Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

অনামী শিল্পের মহাযজ্ঞ

সিমা-র উদ্যোগে শহরে এক নতুন স্বপ্ন। প্রদর্শনী থেকে পুরস্কারও। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।এই রকম ১৫৯-টি কাজ দিয়েই শুরু হতে চলেছে সিমার এক অনন্য প্রচেষ্টা। যার পরিকল্পনা শুরু বছর দুয়েক আগে। সিমার ২০-তম বার্ষিকীতে। ঠিক হয়েছিল এমন একটা পুরস্কার দেওয়া হবে যেটা সারা ভারতের নানান প্রান্ত থেকে আসা অনামী কিন্তু প্রতিভাবান শিল্পীদের সম্মানিত করবে। খানিকটা একই রকম প্রচেষ্টা ব্রিটেনের টেট গ্যালারিও করে থাকে।

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৫ ০১:০০
Share: Save:

* আলকাতরার মতো অন্ধকারে ঢাকা স্টুডিয়ো ২১-এর একটা ঘর। তার মাঝে কাচের আলোকিত ছোট একটা ঘর। আর সেই কাচের দরজাটা খুললেই অন্য এক পৃথিবী। সেখানে উঁচু একটা কাঠের টেবিল। তার ওপর রাখা স্বচ্ছ এক কাচের বাক্স। ভেতরে ধুকপুক করছে একটা লাল হৃৎপিণ্ড। সতেজ, যেন একদম জীবন্ত। পেছন থেকে ভেসে আসে সেই হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি।

দেবাশিস বরুয়ার এই মিক্সড মিডিয়ার কাজের নাম ‘আই লাভ মাই হার্ট’।

* রামদুলারি পার্কের বাড়িটার সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলেই চোখে পড়ে বিশাল এক ক্যানভাস। ঝুলছে দেওয়ালে। ক্যানভাসের মাঝে ঝুলন্ত আস্ত এক রুই মাছের গাদার টুকরো। তার ব্যাকড্রপে আবছায়া কিছু হেডলাইন। ঠিক যেন এক খবরের কাগজের পৃষ্ঠা। সঙ্গে একটা সাদাকালো ছবি।

পাপ্পু বর্ধন এই ফোটোপ্রিন্ট আর অ্যাক্রিলিক অন ক্যানভাস কাজটার নাম রেখেছেন ‘ষোলো আনা বাঙালি’।

* সিমা গ্যালারির দেওয়াল জুড়ে ক্যানভাসে আঁকা একটা সাদা গাড়ি। যদিও সেটা এ কাজের বিষয় নয়। বিষয় গাড়ির চাকা। আর তার কভার। যে হুইল কভারের মধ্যে ধরা পড়ছে শহরের রাজপথের টুকরো এক অংশ। আর এই রিয়েলিজমকে অদ্ভুত ভাবে ভেঙে দিচ্ছে সালভাদর দালির অনুপ্রাণিত এক আলসে ঘড়ি। সুজিত কর্মকারের এই অয়েল অন ক্যানভাসের নাম ‘লাইফ হুইল’।

এই রকম ১৫৯-টি কাজ দিয়েই শুরু হতে চলেছে সিমার এক অনন্য প্রচেষ্টা। যার পরিকল্পনা শুরু বছর দুয়েক আগে। সিমার ২০-তম বার্ষিকীতে। ঠিক হয়েছিল এমন একটা পুরস্কার দেওয়া হবে যেটা সারা ভারতের নানান প্রান্ত থেকে আসা অনামী কিন্তু প্রতিভাবান শিল্পীদের সম্মানিত করবে। খানিকটা একই রকম প্রচেষ্টা ব্রিটেনের টেট গ্যালারিও করে থাকে। তবে সেই গ্যালারির টার্নার পুরস্কারের সঙ্গে পদ্ধতিগত ভাবে সিমা-র এই পুরস্কারের একটা পার্থক্য রয়েছে। ‘‘আমরা চেয়েছিলাম নতুন শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতে। তাঁদের যে সাহায্যের দরকার, তা আমাদের দেশে নেই। এখানে তেমন কোনও মিউজিয়াম নেই, কোনও প্রতিষ্ঠান নেই। সরকারের তরফ থেকেও তেমন কিছুই নেই। এর জন্য আমরা আমাদের তরুণ শিল্পীদের সে ভাবে প্রোমোট করতে পারি না,’’ বলছেন সিমা-র কর্ণধার রাখি সরকার।

কিন্তু শহর পেরিয়ে দূরদূরান্ত থেকে পরিচিতির আড়ালে থাকা শিল্পীদের ভাল কাজ খুঁজে আনাটাও তো কঠিন ব্যাপার। সাধারণত নতুন শিল্পীদের খোঁজ করতে গেলেও অভ্যস্ত চোখ চলে যায় দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা বা বডোদরার মতো শহরে। ওড়িশার প্রত্যন্ত গ্রামে কী হচ্ছে বা সুদূর রাজকোটে কোন অনামী শিল্পী কী কাজ করছেন, তার খোঁজ ক’জন রাখেন?

এই প্রজেক্টটা করতে গিয়ে দেখা যায় এ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিভার এক বিশাল ক্ষেত্র অধরাই রয়ে গিয়েছে। প্রতিভার অভাব নেই সেখানে। অভাব সুযোগের। প্রসিদ্ধ গ্যালারিগুলোতে প্রদর্শনী করার ক্ষমতা তাদের নেই। সরকারের তরফ থেকেও যে সুযোগ পাওয়া যায়, সেটাও তাঁদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঠিক হয় একদম স্বচ্ছ, পক্ষপাতহীন বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রতিভাদের তুলে ধরা হবে এই প্রজেক্টের মাধ্যমে।

শুধু তাই নয়, বাজারে কী বিক্রি হতে পারে না-পারে, সেই চিন্তাকে সরিয়ে রেখে কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে শিল্পীদের। আমাদের দেশে বহু প্রাইভেট গ্যালারির মূল সমস্যা হল বেশির ভাগ সময় বাজারি ফরমায়েশির কথা ভেবে শিল্পীদের কাজ করতে হয়। কিন্তু এখানে সে চাপ নেই। বিষয় নির্বাচন থেকে শুরু করে আইডিয়া নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা— সব কিছুতেই পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয় শিল্পীদের। শিল্পীর প্রথাগত প্রশিক্ষণ না থাকলেও অসুবিধে নেই। বয়সসীমা ২৫ থেকে ৪৫। তার মধ্যে এক বছরের ছাড়ের সুবিধে। শর্ত বলতে, শিল্পীকে প্র্যাকটিসিং আর্টিস্ট হতে হবে।

এই সব মেনেই দেশের ১৬টা প্রদেশ থেকে ২০০০ দরখাস্ত আসে জুরি-সদস্যদের কাছে। প্রাথমিক জুরির মধ্যে ছিলেন যোগেন চৌধুরী, সুসেন ঘোষ, লালুপ্রসাদ সাউ, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। যাঁরা কাজ পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা প্র্যাকটিসিং আর্টিস্ট কি না, সেটা বোঝার জন্য জুরি সদস্যরা নিপুণ ভাবে পুরনো কাজও দেখেন। দু’তিন বছরের কাজ দেখে বিচার হয় সেই সব শিল্পী প্র্যাকটিসিং আর্টিস্ট কি না। কিন্তু কাজ দেখানোর সময় সেই শিল্পীদের পরিচয় গোপন রাখা হয় জুরির কাছে।

প্রথম বাছাইয়ে ২০০০ থেকে সংখ্যাটা নেমে আসে ১৭৯-তে। এই শিল্পীদের বলা হয় শেষ রাউন্ডে সিডি নয়, তাঁদের আসল কাজ দেখা হবে। এই রাউন্ডে এসে আরও ২০-টা শিল্প-কাজ বাদ পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত বাছাই হয় ১৫৯-টি কাজ।

শুধু পেন্টিং নয়, নিউ মিডিয়া, ইনস্টলেশন, ভাস্কর্য, এমনকী চল্লিশের ওপর গ্রাফিক্সের কাজও থাকছে এই প্রদর্শনীতে। গ্রাফিক্সের ওপর জোর দেওয়ার অন্যতম কারণ হল এ দেশে এখন খুব উচ্চমানের কাজ হয় গ্রাফিক আর্ট-এ। দুর্ভাগ্যবশত সেই কাজগুলো প্রচার থেকে প্রায়ই বঞ্চিত থাকে।

কখনও বা জুরি সদস্যরা বেছে নিয়েছেন কোনও স্বশিক্ষিত গৃহবধূর কাজ। কখনও বা তাঁদের মনে ধরেছে কলেজপড়ুয়ার নান্দনিক প্রচেষ্টা। বাছাই কাজের মধ্যে প্রথমেই চোখে পড়ে নিছক ফর্ম থেকে বেরিয়ে গিয়ে ধারণাভিত্তিক কাজ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার তাগিদ। হয়তো বা সিনেমার পোস্টার দিয়ে তৈরি এক শিল্পকৃতি। বা বাতিল ইলেকট্রিক স্যুইচ দিয়ে তৈরি ফেলে আসা স্মৃতিকে উৎসর্গ করে এক কাজ। তামিলনাড়ুর ভি যুবন বোথ্যিসাথুভর যুদ্ধের ফোটোগ্রাফ দিয়ে তৈরি করেছেন সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক সৃষ্টি। এমন ভাবে রঙের ব্যবহার করেছেন, যে কাজটার এক পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে মনে হয় লালের আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে। আবার ঠিক উল্টো দিক দিয়ে হাঁটলে মনে হয় যেন সতেজ সবুজ রঙে মোড়া এক প্লাইবোর্ড। খানিকটা অভিনব ভাবে যুদ্ধ এবং শান্তির থিমকে শিল্পী ধরেছেন তাঁর কাজের মধ্যে।

শুধু সিমা নয়, শহরের আরও তিনটে গ্যালারিতে প্রদর্শিত হবে এই সব শিল্পকলা। স্টুডিয়ো ২১, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস ছাড়াও প্রদর্শনী চলবে রামদুলারি পার্কের একটা পুরনো বাড়িতেও। এই বাড়িতে রয়েছে এক ওয়্যারহাউস, যেখানে রাখা থাকবে সব ইনস্টলেশন। বহু বছরের পুরনো এই বাড়ির কিছু দেওয়ালে নতুন রঙের পোঁচ পড়েনি। আর সেগুলো ও ভাবেই রাখা হচ্ছে। ‘‘স্টেরাইল একটা পরিবেশ আমাদের দরকার নেই। সাধারণত গ্যালারিগুলোতে যে পরিবেশ থাকে সেটাকে ‘সাবভার্ট’ করেই আমরা একটা অন্য রকম পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করেছি। আর তা থেকেই পুরনো ঘরগুলো কী অসাধারণ একটা চরিত্র নিয়ে নিয়েছে,’’ বলছিলেন সিমা-র কর্ণধার।

এই শিল্পযজ্ঞের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে ১৪ মার্চ। রামদুলারি পার্কের খোলা প্রাঙ্গণে। চলবে ১২ এপ্রিল অবধি। এক মাস ধরে জায়গাটা ও ভাবেই রেখে দেওয়া হবে। সেখানে চলতে থাকবে নানা রকম পারফর্ম্যান্স, স্লাইড প্রজেকশন্স, সৃষ্টিশীলতা নিয়ে আড্ডা। ‘‘আমরা একটা ‘টক’ সিরিজেরও আয়োজন করছি। সেখানে একটি বক্তৃতা দেবেন ফিজিসিস্ট গৌতম বসু। বক্তৃতার বিষয় হল ‘আর্ট ইন সায়েন্স’,’’ বলছেন প্রতীতি বসু সরকার, সিমা গ্যালারির চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর।

অনেকেই মনে করছেন যে, যেভাবে পুরো ব্যাপারটা সাজানো হয়েছে তাতে কলকাতার পর্যটনকেও সমৃদ্ধ করবে এই প্রয়াস। প্রদর্শনীর সঙ্গে চলবে আরও দশটি সমান্তরাল প্রোজেক্ট। অন্যান্য গ্যালারিতেও চলবে নানা অনুষ্ঠান। আর্ট কলেজগুলোতে ওয়ার্কশপ। স্কুল পড়ুয়ারা তৈরি করবে দেওয়াল চিত্র।

আর অবশ্যই থাকছে সিমা পুরস্কার, যা ঘোষণা করা হবে ১৩ মার্চ। বিজয়ী পাবেন ৫ লক্ষ টাকার চেক। আর থাকছে দু’টো জুরি পুরস্কার যার প্রতিটির মূল্য ২ লক্ষ টাকা। এই ফাইনাল জুরিতে থাকছেন চিত্রকর ছাড়াও লেখক, চিত্রগ্রাহক, পরিচালক থেকে শুরু করে শিল্প-সংগ্রাহকও। বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আসা জুরি মেম্বার থাকার দরুন রিভিউটা থিওরিটিক্যাল আর টেকনিক্যাল কচকচানির থেকে বেরিয়ে অন্য একটা দৃষ্টিকোণ দেবে বলেই আশা করা যায়।

মঞ্চ তৈরি। অপেক্ষা আর কিছু দিনের। শিল্পের এক মহাযজ্ঞের অংশীদার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এ শহর।

‘টক’ সিরিজের কয়েকটি

(রামদুলারি পার্ক, সন্ধে ৫টা থেকে ৭টা)

১৫/৩/২০১৫ আর্ট রাইটিং অ্যান্ড পাবলিকেশনস শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় ও মনসিজ মজুমদার

১৮/৩/২০১৫ লিটারেচার অ্যান্ড আর্ট স্বপন চক্রবর্তী ও অনুরাধা ঘোষ

১৯/৩/২০১৫ থিয়েটার অ্যান্ড আর্ট হিরণ মিত্র ও গৌতম হালদার

২০/৩/২০১৫ মিউজিক অ্যান্ড আর্ট দেবজ্যোতি মিশ্র

২২/৩/২০১৫ আর্ট ক্রিটিসিজম ইন কনটেম্পোরারি টাইমস মৃণাল ঘোষ ও রীতা দত্ত

২৪/৩/২০১৫ আর্ট অ্যান্ড পারফর্ম্যান্স সুমন মুখোপাধ্যায় ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়

৩০/ ৩/ ২০১৫ সায়েন্স অ্যান্ড হেরিটেজ জয় সেন ও অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE