Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Presents

পা বাড়ান বুঝেশুনে

যা চকচকে, তা-ই সোনা নয়। সেনসেক্স চড়লেও সময় বিশেষে আপনার শেয়ারের দাম নীচে থাকতেই পারে। এখনই যেমন লগ্নির রাস্তা বেশ বন্ধুর। বিশেষ করে ছোট-মাঝারি শেয়ারের ক্ষেত্রে। তাই সাবধান। পরামর্শ দিচ্ছেন নীলাঞ্জন দে গত কয়েক বছরে আমরা সাধারণ লগ্নিকারীরা বড় শেয়ারের পাশাপাশি ভরসা রেখেছিলাম মাঝারি মাপের শেয়ারের উপরেও। মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রেও ছবিটা ছিল তা-ই। মাঝারি মাপের শেয়ার নির্ভর ফান্ডগুলি রিটার্ন দিচ্ছিল ভালই।

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৯ ০৫:০৯
Share: Save:

টানটান উত্তেজনার মধ্যে একটা আইপিএল শেষ হল। এ বার শুরু হতে চলেছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। অতএব আরও একটা মাস উপভোগ করুন ক্রিকেটের এই উত্তেজনার আবহ। কিন্তু মাথায় রাখবেন, টি-২০ বা একদিনের ক্রিকেটের সঙ্গে কিন্তু সঞ্চয় কিংবা লগ্নির মাঠের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। লগ্নির তুলনা বরং টানা যেতে পারে টেস্ট ম্যাচের সঙ্গে। কখনও হয়তো পিচ বেশ কঠিন। কখনও সহজ। তাই পা ফেলতে হবে দেখেশুনে। ঠিক যেমন এখন।

গত কয়েক বছরে আমরা সাধারণ লগ্নিকারীরা বড় শেয়ারের পাশাপাশি ভরসা রেখেছিলাম মাঝারি মাপের শেয়ারের উপরেও। মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রেও ছবিটা ছিল তা-ই। মাঝারি মাপের শেয়ার নির্ভর ফান্ডগুলি রিটার্ন দিচ্ছিল ভালই। খারাপ পারফরম্যান্স করছিল না ছোট শেয়ারগুলিও। কিন্তু গত এক বছরে সেগুলিতেই অপ্রত্যাশিত রকম ভাটার টান। এই অবস্থায় কি ভরসা রাখা যায় শেয়ার বাজারে? সে ক্ষেত্রে কৌশল কেমন হতে পারে? তা নিয়েই আজ আলোচনা করব।

শেয়ার মূলত তিন ধরনের। বড় শেয়ার বা লার্জ ক্যাপ, মাঝারি শেয়ার বা মিডক্যাপ, ছোট শেয়ার বা স্মলক্যাপ। একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, শেয়ারের এই মাপ কিন্তু সংস্থার ব্যবসার অঙ্কের উপরে নির্ভর করে না। করে বাজারে সংশ্লিষ্ট সংস্থার মোট শেয়ার মূল্যের (মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন) উপরে। অর্থাৎ, শেয়ার মূল্যের অঙ্কের নিরিখে একটি বড় সংস্থার শেয়ারও স্মলক্যাপ বা মিডক্যাপ হতে পারে।

গত কয়েক দিনে ভারতীয় শেয়ার বাজারের দুই প্রধান সূচক সেনসেক্স ও নিফ্‌টি বিপুল ভাবে ওঠানামা করেছে। এই উত্থান-পতনের মধ্যেই সেনসেক্স একাধিক বার ছুঁয়েছে ৩৯,০০০-এর গণ্ডি। আবার লোকসভা ভোটের ফলাফল সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, আমেরিকা ও চিনের মধ্যে শুল্ক যুদ্ধ, বাজার থেকে বিদেশি লগ্নি সরে যাওয়া, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন শেয়ার সূচকের পতনের ধাক্কা— এই ধরনের একগুচ্ছ প্রতিকূল পরিস্থিতি একসঙ্গে তৈরি হওয়ায় মাঝে টানা ন’দিনে প্রায় দু’হাজার পয়েন্ট খুইয়েছিল ওই সূচক। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও উদ্বেগের বিষয় হল, যখনই সূচক উপরে উঠেছে তা হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি বড় শেয়ারের উপর ভিত্তি করে। উত্থানের প্রভাব বাজারের উপরে সামগ্রিক ভাবে পড়েনি। আর এই উত্থানের বাইরে বিশেষ করে থেকে গিয়েছে মাঝারি ও ছোট শেয়ারগুলি। অথচ একটা সময় পর্যন্ত এই শেয়ারগুলিই দৌড়চ্ছিল হরিণের গতিতে। রিটার্ন দিচ্ছিল বড় শেয়ারের থেকে বেশি। এতটাই যে, বিগত কয়েক বছরে বহু ছোট শেয়ার মাঝারি শেয়ারের জায়গায় উঠে এসেছে। মাঝারি শেয়ার কলেবরে বেড়ে হয়েছে বড় শেয়ার। ছোট ও মাঝারি শেয়ার সূচকগুলির সাম্প্রতিক ও অতীতের রিটার্নের একটা ধারণা পাশের তালিকায় দেওয়া হল। তুলে ধরা হল সূচকে বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুরুত্বের পরিমাণও। (রিটার্ন ও প্রতিনিধিত্বের হিসেব শতাংশে)

এই অবস্থায় লগ্নিকারীরা আপাতত তাকিয়ে রয়েছেন নির্বাচনের ফলাফলের দিকে। চাইছেন এমন ফল হোক যা স্থায়ী সরকার গঠনের নিশ্চয়তা দেবে। অবশ্য সেটাও সব নয়। শেয়ার বাজারের ভালমন্দের সঙ্গে দেশের সামগ্রিক আর্থিক পরিস্থিতি-সহ একাধিক আন্তর্জাতিক কারণও জড়িত থাকায় লগ্নিকারীদের মধ্যে কিছুটা দ্বিধা থেকে যাবেই। এখনই কি নতুন করে বাজারে লগ্নি করা উচিত, নাকি পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত আরও কয়েকটা দিন? এই ধরনের বহু প্রশ্ন কাজ করবে তাঁদের মনে।

আমাদের আলোচনা মূলত সাধারণ লগ্নিকারীদের নিয়ে। সত্যি কথা বলতে এখনকার সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নির্দিষ্ট কোনও ধরাবাঁধা ফরমুলা নেই। তবে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কাটাছেঁড়া করে আমরা লগ্নির কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করতে পারি। প্রথমে দেখে নেওয়া যাক সমস্যা ঠিক কোথায় কোথায়।

• সেনসেক্স একটা সময়ে ৩৯,০০০ ছুঁলেও তার প্রভাব সামগ্রিক নয়। মাঝারি শেয়ারগুলি সেই দৌড়ে সামিল হয়নি। বরং বিগত এক বছরে তার বড় অংশ পড়েছে।

• নতুন লগ্নি আপাতত আটকে। লগ্নিকারীরা চাইছেন স্পষ্ট রাজনৈতিক ইঙ্গিত।

• তবে পুঁজির বাজারে ঋণপত্র নির্ভর লগ্নি এখন আরও প্রতিকূল অবস্থায়। ফলে এই অবস্থার মধ্যেও শেয়ার কিংবা শেয়ার ভিত্তিক লগ্নিই পুঁজি বিনিয়োগের পক্ষে অপেক্ষাকৃত ভাল পথ। অবশ্য এর জন্য ধৈর্য ধরতে হবে।

• এলোপাথাড়ি একগুচ্ছ শেয়ার কেনা নয়। কৌশল ঠিক করে নির্দিষ্ট কয়েকটি শেয়ার বেছে পোর্টফোলিও তৈরি করুন। সাফল্য আসবেই। তবে এ ক্ষেত্রেও একই কথা। মেওয়া

ফলবে সবুরেই।

লগ্নির কৌশল

আমার মনে হয়, মাঝারি শেয়ার ঘিরে ঝুঁকি আপাতত বজায় থাকবেই। অন্তত অদূর ভবিষ্যতে। এই বাজারেও কয়েকটি শেয়ার নিশ্চিত ভাবেই ভাল ফল করবে। সেগুলিকে চিহ্নিত করতে না পারলে ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী। তাই শেয়ার বাছাই করার জন্য কিছুটা সময় ব্যয় করতে হবে।

• পোর্টফোলিও তৈরি করার ক্ষেত্রে নজর রাখা উচিত ছোট, বড়, মাঝারি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের শেয়ারের দিকে। কারণ, কোন ক্ষেত্র ভাল ফল করবে আর কোনটি পিছিয়ে থাকবে তা আগে থেকে বোঝা কঠিন। সুতরাং যে সমস্ত শেয়ার সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রকে প্রতিনিধিত্ব করে সেগুলি কেনার দিকেই জোর দিন।

• সংস্থাগুলির ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক আর্থিক ফলাফলের দিকে নজর রাখুন। কারণ, যে সমস্ত সংস্থা ভাল ফল করবে সেগুলিই লগ্নিকারীদের পক্ষে ভাল। সব দিক থেকেই।

• হতেই পারে শক্তপোক্ত পোর্টফোলিও তৈরির জন্য আপনি ভাল শেয়ার বাছাই করতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে ওপেন এন্ডেড ডাইভার্সিফায়েড ইকুইটি ফান্ডের উপরেই ভরসা রাখুন। লগ্নি করুন কম খরচে। ঝুঁকি কমবে। প্রয়োজনের সময়ে সহজ হবে লগ্নির টাকা তুলে নেওয়া।

• পোর্টফোলিওর কোনও আদর্শ আকার হয় না। কারণ, এক এক লগ্নিকারীর লগ্নির ক্ষমতা এক এক রকম। অতএব এ নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভাল।

আর মিডক্যাপ?

এটা ঠিক যে ছোট ও মাঝারি শেয়ারগুলি এখন সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তার মানে এই নয় যে তাদের প্রত্যেকটিই দুর্বল। ঋণ ও বাজারে নগদের জোগানের অভাবেও সমস্যায় পড়েছে বেশ কিছু সংস্থা। তার প্রভাব পড়েছে শেয়ার দরের উপরেও। বাজারের লগ্নির বড় অংশই জমা হচ্ছে বড় শেয়ারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই অবস্থা সাময়িক। পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে ছবি বদলাবেই।

একটু আগেই বলেছি, এখন এমন অনেক বড় শেয়ার রয়েছে যেগুলি কয়েক বছর আগেও ছোট কিংবা মাঝারি আকারের ছিল। সংস্থার সাফল্য ও বাজারের অনুকূল পরিস্থিতির জন্যই তারা এই জায়গায় পৌঁছেছে। এখনও এমন অনেক শেয়ার রয়েছে যেগুলির বড় আকারে পৌঁছনোর সম্ভাবনা রয়েছে। সংস্থার ব্যবসা, আর্থিক ফলাফল বিচার করে এমন কয়েকটি সম্ভাবনাময় শেয়ারকে খুঁজে বার করা যেতে পারে। তবে এই গবেষণার কাজটা করতে হবে বিভিন্ন ক্ষেত্রকে নিয়ে।

কাজটা সহজ নয়। যথেষ্ট সময় সাপেক্ষও। তবে সেটা কিছুটা সহজ করার ব্যাপারে আমি সাহায্য করতে পারি। যেমন, এই মুহূর্তে আর্থিক পরিষেবা, তথ্যপ্রযুক্তি, গাড়ির শেয়ারগুলির দিকে বিশেষ পা না বাড়ানোই ভাল। সাম্প্রতিক সময়ে সেগুলি মোটামুটি দ্রুত গতিতেই এগিয়েছে। বরং নজর দেওয়া যেতে পারে এমন ক্ষেত্রগুলির দিকে যেগুলি বিশেষ এগোতে না পারলেও সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ওষুধ, হাসপাতাল, গাড়ির যন্ত্রাংশ, হালকা যন্ত্রপাতি, হোটেল, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং বিকল্প শক্তি। কবে থেকে এগুলির দাম বাড়তে পারে সেটা এখনকার পরিস্থিতিতে বলা শক্ত। তবে প্রাথমিক কাজ হবে এগুলির উপরে নজর রাখা।

কখন কিনবেন?

শেয়ার বাছাই করে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছেন কি? বাছাই করা সেই শেয়ার সম্পর্কে আপনার নিজের আত্মবিশ্বাস রয়েছে তো? তা হলে আর দেরি করবেন না। আর্থিক ভাবে তৈরি থাকলে কিনে ফেলুন। বিশেষ করে শেয়ারটির দাম যখন কম থাকছে। সেটাই বিচক্ষণ লগ্নিকারীর লক্ষণ।

আর একটা ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। অনেক সময়ে বাজারের হাওয়ার উপরে ভর করে কোনও কোনও শেয়ারের উত্থান হয়। তা দেখে লগ্নিকারীরা আরও পুঁজি ঢাললে সেই শেয়ারের গতি আরও বাড়ে। আবার এর উল্টোটাও ঘটে। অনেকে এই ধরনের শেয়ারের উত্থান-পতনের দিকে নজর রাখেন। শেয়ার কেনেন পতনের সময়ে। তবে এই ধরনের পদক্ষেপে ঝুঁকিও রয়েছে। সাধারণ লগ্নিকারীদের এই ধরনের ঝুঁকি না নেওয়াই ভাল। পুঁজির পাশাপাশি আপনার সম্পদ হোক গবেষণা ও ধৈর্য।

(লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Investment Share Market
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE