Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Presents

এক ঢিলে দুই পাখি

পিএফ, পিপিএফ, জীবনবিমায় দেড় লক্ষ টাকা ঢালা সারা। তার পরেও কর বাঁচাতে জায়গা খুঁজছেন বাড়তি লগ্নির। জাতীয় পেনশন ব্যবস্থার কথা ভেবে দেখতে পারেন তো। এই বাজেটেই সেখানে ৫০ হাজার টাকা অতিরিক্ত ঢালার বন্দোবস্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী। রাখতে পারলে কর বাঁচবে। সুরক্ষিত হবে অবসর জীবনও।পিএফ, পিপিএফ, জীবনবিমায় দেড় লক্ষ টাকা ঢালা সারা। তার পরেও কর বাঁচাতে জায়গা খুঁজছেন বাড়তি লগ্নির। জাতীয় পেনশন ব্যবস্থার কথা ভেবে দেখতে পারেন তো। এই বাজেটেই সেখানে ৫০ হাজার টাকা অতিরিক্ত ঢালার বন্দোবস্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী। রাখতে পারলে কর বাঁচবে। সুরক্ষিত হবে অবসর জীবনও।

অমিতাভ গুহ সরকার
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৫ ০২:০১
Share: Save:

সংসদে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির বাজেট বক্তৃতার পরে দু’মাসেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। হালে সেই অর্থ বিল পাশও করিয়েছে মোদী সরকার। সেই সূত্রেই এই সে দিন বাজেটের কিছু অংশ ফিরে দেখতে গিয়ে একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল। মনে হল, সেই বিষয়টি ফের এক বার মনে করিয়ে দিলে হয়তো অনেকেরই কিছুটা সুবিধা হতে পারে। আর সেই কারণেই ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম (জাতীয় পেনশন ব্যবস্থা) নিয়ে আজকের এই আলোচনা।

ঢিল আপনার হাতে

এ বার বাজেটে আমার-আপনার মতো করদাতাদের হাতে একটি ঢিল তুলে দিয়েছেন জেটলি। আর গাছে বসিয়েছেন দু’টি পাখি। যাঁরা মন দিয়ে বাজেট পড়েছেন, তাঁরা নিমেষে বুঝে যাবেন, এখানে ঢিলের অর্থ লগ্নি আর দুই পাখি মানে অতিরিক্ত কর সাশ্রয় এবং পেনশনের ব্যবস্থা। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। আমি জাতীয় পেনশন ব্যবস্থায় ৫০ হাজার টাকা বাড়তি রেখে করছাড়ের সুবিধার কথা বলছি।

ব্যাপারটা কী?

এত দিন ৮০সি ধারায় বছরে ১.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়ে আয়কর বাঁচানোর সুবিধা ছিল। এর মধ্যে ছিল জাতীয় পেনশন ব্যবস্থায় এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত লগ্নির সুযোগও। কিন্তু এ বার বাজেটে সেখানে আরও একটি সুবিধার কথা ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। তা হল, এই আর্থিক বছর থেকে ৫০,০০০ টাকা বাড়তি ঢেলেও করছাড়ের সুযোগ মিলবে ওই প্রকল্পে। এবং তা পাওয়া যাবে আয়কর আইনের ৮০সিসিডি ধারা অনুযায়ী। অর্থাৎ, জীবনবিমা, পিএফ, পিপিএফ ইত্যাদিতে দেড় লক্ষ টাকা (৮০সি ধারা) সঞ্চয়ের পরে আরও ৫০ হাজার টাকা লগ্নিতে করছাড়ের সুবিধা পাওয়া যাবে।

ভেবে দেখুন, শুধু তো করছাড়ের সুবিধা নয়। এক দিকে, এই বাড়তি লগ্নি যেমন কর বাঁচাবে, তেমনই অবসর জীবন সচ্ছল করতেও তা হবে আপনার হাতিয়ার। করছাড় পাওয়া যাবে লগ্নির বছরেই। পেনশন পেতে অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে।

অনেকের মনেই তাই প্রশ্ন, আদৌ কেমন এই পেনশন প্রকল্প? সেখানে লগ্নি কতটা সুরক্ষিত? পেনশন বাবদ আয়ই বা কেমন? প্রয়োজনে কি টাকা তোলার ব্যবস্থা আছে?

চলুন, এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখি।

এনপিএস

পুরো নাম ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম। ২০০৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে গঠিত হয় পেনশন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘পেনশন ফান্ড রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ (পিএফআরডিএ)। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য পেনশনের বন্দোবস্ত করার লক্ষ্যেই ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পেনশন ব্যবস্থা বা ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেমের সূচনা করে পিএফআরডিএ।

প্রথমে এনপিএসের আওতায় ছিলেন শুধু সরকারি কর্মীরা, যাঁরা ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল বা তারপর কাজে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু এর পর ২০০৯ সালের ১ মে থেকে এই প্রকল্পের সুবিধা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সকলের জন্য। অর্থাৎ, এখন চাইলে এই প্রকল্পে যোগ দিতে পারেন বেসরকারি, এমনকী অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরাও।

অ্যাকাউন্টের সার কথা

এ বার এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক এনপিএসের অ্যাকাউন্টের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি—

পার্মানেন্ট অ্যাকাউন্ট নম্বর: এনপিএসের গ্রাহকদের প্রথমেই দেওয়া হয় একটি স্থায়ী (পার্মানেন্ট) অ্যাকাউন্ট নম্বর।

অ্যাকাউন্টের রকমফের: দু’ধরনের অ্যাকাউন্ট খোলা যায় এই পেনশন ব্যবস্থায়—

(১) টিয়ার-১ অ্যাকাউন্ট: এই ধরনের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা যায় না। পেনশন পাওয়াকে পাখির চোখ করে টাকা জমাতে থাকতে হয়।

(২) টিয়ার-২ অ্যাকাউন্ট: এটি অবশ্য স্বেচ্ছা সঞ্চয় প্রকল্প। ফলে এই অ্যাকাউন্ট থেকে গ্রাহক প্রয়োজন মতো যখন খুশি টাকা তুলতে পারেন। তেমনই এখানে করছাড়ের কোনও সুবিধা পাওয়া যায় না।

খুলব কোথায়?

যে-সব জায়গায় এনপিএস অ্যাকাউন্ট খোলা যায়, তার নাম পয়েন্ট অব প্রেসেস বা পিওপি। আবার এই পিওপি-র শাখার নাম পিওপি সার্ভিস প্রোভাইডার বা পিওপি পরিষেবা কেন্দ্র। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক, ডাক বিভাগ, বিভিন্ন বেসরকারি আর্থিক সংস্থা-সহ মোট ৫৮টি সংস্থাকে পিওপি হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে পিএফআরডিএ।

হিসেব রাখে কে?

এই পেনশন ব্যবস্থায় (এনপিএস) হিসাব রক্ষকের নাম সেন্ট্রাল রেকর্ড কিপিং এজেন্সি। সংক্ষেপে সিআরএ। এই সিআরএ হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে এনএসডিএল-কে।

খুলতে পারেন কারা?

এই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন যে কোনও ভারতীয় নাগরিক এবং অনাবাসী ভারতীয়। বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। দাখিল করতে হবে কেওয়াইসি কাগজপত্র।

টাকার অঙ্ক

টিয়ার-১ অ্যাকাউন্ট খোলার সময়ে এবং পরবর্তী কালে প্রতি বার জমা দিতে হবে কমপক্ষে ৫০০ টাকা। বছরে ন্যূনতম জমার পরিমাণ হল ৬,০০০ টাকা।

টিয়ার-২ অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে শুরুতে দিতে হবে ১,০০০ টাকা। পরে প্রতি বার অন্তত ২৫০ টাকা। বছরের শেষে ন্যূনতম ব্যালান্স রাখতে হবে ২,০০০ টাকা।

টাকা খাটবে কোথায়?

নিজের পছন্দ, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি বিচার করে নিজেই ঠিক করতে পারবেন যে, আপনার টাকা কোথায় খাটবে।

লগ্নির মোট তিন রকম জায়গা রয়েছে। এগুলি হল—

(১) অ্যাসেট ক্লাস ‘ই’— মূলত, ইকুইটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত লগ্নিপত্র।

(২) অ্যাসেট ক্লাস ‘সি’—সরকারি ঋণপত্র বাদে অন্যান্য স্থির আয়যুক্ত লগ্নিপত্র।

(৩) অ্যাসেট ক্লাস ‘জি’—বিভিন্ন সরকারি ঋণপত্র।

এর মধ্যে নিজের পছন্দ অনুযায়ী এক বা একাধিক জায়গায় টাকা রাখতে পারেন। যেমন, গ্রাহক যদি মনে করেন তবে লগ্নির পুরোটাই রাখতে পারেন সি অথবা জি অ্যাসেট ক্লাসে। কিন্তু অ্যাসেট ক্লাস ‘ই’
অর্থাৎ ইকুইটিতে রাখা যাবে সর্বাধিক ৫০ শতাংশ।

গ্রাহক পছন্দ না-জানালে, তাঁর টাকা লগ্নি করা হবে একটি মিশ্র ফান্ডে। যার নাম অটোচয়েস লাইফ সাইক্‌ল ফান্ড।

আপনার টাকা কার হাতে?

এনপিএস তহবিলে সংগৃহীত টাকা বাজারে খাটায় ৮টি পেশাদার সংস্থা। এগুলি হল—

এসবিআই পেনশন ফান্ড

ইউটিআই রিটায়ারমেন্ট সলিউশন

এলআইসি পেনশন ফান্ড

কোটাক মহীন্দ্রা পেনশন ফান্ড

রিলায়্যান্স ক্যাপিটাল পেনশন ফান্ড

আইসিআইসিআই প্রুডেন্সিয়াল পেনশন ফান্ড

এইচডিএফসি পেনশন ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি

ডিএসপি ব্ল্যাকরক পেনশন ফান্ড।

এদের মধ্যে আপনার লগ্নির টাকা খাটানোর দায়িত্ব কাকে দেবেন, তা-ও নিজে বেছে নিতে পারেন।

প্রাপ্তিযোগ

এ বার চোখ রাখব টাকা জমিয়ে যাওয়ার পরে পেনশন হিসেবে কেমন টাকা আপনি পাবেন, আপনার টাকা কোথায় খাটছে, বাজারের অবস্থা কী ইত্যাদির উপর। এক নজরে অন্তত জেনে রাখা যাক এ ক্ষেত্রে নিয়মগুলি ঠিক কী—

(১) গ্রাহকের ৬০ বছর বয়স হলে, তাঁকে জমে ওঠা তহবিলের অন্তত ৪০ শতাংশ দিয়ে অ্যানুইটি কিনতে হবে পেনশন পাওয়ার জন্য। বাকি টাকা থোক ফেরত পাবেন।

(২) কিন্তু ৬০ বছরের আগে কেউ টাকা তুলতে চাইলে, অ্যানুইটি কিনতে হবে ৮০ শতাংশ অর্থ দিয়ে। বাকি ২০ শতাংশ ফেরত পাবেন একলপ্তে।

(৩) উভয় ক্ষেত্রেই টাকা ফেরত না-নিয়ে, গ্রাহক ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত তা এনপিএস তহবিলে রেখে
দিতে পারেন।

(৪) প্রকল্প চলাকালীন গ্রাহকের মৃত্যু হলে, তাঁর নামে জমা পুরো টাকা দেওয়া হয় নমিনিকে।

কর-কথা

গোড়াতেই বলেছি, আয়কর বাঁচানোর বড় সুবিধা আছে এনপিএস প্রকল্পে লগ্নিতে। ৮০সি ধারায় ১.৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লগ্নির উপর কর ছাড়ের সুবিধা মিলবে। এ ছাড়া, ৮০ সিসিডি (১বি) ধারায় অতিরিক্ত ৫০,০০০ টাকা লগ্নিতে করছাড় মিলবে ২০১৫-’১৬ অর্থবর্ষ থেকে।

সুবিধা কোথায়?

সহজ-সরল প্রকল্প। বোঝা সহজ।

পার্মানেন্ট অ্যাকাউন্ট নম্বর ব্যবহার করে দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে প্রকল্প চালিয়ে যাওয়া যায়।

ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা মেপে লগ্নির গন্তব্য বেছে নেওয়া সম্ভব।

এসআইপি পদ্ধতিতে জমানো যায়। লগ্নির ন্যূনতম অঙ্কও বড় নয়।

সঙ্গে রয়েছে করছাড়ের সুবিধা।

কাদের জন্য ভাল?

যে কেউই এই প্রকল্পের সুবিধা তুলতে পারেন। বিশেষত—

স্বনিযুক্তরা, এমনিতে যাঁদের পেনশনের ব্যবস্থা নেই।

উঁচু হারে করদাতারা। যাঁরা ৮০সি ধারায় ১.৫০ লক্ষ টাকা লগ্নি করার পরেও বাড়তি করছাড়ের জন্য এনপিএসে লগ্নি করতে চান।

অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী।

পেনশনের ব্যবস্থা থাকলেও যাঁরা কর বাঁচানোর এবং বাড়তি পেনশনের ব্যবস্থা করতে চান।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

জমিই হোক বা সঞ্চয়। আপনার যে কোনও বিষয়-সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শের জন্য লিখুন। ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না। ‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১। ই-মেল: bishoy@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE