অনুষ্ঠান-আয়োজকদের ভাগ্যটা নিতান্তই খারাপ। না বুঝেই এমন একটা কথা বলে ফেলল যে মান্নাদার মুড অফ। আর মান্নাদার মেজাজটাই অন্য রকম। ভাল থাকলে ভাল, বিগড়ে গেলে মুশকিল। কথাবার্তা ভালই এগোচ্ছিল। হঠাৎ একজন আয়োজক অতি উৎসাহে বলে ফেলল, ‘‘আমরা অনেক দিন ধরে আপনাকে নিয়ে অনুষ্ঠান করব ভাবছিলাম। আপনি এত ভাল গান-টান করেন....’’ থামিয়ে দিলেন মান্নাদা। ‘‘কী বললেন? গান-টান করি? আমি তো মশায় শুধু গানই করি। এই ‘টান’টা কী? ওটা তো আমি করি না। হ্যাঁ, আপনাদের অনুষ্ঠান তো অগস্টে। না, ও সময়ে আমি থাকব না। আপনারা অন্য কাউকে দেখুন।’’
আর এক বারের ঘটনা। মান্নাদার পরিচিত এক অনুষ্ঠান-আয়োজক এসেছেন। বোঝা যাচ্ছে দু’জনের বেশ ভাল সম্পর্ক। মান্নাদা ‘তুমি’ করে বলেন। সম্ভবত ম্যাসকটে অনুষ্ঠান। প্রতি বছর ওখানে বড় করে অনুষ্ঠান হয়। এবারে মান্নাদা। ভদ্রলোক এসেছেন মান্নাদাকে রাজি করাতে। সব কিছু শুনে মান্নাদা বললেন, ‘‘চলো, ঘুইরা আসি।’’
মান্নাদার মুখের কথাই কাফি। কোনও দিনই অনুষ্ঠানের জন্য অগ্রিম নিতেন না। কোনও জায়গায় খটকা আছে মনে করলে বহু টাকার অনুষ্ঠানও ছেড়ে দিয়েছেন সেখানে। কেউ কি এখন বিশ্বাস করবে যে, একবার এক অনুষ্ঠানের জন্য মান্নাদাকে অনেক টাকার অফার দেওয়া হল, যা তাঁর প্রাপ্য রেমুনারেশনের থেকে অনেক বেশি। শুধুমাত্র এই কারণে মান্নাদা অনুষ্ঠানটা ছেড়ে দিলেন। বললেন, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’। ওই দিনই অন্য একটি অনুষ্ঠান করলেন অর্ধেক পারিশ্রমিকে।
যাই হোক, আগের কথায় ফিরি। ম্যাসকটের অনুষ্ঠানে মান্নাদা যেতে রাজি হয়েছেন দেখে ভদ্রলোক তো খুবই উচ্ছ্বসিত। চা খেতে যাওয়ার সময় খুব গর্বের সঙ্গে বলতে লাগলেন, ‘‘জানেন মান্নাদা, গতবার নিয়ে গিয়েছিলাম হিমেশকে। ওর গান শুনে লোকে তো পাগল হয়ে গিয়েছিল। একদম ফাটিয়ে দিয়ে এসেছে।’’
মান্নাদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কার কথা বলছেন?’’
‘‘হিমেশ... হিমেশ রেশমিয়ার কথা বলছি।’’
এবার মান্নাদা গম্ভীর হয়ে গেলেন। ‘‘শোনো, একটা কথা বলি। ওখানে আমাকে নিয়ে গিয়ে তোমাদের কোনও লাভ হবে না। যে-গান ওনারা শুনতে চান, আমি ঠিক সে ধরনের গান করি না।’’
ব্যস! হয়ে গেল! ভদ্রলোক করুণ মুখে শুধু বললেন, ‘‘না, মানে... মান্নাদা...’’।
মান্নাদাকে ভদ্রলোক চেনেন, জানেন শতকথায়ও আর কাজ হবে না। ভুল করে ‘নো বল’ হয়ে গেছে। ‘বোল্ড’ করেও লাভ হল না।
আসলে মান্নাদার একটা নিজস্ব সিস্টেম ছিল। যেটি শৃঙ্খলা, বিশ্বাস, সততা, সদিচ্ছা দিয়ে তৈরি। এই সিস্টেমের বাইরের মানুষজনদের তিনি বিশেষ পছন্দ করতেন না। বহু আয়োজক মান্নাদার অত্যন্ত স্নেহধন্য ছিলেন। এমনও বলতেন, ‘‘দে আর মাই পার্ট অব প্রফেশন। ওরা কিন্তু আমাদের রুজিরোজগারের ব্যবস্থা করে।’’ অনুষ্ঠানের বাইরেও মান্নাদা তাদের অধিকাংশ অনুরোধ রাখার চেষ্টা করতেন। তাঁর বাড়ির সেই বিখ্যাত ‘সংরক্ষিত’ আড্ডায় বেশ কয়েকজন প্রিয় অনুষ্ঠান-আয়োজকের অবারিত দ্বার ছিল। আবার এর উল্টো ঘটনাও আছে। সেটা এখানে বলছি। মান্নাদা জানতেন আমি বারাসতে থাকি। একদিন বারাসতেরই একজন আয়োজকের কথা জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, অল্প অল্প চিনি। মান্নাদা বললেন, ‘‘যেটুকু চিনেছেন, চিনেছেন। আর বেশি চিনতে হবে না। খুব অসভ্য লোক।’’ চুপ করে রইলাম। মান্নাদা বললেন, ‘‘আরে মশায়, বাড়িতে বউ থাকতে আবার কার সঙ্গে একস্ট্রাম্যারিটাল রিলেশন করছে। আপনাদের বারাসতে কী হচ্ছে বলুন তো? রাধুবাবু (তবলিয়া রাধাকান্ত নন্দী) নাকি ওখানকার একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। দেখুন তো কী কাণ্ড! আমার এসব ভাল লাগে না।’’
মান্নাদার এক মুড অফের দিন জ্যোতি (জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়) এসেছে মান্নাদার বাড়িতে। তবলিয়া অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের ছোট ভাই জ্যোতি। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে গান শিখেছে বহু দিন। লেখার হাতটাও বেশ ভাল। মান্নাদা প্রথমেই বললেন, ‘‘দ্যাখো জ্যোতি, আমার মনটা বিশেষ ভাল নেই। অনেকে আমাকে বুঝতে পারে না। বহু মানুষ ভুলও বোঝে। তুমি তো লেখো। সুরও করো। এই নিয়ে লেখো তো একটা গান।’’
জ্যোতি একটু ইতস্তত করে বলল, ‘‘আপনাকে সবাই ভগবানের মতো শ্রদ্ধা করে। মানুষ আপনাকে ভুল বুঝছে—এই নিয়ে লিখলে কেউ নিতে পারবে না। যদি এই ভুল বোঝার সঙ্গে একটু অভিমান মিশিয়ে দিই? যাকে ভালবাসা যায়, সে যদি ভুল বোঝে?’’
মান্নাদা বললেন, ‘‘আগে লেখো। দেখি কেমন দাঁড়ায়।’’
মান্নাদার গানের ঘরে বসে লেখা হল সেই গান—‘তুমি তো আমাকে বুঝলে না/না-বোঝার ভিড়ে/হারানো আমিকে/খুঁজলে না তুমি বুঝলে না...।’ মান্নাদা কথা দেখে খুশি। সত্যিই তো, শুধু ‘বোঝা’র ভুলে জীবনের কত বোঝাবুঝি ‘বোঝা’র মতো চেপে বসে। মান্নাদার কিছু মন্দলাগার মুহূর্ত জন্ম দিল একটা সুন্দর গানের। তিনটি রাগ মান্নাদার অত্যন্ত প্রিয়—ভৈরবী, ইমন ও কল্যাণ। গানের যে বাণী, সেই মুডে গানটা বাঁধা হল ভূপ-কল্যাণে।
একটা বিশেষ প্রসঙ্গ এখানে বলি। গানটা পড়ে মান্নাদা বললেন, ‘‘একটা সঞ্চারী লাগে যে!’’ জ্যোতি বলল, ‘‘যা ভেবেছি, সবই তো লিখে ফেলেছি। নতুন কোনও কথা মাথায় আসছে না।’’ মান্নাদা একটু ভাবলেন। গানটা আর একবার পড়লেন। তারপর বললেন, ‘‘তুমি তো না-বোঝার কথা লিখেছ। বোঝা না-বোঝার আগে চেনাটা তো দরকার। না চিনলে বুঝবে কী করে?’’ ব্যস! মান্নাদার এই টিপসেই সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চারী লেখা হয়ে গেল। অনেকেই বলেন, যে-গানটি মান্নাদা গেয়েছেন, সর্বঅর্থে তা মান্নাদার গান। সুর, মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট তিনি নিজের মতো করে নিয়েছেন। হয়তো টেকনিক্যালি গানটি তিনি লিখতে পারতেন না, কিন্তু এমন এমন টিপস দিতেন, গীতিকার কথার ঘুড়িটা ধরার জন্য ভাবনার লাটাই পেয়ে যেতেন।
কিছু দিন বাদে জ্যোতিকে আবার গান লেখার ক্যাচলাইন দিলেন মান্নাদা। বললেন, একটু নতুন ভাবে কিছু লেখো তো। অনুভূতি তো আর বদলানো যাবে না। নতুনত্ব আনতে হবে প্রেজেন্টেশনের ওপর। ওই যাকে বলে ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বটল। জ্যোতি লিখল, ‘একই মাটির এক বাগানের/চেনা সেই গন্ধ/ শুধু ফুলটা নতুন/ একই সুরের এক মেজাজের/চেনা সেই ছন্দ/ শুধু ভাবটা নতুন।’
এবার সুরেও তো বৈচিত্র চাই। বাংলায় কাওয়ালি বেশি হয়নি। মান্নাদাই একবার গেয়েছিলেন, ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’ কাওয়ালিটি। কাওয়ালির সুরেই বাঁধা হল ‘একই মাটির...’। অসাধারণ একটি গান। ওয়াই এস মুলকির মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে মান্নাদা গাইলেন মুম্বইয়ের স্টু়ডিয়োতে।
১৯৯৩ সালে মান্নাদার একটা অসাধারণ গানের ক্যাসেট প্রকাশিত হয়। নাম : ‘সব তোমারই জন্য’। জ্যোতির লেখা দুটি গান ছাড়াও আরও কিছু অসাধারণ গান ছিল। মুক্তি রায়চৌধুরীর লেখা ‘সব তোমারই জন্য’। আনন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘এই তানপুরাটা বন্ধু আমার’, ‘বন্ধু জানি না তুমি কেমন আছ’। ৭৩ বছর বয়সে গাওয়া অধিকাংশ গানই প্রেমের। ৭৩ কেন, ৯৩ বছর বয়সেও মান্নাদা নতুন প্রেমের গান গাইবার কথা ভেবেছিলেন। নেহাত ভাগ্য বিরূপ। সেই আশা পূর্ণ হবার আগেই তিনি চলে গেলেন। এত বয়স পর্যন্ত যে একই ভাবে গান গেয়ে গেছেন, তার অন্যতম কারণ মান্নাদার সিস্টেমেটিক জীবনযাত্রা।
একটি ঘটনার কথা বলি। সাল ২০০৬। বহু দিন বাদে মান্নাদা পুজোর গান গাইছেন এইচএমভি থেকে। মান্নাদা সময় দিয়েছেন বিকেল ছ’টা। দু’দিন পরে রেকর্ডিং। সেদিন ফাইনাল রিহার্সাল গীতিকার ও মিউজিক অ্যারেঞ্জারের সঙ্গে। আমি তো পনেরো মিনিট আগে পৌঁছে গেছি। বেল বাজিয়েছি ঠিক ছ’টায়। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে মান্নাদাও একতলায় গানের ঘরে নামলেন। রিহার্সাল শুরু হল। সেদিন এইচএমভি-র এক কর্মকর্তার আসার কথা ছিল। তিনি এই প্রজেক্টটা সুপারভাইজ করছেন। শিক্ষিত মানুষ। মান্নাদারও খুব পছন্দের। তিনি আসতে মিনিট দশেক দেরি করে ফেলেছেন। গানের ঘরের দরজা ভেজানো হয়ে গেছে। রিহার্সাল শেষ হওয়া অবধি সেটি আর খুলবে না। শুধু ভিতরের ছোট দরজাটা মাঝে মাঝে নিঃশব্দে খুলবে, চা-স্ন্যাক্স আসবে। দরজার বাইরে প্রভাসবাবুর (মান্নাদার ছোট ভাই) সঙ্গে দেখা। তিনি কর্মকর্তাটিকে খুব দুঃখের সঙ্গে বললেন, ‘‘আপনি একটু দেরি করে ফেলেছেন। এখন আর ঢোকা যাবে না। শেষ না-হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’’ উপায় নেই। অগত্যা বাইরের রকে বসে অপেক্ষা, আর ভেতর থেকে ভেসে আসা গান শোনা। ঘর থেকে ওনাকে দেখতে পেলেও কিছু করার নেই।
ওদিকে মান্নাদা বলেছেন, ‘ঠিক ছবির মতো’ গানটার দ্বিতীয় অন্তরায় লিরিক পরিবর্তন করতে হবে। আরও গভীরতা চাই। তাই আমাকে সেই চিন্তায় মগ্ন করালেন। আর মান্নাদা ডুবে গেলেন সৃষ্টির আরও গভীরে। স্বয়ং ঈশ্বরও সেখান থেকে তাঁকে ডাইভার্ট করতে পারবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy