Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পোষ–না-মানা অলক্ষ্মী

‘মেয়ে’ হয়ে থাকাটা জাস্ট পোষাচ্ছে না। লক্ষ্মী পুজোর আগের দিন ‘পিঙ্ক’ জেনারেশন-এর ‘লক্ষ্মী’-দের মনের কথা শুনে ফেললেন শ্রীজাত ‘মেয়ে’ হয়ে থাকাটা জাস্ট পোষাচ্ছে না। লক্ষ্মী পুজোর আগের দিন ‘পিঙ্ক’ জেনারেশন-এর ‘লক্ষ্মী’-দের মনের কথা শুনে ফেললেন শ্রীজাত

‘পিঙ্ক’-য়ের ওরা তিনজন

‘পিঙ্ক’-য়ের ওরা তিনজন

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

অলক্ষ্যে তো থেকেছি অনেক দিন। এ বার না হয় একটু অলক্ষ্মী থাকব? কেমন? লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকতে থাকতে হাঁপ ধরে গেছে যে! পুরুষদের বুনে দেওয়া অদৃশ্য বোরখা সরিয়ে নিজেদের অলক্ষ্মীশ্রী দেখাব এ বার। পছন্দমতো হয়ে উঠেছি কত কত বছর ধরে। ছন্দমতে কাব্য হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। সে সবই তো আপনাদের খাতিরে। এ বার না হয় একটু নিজেদের খাতির করলাম। কারও বেয়াড়া পছন্দের, একতরফা নিয়মের, গাজোয়ারি শাসনের তোয়াক্কাটি না করে এবার থেকে এক্কেবারে নিজেদের মর্জিমতো লাইফ। কারণ, অলক্ষ্মী ইজ ইন।

তাই বলে ভাববেন না সামাজিকতা, সৌজন্য বা আবেগের পুকুর বুজিয়ে হাইরাইজ তুলব। কক্ষনও নয়। ওগুলো বরং আমরা আপনাদের চেয়ে ভাল পারি চিরকাল, আগামী দিনেও তাই পারব। কিন্তু তার বাইরে সারাক্ষণ, যাকে বলে আপনাদের ভাষায় ‘মেয়ে’ হয়ে থাকাটা জাস্ট পোষাচ্ছে না আর। বেশি রাতের জিন্স পরিহিতা দেখলে যারা নিদান দিতে আসবেন, হ্যাঁ, তাঁদের মুখে অবিশ্যি শিওর ঝামা। কারণ শ্রদ্ধা বজায় রেখে বলছি আমি সুজাতা বা বন্দিনি নই আর, বরং ‘কুইন’-এর কঙ্গনা বা ‘পিঙ্ক’-এর দামাল মেয়েদের একজন।

আমি স্কুলে পড়াই। আমি কেন সালওয়ার কামিজ পরে ক্লাস নিতে পারব না? আমি শাড়ি ম্যানেজ করে উঠতে পারি না, অসুবিধে হয়। বা ধরা যাক, আমার পোষায় না। তা হলে কেন বিকল্প পোশাকের ব্যবস্থা থাকবে না? খুব হাতে গোনা কয়েকটা স্কুল ছাড়া আমাকে কেন আঁচলের আড়ালেই থাকতে হবে? আমার পুরুষ কলিগরা তো শার্ট ট্রাউজার পরেই আসেন, দু’একজনকে পাঞ্জাবি বা ফতুয়া পরতে দেখি। ইনফর্ম্যাল নয় হলাম না, কিন্তু চাইলে ফর্ম্যাল ট্রাউজার শার্ট পরে যেতে পারি আমিও। যাঁরা মনে করেন তাতে ব্যাপারটা উত্তেজক হয়ে দাঁড়াবে, তাঁরা প্রথমত শাড়ির তুঙ্গ আগুনের হদিশ রাখেন না এবং দ্বিতীয়ত কোনও মেয়ে বস্তার ভেতর থাকলেও তাঁদের উত্তেজনা জাগবে। এ বার একদিন স্কুলে নতুন পোশাক ট্রাই করব। অলক্ষ্মী হয়ে দেখাই যাক না।

বেশ ভাল চাকরি করি ক’বছর। অনেক দিনের ইচ্ছে একটা ক্লাব মেম্বারশিপ নেব। বেশির ভাগই ফিরিয়ে দিচ্ছে। বলছে বর বা বাবার নামে রেজিস্ট্রেশন হয়। তার মানে ব্যাপারটা কেবল আর্থিক ক্ষমতা, কেবল পারিবারিক পরিচিতি নয়? এ সব কিছু থাকার আগে আমাকে একজন পুরুষ হয়ে জন্মাতে হবে ক্লাব মেম্বারশিপ নিতে গেলে? শুনেছি আগে নাকি মেয়েদের ঢোকাও নিষেধ ছিল ক্লাবে। তার মানে তার চেয়ে খুব বেশি দূর এগোয়নি সভ্যতা? অমন ক্লাবে আমি বরের সঙ্গেও যাব না তা হলে। যাঁরা আমাদের নামেই মেম্বারশিপ চালু করেছেন, তাঁরা যুগ যুগ জিও। পুরুষদের নাম ধার করে চিকেন পকোড়া আর হুইস্কি খেতে বয়েই গেছে!

আমি লেখালেখি করি। আর কেবল আমার লেখাকে নারীবাদী বলে দেগে দেওয়া হয়। কই, পুরুষরা যখন নিজেদের গান গেয়ে বেড়ান, কেউ ভুলেও পুরুষবাদের কথা তোলেন না তো? যে লিখবে, সে তো স্বাভাবিক ভাবেই তার নিজের কথা বলবে, না কি? পাঠকদের মাইন্ডসেটও দেখছি একবগ্গা। আর মেয়েরাও কিছু কম তুলসীপাতা নন। লেখায় ‘স্ল্যাং’ থাকলে তাঁরাই সবার আগে জিভ কেটে বলেন, ‘‘আপনি এই শব্দগুলো না লিখলেই পারতেন। আফটার অল...’’ ওই আফটার অলই হয়েছে কাল।

পৃথিবী পুরুষের, অতএব স্ল্যাং ব্যবহারের অধিকারও পুরুষের। কিন্তু আমার তো পুরুষদের মতোই খিদে পায়, পটি পায়, চুমু পায় এবং হ্যাঁ, খিস্তিও পায়। লেখার প্রয়োজনেই পায়, লেখার বাইরেও, জীবনে, পায়। আর সেটাকে আটকে রাখার মোড়লিকে আমি অলক্ষ্মীর বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিলাম এই। রাগ চেপে রাখলে শরীর খারাপ হয়, জানেন তো?

আমি সমকামী। লেসবিয়ান। কলেজের এক বান্ধবীকে মন থেকে ভালবাসি, শরীর থেকেও। বিয়ে করে ওর সঙ্গেই থাকতে চাই। কিন্তু লুকিয়ে বিয়ে নয়। বাড়ি থেকে রাজি হোক বা না হোক, আসছে বছর আমাদের বিয়ে হচ্ছেই। ভাল বাড়ি ভাড়া নিয়ে, দারুণ হইচই সহকারে। মেনুতে ভাবছি কন্টিনেন্টাল রাখব। আর হানিমুনে গোয়া। নেমন্তন্ন করলে আসবেন তো? আমাদের সমাজ-বহির্ভূত করার ষড়যন্ত্রে এই বিয়ের বিরোধিতা করাটা যেমন অন্যায়, তেমনই ‘আহা কী মহৎ কাজ করলাম’ ভেবে গোপনে বুক ফুলিয়ে খেতে আসাটাও কাম্য নয়। দু’জন মানুষ ভালবেসে বিয়ে করছে, স্বাভাবিক ব্যাপার। ভাল বই দিলে নিতে আপত্তি নেই, অলক্ষ্মীদের এই জুটিকে মন থেকে না হয় শুভেচ্ছা জানিয়ে যাবেন একবার।

আমি কারখানায় কাজ করি, আমি কাঠ কাটি, আমি ডাক্তার, আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, আমি ধান চাষ করি, আমি গান গাই, আমি সিনেমা তৈরি করি, আমি পার্টি মেম্বার, আমি সাংবাদিক, আমি ট্রেকিং করি, আমি ভিখারিনি। আমি এই গ্রহের সমান অংশীদার।

আমার জন্যেও বয়ে চলেছে একই রোদ, জল, হাওয়া। আমি যেন ঘাসে পিঠ রেখে জ্যোৎস্না দেখতে পারি সারা রাত, একা একা। আমি যেন অভব্যতা করা মাঝবয়সি সহযাত্রীকে ঠাঁটিয়ে চড় মারতে পারি।

আমি যেন অনেক টাকা রোজগার করা বরকে বলতে পারি, ‘‘আজ ইচ্ছে করছে না।’’ আমি যেন রাত দেড়টা নাগাদ পার্ক স্ট্রিটে একা হাঁটতে পারি, যদি ইচ্ছে হয়। ধর্ষণ থেকে ভূমিকম্প, সব কিছুর দায় যেখানে মেয়েদের জিন্সকেই নিতে হয়, যেখানে ‘অনার’ শব্দটা এখনও ‘কিলিং’-এর আগে বসে যায়, সেখানে আমাদের সংগ্রাম রোজকার।

অলিম্পিক্সে মেডেল না-পেলেও আমরা বিজয়ী। কারণ আমরা এ বার থেকে পোষ–না-মানা অলক্ষ্মী। যাদের মুখে আর কোনও ভয়ের বোরখা নেই। আর হ্যাঁ, আমরা কিন্তু মাসের ওই পাঁচদিনও ধর্মীয় স্থানে টগবগিয়ে ঢুকব, আটকাতে হলে আটকে নেবেন। মনে রাখবেন, ওই রক্তজবাটি ফুটে না উঠলে আপনারও এ পৃথিবী দেখা হত না। কেমন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gen Y Girls Srijato
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE