Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

উত্তমদাকে নকল করলে এই জায়গাটা পেতাম না

গল্ফ গ্রিনের বাগানে অকপট সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কানে ফোন। জুহুতে বসা বিদ্যা বালন-ও তাই। শ্রদ্ধায় অকপটআমি কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চাই। এটা একটা কারণ। আর একটা কারণ বলতে পারো, আমি কোনও দিনই টিপিক্যাল ফিল্মস্টার হতে চাইনি। সব সময় চাইতাম মানুষ যেন আমার কাজের প্রশংসা করে। এমন নয় যে তাঁদের ভাবনাচিন্তাকে কোনও দিন গুরুত্ব দিইনি। আমি চেয়েছি নিজের মতো করে মানুষের হৃদয় জয় করতে।

শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
Share: Save:

শুক্রবারের সংখ্যার পর

বিদ্যা: আমরা যেহেতু বাংলা ছবি নিয়ে কথা বলছি, সত্যজিৎ রায়-কে নিয়ে কথা না বললে ব্যাপারটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বাইশ বছর হল উনি নেই। আপনাদের একসঙ্গে কাজ করার কত স্মৃতি। কত মুহূর্ত! আজ ফিরে দেখলে কেমন লাগে?

সৌমিত্র: যখন ফিরে তাকাই তখন মনে হয় পনেরোটা ছবি আর দু’টো শর্ট ফিল্ম মিলিয়ে একটা বড় ছবি দেখছি। শিহরন হয়। সব সময়ই তাকিয়ে থাকতাম কখন উনি একটা নতুন ছবি করবেন। আর আমি সেখানে কাজ করার সুযোগ পাব! আসলে কাজের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতেই তো শিখেছি। কিন্তু খুব সায়লেন্টলি সব শেখা হত।

বিদ্যা: এটা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে দর্শকরা তাঁদের পেতে চান। আপনি এ বদলটা দেখেছেন।

সৌমিত্র: এই পরিবর্তনটা সত্যিই কষ্টকর। কিন্তু স্বভাবে আমি লাজুক আর ভিতু প্রকৃতির। আমি শান্ত জায়গায় গিয়ে ভাবতে ভালবাসি। উত্তেজনা, হইহট্টগোল আমার পছন্দ নয়।

বিদ্যা: ঠিকই তো। সে জন্যই আপনি এত দিন ধরে এত কাজ করতে পেরেছেন। এখনকার অভিনেতাদের অভিনয়ের বাইরে এই সব হট্টগোলে মেতে থাকতে হয় বলেই কি আসল জায়গাটা, মানে তাঁদের অভিনয়ের ফোকাসটা থেকে তাঁরা সরে যাচ্ছেন?

সৌমিত্র: ঘটনাক্রমে দু’টো ব্যাপারকেই মিলিয়ে চলতে হবে। বাইরের ব্যাপারগুলোতেও সময় দিতে হবে। আবার অভিনয়টাও করতে হবে চুটিয়ে।

বিদ্যা: উদাহরণ হিসেবে এটা বলতে পারি আজকাল শ্যুটিংয়ের প্রথম দিন থেকে প্ল্যান করা হয় কখন মিডিয়া ইন্টার্যাকশন করতে হবে।

সৌমিত্র: হ্যাঁ, সব প্ল্যান হয়, প্রেমোশন হয়। তবে সত্যি কথা বলতে অভিনেতার আসল কাজের সঙ্গে কিন্তু এর কোনও মিল নেই।

বিদ্যা: একদমই তাই। সৌমিত্রদা, আপনি তো অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কিছু করেছেন। আপনার কফি হাউসের আড্ডা, পত্রিকা চালানো, যাত্রা...

সৌমিত্র: হ্যাঁ, থিয়েটার, যাত্রা। এখনও কবিতা পাঠ করি। লেখালিখিও।

সৌমিত্র: আমি এ রকমই। আমি কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চাই। এটা একটা কারণ। আর একটা কারণ বলতে পারো, আমি কোনও দিনই টিপিক্যাল ফিল্মস্টার হতে চাইনি। সব সময় চাইতাম মানুষ যেন আমার কাজের প্রশংসা করে। এমন নয় যে তাঁদের ভাবনাচিন্তাকে কোনও দিন গুরুত্ব দিইনি। আমি চেয়েছি নিজের মতো করে মানুষের হৃদয় জয় করতে। জীবনে যে সফল, সে-ই স্টারডমের স্বাদ পেয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকেই নিজের মতো করে স্টারডমটাকে বুঝেছে। আমি যদি আমার বড় দাদা, উত্তমকুমারকে নকল করতে শুরু করতাম, তা হলে আমি আজ এই জায়গায় আসতে পারতাম না।

বিদ্যা: ফ্যাসিনেটিং! আজকাল লোকজন স্টেটাস আপডেট করে বোঝায় তারা অমুক রেস্তোরাঁয় খেয়েছে, ওখানে সূর্যাস্ত দেখেছে। এ ভাবেই তারা ইন্টার্যাক্ট করতে চায়। আপনিও করেছেন। কিন্তু শিল্পের নানা মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে। অনেক নান্দনিক সব ইন্টার্যাকশন। সৌমিত্রদা আজ থেকে একশো বছর বাদে আপনি কী হিসেবে মানুষের মনে থাকতে চান? ইন্টেলেকচুয়াল এক অভিনেতা হিসেবে? না কি কবি-অভিনেতা হিসেবে?

সৌমিত্র: যদি মনে রাখে, আমি চাই লোকে আমাকে মনে রাখুক এমন এক ব্যক্তি হিসেবে যে অনেক কাজ একসঙ্গে করতে ভাসবাসত। আর সবচেয়ে ভালবাসত বাঁচতে।

বিদ্যা: কী সুন্দর!

সৌমিত্র: এবং বাঁচার দিক থেকে দেখতে গেলে আমার কোনও আফসোস নেই।

বিদ্যা: আপনি এখন অন্য ছবি দেখার সময় পান?

সৌমিত্র: না, আগের মতো পাই না। প্রথমত যাতায়াতের সমস্যা। দ্বিতীয়ত শারীরিক অসুস্থতা। তবুও চেষ্টা করি ভাল ছবি দেখার। নয়তো ‘কহানি’ দেখলাম কী করে? একদিন সুজয়ের সঙ্গে দেখা হল। আগে ওকে চিনতাম না। ও আমাকে বলেছিল, ‘আপনি হয়তো জানেন না, আপনার মতো মানুষকে দেখেই আমি সিনেমার প্রেমে পড়েছি।’ তখন আমি ওকে বলি, শুনেছি তুমি ‘কহানি’ নামে একটা সিনেমা তৈরি করেছ। তার পরে ও জানতে চায় আমি ছবিটা দেখেছি কি না। আমি ‘না’ বলতেই ও নিজে থেকে ব্যবস্থা করে দেয় সিনেমাটা দেখার। দেখার মিনিটখানেক পরেই আমি সুজয়কে ফোনে জানাই ছবিটা আমার দারুণ লেগেছে! আসলে একটা ভাললাগা তৈরি হয় যখন দেখি অন্য কোনও অভিনেতা অসাধারণ কাজ করছে।

বিদ্যা: এটা আমাদের কাছে অনুপ্রেরণা। আমরা বুঝতেই পারিনি ছবিটা কী ভাবে তৈরি হল। আসলে তখন সেটে সবার মধ্যে পাগলামি ছিল।

সৌমিত্র: অন্য ভাষার ছবি হলেও ছবির পরিবেশটা ছিল খুব বাঙালি।


‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শ্যুটিংয়ে।

বিদ্যা: অ্যাজ আ ম্যাটার অব ফ্যাক্ট, জানেন আমার স্বপ্ন ছিল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করা। আমি কোনও দিন ভাবিইনি আমার জীবনের প্রথম বিজ্ঞাপনেই আপনার আর মাধবীদির সঙ্গে কাজ করতে পারব। বিজ্ঞাপনের সেই শ্যুটিংয়ের কথা মনে আছে আপনার?

সৌমিত্র: তা আর মনে থাকবে না? ওই মুহূর্তগুলো আজও উপভোগ করি। ‘ভাল থেকো’র অভিজ্ঞতাটাও।

বিদ্যা: আমারও মনে আছে ‘ভাল থেকো’র প্রথম দিনের শ্যুটিংয়ের কথা। আমি খুব নার্ভাস। রীতিমতো কাঁপছি। দৃশ্যে আমার কোনও সংলাপ নেই। কিন্তু আপনার সঙ্গে অভিনয় করে কোনও অস্বস্তিতেই পড়তে হয়নি।

সৌমিত্র: যখন ভাল কিছু হয়, তখন দু’তরফেই হয়।

বিদ্যা: একদম।

সৌমিত্র: তোমাকেও ধন্যবাদ। কারণ তোমার মতো একজন ভাল অভিনেত্রী এবং একজন এত সুন্দর মানুষের সঙ্গে তুমিই আমাকে পরিচয় করে দিয়েছ। আমার মনে আছে তোমার সঙ্গে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার নিতে গিয়ে দেখা হয়েছিল।


বিদ্যা: হ্যাঁ, আমার প্রথম জাতীয় পুরস্কার।

সৌমিত্র: আমার মনে আছে তুমি আমার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলে। একটা দারুণ মুহূর্ত।


নিজের আঁকা ছবি হাতে। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

বিদ্যা: কী বলব বুঝতে পারছি না... আমার শেষ প্রশ্ন সৌমিত্রদা। আর বোর করব না।

সৌমিত্র: না, না, বোর শব্দটা ভুল। আমি খুবই ভাগ্যবান যে তোমার সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কথা বলতে পারছি। প্রায় এক ঘণ্টা হল।

বিদ্যা: আবার যদি পুনর্জন্ম হয়, আপনি কি এই একই রাস্তার পথিক হবেন?

সৌমিত্র: না, একই রাস্তায় হাঁটলে নতুনত্ব কিছু পাব না। তবে এই জীবনের আবেগ, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ক্ষমতাটা যেন পাই। গতে বাঁধা জীবন আমি চাই না। হয়তো পরজন্মে অভিনেতা হতেও চাই না। চিত্রশিল্পী হতে চাই...

বিদ্যা: আপনি তা হলে ক্যানভাসে গল্প আঁকবেন? আপনার এ রকম একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ দিলেন সৌমিত্রদা। অসংখ্য ধন্যবাদ।

সৌমিত্র: তুমি এ সময়ের সেরাদের মধ্যে অন্যতম। আরও ভাল ভাল কাজ করো। ভাল থেকো...

বিদ্যা: ‘ভাল থেকো জ্যাঠামশাই’।

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE