বিদিতার এই ছবিতে বিশেষ কিছু করার ছিল না। জিজির চরিত্রে দিব্যার অভিনয় ঠিকঠাক। তবে সুন্দর চেহারার বাঁকেরূপী যতীনের অভিনয়ে সূক্ষ্মতার অভাব বড্ড চোখে পড়ে।

এই ছবিতে বিশাল বিত্তলের ক্যামেরার কাজ ভাল। দিব্যার মৃত্যুর আগের মুহূর্তে ক্যামেরা প্যান করে দেখানো মাটিতে পোকামাকড়-বিছের ধীরগতিতে এগিয়ে চলার দৃশ্য নজর কাড়ে। তবে এই ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এবং মিউজিক ব্যর্থতম অংশ। প্রায় ১২২ মিনিটের ছবির দ্বিতীয়ার্ধ বেশ দীর্ঘ লাগে।

অনুরাগ কাশ্যপ, শ্রীরাম রাঘবন এ ধরনের ডার্ক থ্রিলার আগেই বানিয়ে ফেলেছেন। সে ক্ষেত্রে একই জঁরে বানানো কুষাণের ছবি আলাদা করে নজর কাড়ে না।

‘বাবুমশাই বন্দুকবাজ’-এর গল্পের ঘরানা এক। পটভূমিকাও এক। এমনকী চরিত্রগুলোও দর্শকদের চেনাজানা। তা হলে আলাদাটা আর কী? অবশ্যই ক্যামেরার কাজ। আর প্রীতীশ-পুত্র কুষাণের প্রচেষ্টা। গোটা ছবি জুড়ে নুড়ি ফেলেছেন পরিচালক। এবং শেষ পর্যন্ত সেই সমস্ত বৃত্তকে সম্পূর্ণ করেছেন তিনি।

তবে ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’-এর প্রত্যাশা নিয়ে ‘বাবুমশাই বন্দুকবাজ’ দেখতে গেলে কিন্তু নিরাশ হবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE