যদি বলা হয় টালিগঞ্জের সিনেমা পাড়ার চুমকির আসল নাম জানেন আপনি, যিনি ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতেও কাজ করেছেন? হট সিটে বসেও কী বলবেন জানি, দেবশ্রী রায়। কিন্তু ক্লু-তে যদি থাকে, নায়িকা এখনও চুটিয়ে কাজ করছেন, এমনকী প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ছবিতেও! কী? ঘেঁটে যাবেন তো! পরের প্রশ্ন, বলুন তো, টলিপাড়ার কোন নায়িকাকে মামাবাড়িতে ‘টুনুমোনা’ আর ‘বুড়ি’ বলে ডাকে? দ্বিতীয় ‘ক্লু’, বাড়ি তার বাংলা। তবে পশ্চিমে নয়, পুবে। ফরিদপুর!
উত্তর দিতে যাওয়া আপনার মুখটা আন্দাজ করা যাচ্ছে। চোখ ছানাবড়া। সুনীল নারিন ওপেন করতে নামলেও আপনি এত্তোটা ‘হাঁ’ করে তাকিয়ে থাকতেন না, যতটা না প্রশ্ন শুনে।
তবে শুনুন, প্রথম উত্তরটা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। দ্বিতীয়টা পাওলি। আজ্ঞে হ্যাঁ। এ বার ‘হাঁ-মুখ’টা বন্ধ রেখে গল্পে ঢুকি নামাবলির!
ছেলে ছোট্টবেলা থেকেই আওয়াজপ্রেমী। অনেক বাচ্চাই যেমন হয়! ঢিক-ঢাক-ঢিশুম-ঢিশুম। এ ছেলে বলত ‘বুম’ ‘বুম’। তার বলার শেষে তার বাপি বলত, ‘বা’। সেই থেকেই ছেলের নাম হয়ে গেল বুম্বা। এর পর অবশ্য নায়ক বা তাঁর বাবারও নাম বলতে লাগে না। কিন্তু প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় নতুন তথ্য জোগালেন, ‘মা ডাকত, বুম। দাদা-পিসিদের কাছে আমি ‘বুড়ুন’।’’
ছোটবেলায় খুব ‘গাবলুস’ টাইপের মোটা ছিলেন বলে, তাঁকে তাঁর বাবা ডাকতেন, ‘‘বেণীপ্রসাদ আগরওয়াল।’’ গোটা ইন্ডাস্ট্রি আজ যাঁকে চেনে সব্যসাচী চক্রবর্তী নামে। ওঁর বাবা মানুষটা সত্যিই অদ্ভুত। সে আমলের ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি ছেড়ে হয়েছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টির কমরেড। সে সব ছেড়ে আবার চাকরি। বিয়ে করেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যর ছোট বোন মণিকাকে। ভদ্রলোকের মা ছিলেন আবার অ্যানি বেসান্তের ছাত্রী। তিনি তাঁর শিশুপুত্রকে যে অমন ভারিক্কি নাম দিয়েছিলেন, তার কারণটাও ভারী অদ্ভুতুড়ে। ছেলের চেহারা দেখে ওঁর মনে হত, এই যার গড়ন, তার নির্ঘাৎ এত্তো এত্তো খেয়েপরে বড় হওয়া মানুষজনের মতোই গম্ভীর-গম্ভীর নাম হওয়া উচিত। অন্তত গৃহপালিত নাম! মা বরং বলতেন, ‘‘সে আগরওয়াল কেন, চৌবেও তো হতে পারে।’’ বাবা বলতেন, ‘‘তাও পারে।’’ কিন্তু ওই ‘বেণী’টা দু’জনেই মানতেন। সেই থেকে ডাকনাম ‘বেণু’। তখন তিনি নিশ্চই আন্দাজও করেননি, ছেলেকে একদিন এ নামেও চিনবে সিনেমাপাড়া। যে নাম বললেই ভেসে ওঠে এক মহাতারকার মুখও, তিনি সুপ্রিয়া চোধুরী! তাঁর আবার ইন্ডাস্ট্রিতে এসেই নাম হয় ‘সুপ্রিয়া’। শোনা যায়, নামটি পাহাড়ী সান্যালের দেওয়া।
দিল্লিতে থাকার সময় সব্যসাচীকে কেউ আবার হিংরেজি টানে ‘স্যাবি’ ডেকেছে। কেউ হিন্দি টানে ‘সওব্য’। দুষ্টুমি করে অনেকে আবার ‘সভ্য চাষী’। ‘‘তাতে বলতাম, না, আমি হলাম অসভ্য চাষী,’’ বলছিলেন পরদায় ফেলুদা নম্বর-টু।
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের ‘অপু’ নামটা এখনও ‘বব বিশ্বাস’-এর জমানত জব্দ করতে পারেনি। নামটি দেওয়া জেঠতুতো দাদার। ওঁর চেয়ে বছর দশেকের বড়। পেশায় চোখের ডাক্তার। ‘পথের পাঁচালী’ দেখে তিনি এতই বিগলিত হয়ে পড়েন, আদরের ভাইয়ের নাম দিয়ে ফেলেন ‘অপু’। সেই থেকে সবাই। তবে বাবা ডাকতেন ‘অপা’। ছোটবেলায় ভালনাম ঠিক হয়েছিল ‘সুগত’। বাবা পাল্টে করে দিয়েছিলেন শাশ্বত। তবে এই শাশ্বত নাম নাকি তাঁকে প্রায়ই বিব্রত করে। বিশেষ করে অন্যভাষীরা চিঠি পাঠালে প্রায়ই নামের আগে ‘মিস’ নয় ‘মিসেস’ লিখে বসেন।
বাংলা সিনেমা মহলে ‘বাবু’ নামে এক ডাকে লোকে চেনে সন্দীপ রায়কে। কিন্তু তাঁর ছোটবেলায় যে অনেকে তাঁকে ‘খোকন’ নামে ডাকত, কে জানত! তবে ‘বাবু’ নাম যে কার দেওয়া, বলতে গিয়ে ভেবে কুল পেলেন না তিনি। এমনকী বাবার ‘মানিক’ নামটি যে কার দেওয়া, তাও জানেন না তিনি। তেমনই প্রদোষ মিত্র কী করে ‘ফেলুদা’ হল, ‘‘বাবা, সিক্রেসিটা ফাঁস করেননি। আমরাও জানতে চাইনি।’’
ভাল নাম যার রুক্মিনী, ডাক নাম তাঁর কী জানেন? কোয়েল! কোয়েল মল্লিক। রুক্মিনী যে আড়ালেই রয়ে গেল, তার কারণ বাবা-মা। বাড়িতে আসা ইন্ডাস্ট্রির লোকজনের সামনে ওঁরা যে কন্যেকে এই নামেই ডাকতেন! এমনই কোনও এক কারণে এক কালে সাম্যময় নাম খসে এক প্রবাদপ্রতিমের নাম হয়ে যায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন:বলি সেলেবদের আজব খেয়াল
নিজে খুব ট্রেক করতেন। তাই ছেলের নাম রেখেছিলেন পাহাড়-চুড়োর নামে, মৈনাক। তার আগে মেয়ের নামও তাই। ‘পাওলি’। সেই থেকে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির কাছে বড় হয়ে ওঠা পাওলির ডাকনাম ‘পাও’! মেয়ে যখন লরেটো কনভেন্টে, তাঁর ইংলিশ-স্পিকিং দিদিমণিরা বলে বসত, ‘পলি’। শুধরে দিত মেয়ে। তার বন্ধুরাও।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর একশো আট নাম না হলেও ডাকনাম অ-নে-ক! ফুটফুটে ফুলের মতো মেয়ে, তাই ঠাকুমা একবার নাম দিলেন ‘ফুলঝুরি’। এককালে মা নন্দিতা ডাকতেন ‘গোলডি’ বলে। মায়ের কাছে মেয়ে তো শুধু মেয়ে নয়, ‘সোনা মেয়ে’, তাই। এক মাসি নাম দিয়েছিলেন চন্দ্রমল্লিকা! আর চুমকি? ও নাম ঠাকুমার দেওয়া। ‘‘ঠাকুমা অসম্ভব এনলাইটেন্ড ছিলেন! আঁকতেন, সেলাই জানতেন। পড়াশোনাতেও তেমনই ভাল। নিজে হাতে বাড়িতে রেডিয়ো বানিয়েছিলেন। ঠাকুমার মা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। মাতঙ্গিনী হাজরার সঙ্গে মিছিলেও হেঁটেছেন’’, বলছিলেন ইন্ডাস্ট্রির ঋতু। সেলাই-ফোঁড়াই করতে বসে প্রায়ই চুমকি বসাতেন কাপড়ে। তার চকমকি আলোয় নাতনির আদল পেতেন তিনি, তাই নাম দিয়েছিলেন চুমকি! বসন্ত রায় রোডের পুরনো পাড়ায় সব বাড়ির বারান্দা, অলিগলি, এমনকী পুজো প্যান্ডেলের কাছেও তিনি মায়ের ‘ঋতুপর্ণা’ নন, বরং ঠাকুমার ‘চুমকি’!
পদ্মাপারের ‘রমা’ যে ভাবে হয়ে গিয়েছিলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy