Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Presents

সুদের স্বাদ

সুদ বাড়ছে। কারও কাছে সে স্বাদ মিষ্টি তো কারও লাগছে তেতো। সেই নিরিখেই জরুরি হয়ে উঠেছে সঞ্চয়ের পাতে লগ্নির ‘মেনু’র খানিকটা অদলবদল করা। কী ভাবে? হদিস দিচ্ছেন নীলাঞ্জন দেজীবনভর এমন মেঘ-রোদ্দুরের খেলা চলবেই। সুদ কখনও বাড়বে, কখনও কমবে। পরিস্থিতি যাই হোক, বুদ্ধিমানের কাজ হল সেই অনুযায়ী সঞ্চয় বাড়ানোর পথ বেছে নেওয়া।

নীলাঞ্জন দে
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৮ ০৩:৪০
Share: Save:

ঝমঝমিয়ে এক পশলা বৃষ্টির পরে ঠিক যেন মন ভাল করা রোদ উঠেছে। কমতে থাকা সুদ ঘুম কেড়েছিল যাঁদের, আচমকাই তাঁদের চোখে খুশির ঝলক। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক টানা দু’বার সুদ বাড়ানোয়, ঋণের পাশাপাশি তার হার বাড়ছে ব্যাঙ্ক জমাতেও। সুদ নির্ভর মানুষেরা নিশ্চিন্ত বোধ করছেন এই ভেবে যে, তা হলে পুঁজি এ বার আর একটু বাড়বে। কিন্তু কত দিন?

উল্টো দিকে জমাট মেঘে মুখ ভার করা আকাশের ছবি। গাড়ি, বাড়ির জন্য ধার নিয়েছেন যাঁরা, মাসিক কিস্তি বাড়ায় তাঁদের মাথায় হাত। চিন্তা, সব সামাল দেওয়া যাবে তো!

জীবনভর এমন মেঘ-রোদ্দুরের খেলা চলবেই। সুদ কখনও বাড়বে, কখনও কমবে। পরিস্থিতি যাই হোক, বুদ্ধিমানের কাজ হল সেই অনুযায়ী সঞ্চয় বাড়ানোর পথ বেছে নেওয়া।

খোঁজ কিসের

কখন শেয়ার বাজারে লগ্নি করা ভাল, কোন সময়ে কী করলে মিউচুয়াল ফান্ড ঢেলে রিটার্ন দিতে পারে, কখন কোথায় তহবিল সরালে আগের থেকে বেশি মুনাফার মুখ দেখা সম্ভাবনা বাড়বে— সে সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ানো সব সময় জরুরি। আর সে জন্যই এই বেশি সুদের বাজারে ব্যাঙ্ক জমা ও ফান্ডে লগ্নির হিসেব খুলে বসেছেন অনেকে। ভাবছেন, সঞ্চয়ের কৌশল দ্রুত বদলানো উচিত কিনা। তাঁদের প্রশ্ন, শেয়ার বাজার বা ফান্ডের মতো ঝুঁকিপূর্ণ লগ্নির অন্তত কিছুটা ফের ব্যাঙ্কের মতো নিশ্চিত ও নিয়মিত আয়ের জায়গায় নিয়ে আসার কথা ভাবা উচিত কি? বিশেষত এর আগে সুদ কমতে থাকার কারণেই যেহেতু তুলনায় বেশি ঝুঁকির ওই সব লগ্নিতে সরে যেতে শুরু করেছিলেন অনেকে।

চলুন, এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজি আজ। সুদ বৃদ্ধির জমানায় পর্দা সরিয়ে দেখি, কোথায় কী সুবিধা লুকিয়ে। কেমন করে আদায় করা যায়। আবার সতর্কই বা থাকতে হবে কোন ক্ষেত্রে।

কত দিন?

জুলাইয়ে খুচরো ও পাইকারি, দুই বাজারে মূল্যবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত বেশ কিছু দিন মাথা তুলেছে সেই দৈত্য। তাই মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানার লক্ষ্যে শীর্ষ ব্যাঙ্ক টানা দুই ঋণনীতিতে ২৫ বেসিস পয়েন্ট করে রেপো রেট (বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি যে সুদে শীর্ষ ব্যাঙ্কের থেকে ঋণ নেয়) বাড়িয়েছে। ফলে সুদ বেড়েছে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ঋণ ও আমানতে।

অনেকেরই ধারণা ছিল মূল্যবৃদ্ধি কমলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদ ছাঁটবে। কিছুটা মাথা নামিয়েওছে। কিন্তু ডলারের নিরিখে টাকার দাম রেকর্ড তলানিতে নামায় ফের বেড়েছে তার মাথাচাড়া দেওয়ার আশঙ্কা। অনেকেই তাই মনে করছেন, সেই ঝুঁকি এড়াতে শীর্ষ ব্যাঙ্ক আপাতত কিছু দিন বহাল রাখবে বেশি সুদের জমানা। অন্তত এখনই চট করে সুদ খুব কমার সম্ভাবনা আপাতত বেশ কম।

সুতরাং যে ব্যাঙ্ক বা প্রকল্প সব থেকে বেশি সুদ দেবে, সেখানে কিছুটা জমা সরালে মন্দ কি? আর যদি আগে থেকেই সেখানে মেয়াদি জমা থেকে থাকে, তবে সম্ভব হলে তার পরিমাণ আরও একটু বাড়ানো যায়। লোকসানের প্রসঙ্গে পরে আসছি।

ধারের ধাক্কা

সুদের হার বাড়ায় সব থেকে বেশি বিরক্ত হয়েছেন ঋণগ্রহীতারা। অনেকেরই মাসের আয় নির্দিষ্ট। বছরের মাঝখানে তা বাড়ে না। বাড়ি-গাড়ি হোক বা অন্য কিছু, ঋণ নেওয়ার সময় সকলে সেই আয়ের নিরিখে নিজের খরচ বওয়ার ক্ষমতা হিসেব করেই পা বাড়িয়েছিলেন। এ বার আচমকা সেই খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে তাঁরা।

আমার মতে এই পরিস্থিতিতে তাঁদের অবিলম্বে খতিয়ে দেখা উচিত খরচ। মাসে মাসে ইএমআইয়ের অঙ্ক বেড়েছে কি? বাড়লে, কতটা? বাড়তি ধাক্কা সামলানোর জন্য কী করতে হবে? খরচ কতটা কমানো সম্ভব? তাঁদের জন্য বার্তা—

• অবিলম্বে খোঁজ নেওয়া দরকার কোন ব্যাঙ্ক বা ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান তুলনায় কম সুদে ঋণ দিচ্ছে।

• যত টাকাই শোধ হয়ে থাকুক, বাকিটা তুলনায় কম সুদে ঋণ দেওয়া ব্যাঙ্কে সরিয়ে আনতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দিলেই চলবে।

• জানুন ঋণ সরাতে জরিমানা, প্রসেসিং ফি দিতে হবে কিনা।

• এর পাশাপাশি সাংসারিক ও দৈনন্দিন খরচও ঢেলে সাজানো দরকার। কারণ সীমিত আয়ের মধ্যে থেকেই করতে হবে বাড়তি খরচের ব্যবস্থা। অন্তত যত দিন না সেই খরচ সামলানোর জন্য বাড়তি রোজগারেরও মুখ দেখা নিশ্চিত হচ্ছে।

• বাজার-হাট, বেড়ানো, খাওয়া-দাওয়া, কেনাকাটা ইত্যাদিতে একটু একটু করে রাশ টানলে কিন্তু হাতে কিছুটা বাড়তি থাকবে।

• যে খরচ এখন না করলেও চলে, সেগুলি আপাতত পিছনোই ভাল।

হেই সামালো

সুদ বাড়ার জেরে মাসে মাসে যেমন বেশি ইএমআই গুনতে হচ্ছে, তেমনই ব্যাঙ্ক আমানত থেকে বেশি টাকা ঘরে তোলার সুযোগও খুলছে। ফলে—

• মাসে হিসেবের বাড়তি অংশ বেরোনোর ধাক্কা সেই টাকা দিয়ে সামাল দেওয়া যায় কি না, তা দেখুন।

• বেশি সুদের হাত ধরে ব্যাঙ্ক আমানত থেকে আয় হওয়া বাড়তি টাকা যাতে অপচয় না হয়, সে দিকে কড়া নজর রাখা জরুরি।

• খুব হিসেব কষে ওই অংশটি ফের সঞ্চয়ে লাগালে আখেরে লাভই হবে।

• তা ছাড়া, অনেক সময় নানা কারণে আচমকা টাকার দরকার পড়ে। ফলে হিসেবের বাড়তি থাকা দরকার সেই আপৎকালীন প্রয়োজন মেটাতেও।

বদল জরুরি?

ডেট ফান্ডের তহবিল খাটে মূলত বিভিন্ন ধরনের ঋণপত্রে (সিকিউরিটিজ)। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি ঋণপত্র (গভর্নমেন্ট সিকিউরিটিজ বা গিল্ট), সংস্থার ঋণপত্র (কর্পোরেট বন্ড), ডিবেঞ্চার, ডিপোজিট সার্টিফিকেট ইত্যাদি। ফান্ডের আয়ের উৎস মূলত দু’টি— সেটি যে ঋণপত্রগুলি কিনেছে তার থেকে নির্দিষ্ট হারে প্রাপ্য সুদ ও ঋণপত্রগুলির লেনদেন। কিন্তু এই মুহূর্তে বাজারে সুদ বাড়ায় বেশ বেকায়দায় ঋণপত্র ভিত্তিক ফান্ডে (ডেট ফান্ড) লগ্নিকারীরা। কারণ—

সাধারণ নিয়ম: বাজারে সুদ বাড়লে হাতে থাকা ঋণপত্রের দাম কমে। আর কমলে, উল্টোটা।

কেন? ধরা যাক, ১০% সুদে ১০০ টাকার (ফেস ভ্যালু) একটি বন্ড কিনল ফান্ড। পরের দিনই বাজারে সুদের হার বেড়ে দাঁড়াল ১৫%। তার মানে এ বার ১০০ টাকার কম লগ্নি করেই বছর শেষে ১১০ টাকা পাওয়া যাবে। তা হলে ওই বন্ড আর লোকে ১০০ টাকায় কিনবে কেন? তাই স্বাভাবিক ভাবেই দর পড়ে যাবে তার। আবার বাজারে সুদ কমলে, দাম চড়বে ওই বন্ডেরই। এখন যেহেতু বাজারে সুদ বাড়তির দিকে, সেহেতু বন্ডের দাম কমছে। আর বন্ডের মূল্য কমায় এই ধরনের ফান্ডের তহবিলে তার প্রভাব পড়ছে। মার খাচ্ছে
সাধারণ মানুষের লগ্নি।

অতএব খেয়াল রাখতে হবে—

• ব্যাঙ্কে সুদ বাড়ায় হাতে থাকা ফান্ডের রিটার্নে প্রভাব পড়ছে কতটা।

• তেমন হলে কথা বলতে হবে ফান্ড ম্যানেজারের সঙ্গে।

• লোকসানের ধাক্কা বেশি হলে ডেট ফান্ডে আপাতত লগ্নি কমিয়ে, ফিক্সড ডিপোজিটের মতো স্থায়ী আয়ের সঞ্চয়ে অন্তত কিছুটা তহবিল সরানো যেতে পারে। যাতে রিটার্নের ক্ষেত্রে বাজারের ঝুঁকি এখন অন্তত কিছুটা কমে। কারণ আগামী দিনে আরও সুদ বাড়বে কি না জানা নেই।

সে ক্ষেত্রে ফান্ডের রিটার্ন আরও কমার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। স্থায়ী আমানতে কিছুটা বাড়তি টাকা রাখলে অন্তত রোজগারের একটা অংশ সম্পর্কে নিশ্চিত থাকা যাবে। বিশেষত সুদ যেখানে এখন একটু হলেও বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

তবে মাথায় রাখুন

সঞ্চয়ে তাড়াহুড়ো করা কাজের কথা নয়। কয়েকটি বিষয়ে অবশ্যই সচেতন থাকা জরুরি। যেমন—

• সিদ্ধান্ত যেন আবেগের বশে হুট করে নেওয়া না হয়। বরং ভেবেচিন্তে হিসেব কষে পদক্ষেপ করা ভাল। তহবিল সরানোর আগে রিটার্ন, ঝুঁকি ইত্যাদির হিসেব যেন পরিষ্কার থাকে।

• লগ্নিকারী কতটা ঝুঁকি বইতে চান, তার উপরে নির্ভর করবে পদক্ষেপ। যেমন, ব্যাঙ্ক জমায় রিটার্ন নিশ্চিত। আগে থেকে তা জানাও যায়। ঝুঁকি কম। তেমনই আবার শেয়ার বা ইকুইটি ফান্ডের মতো রিটার্ন এখানে আশা করতে পারবেন না। সে কথা মাথায় রাখুন। লক্ষ্য যেন স্থির থাকে।

• কতটা তহবিল এক লগ্নি থেকে আর একটিতে সরাতে হবে, সেই সিদ্ধান্তও নেওয়া দরকার ভেবেচিন্তে। না হলে বার বার লগ্নির জায়গা পাল্টাতে হবে।

• কর সংক্রান্ত হিসেবও করা জরুরি।

লেখক: মিউচুয়াল ফান্ড বিশেষজ্ঞ

(মতামত ব্যক্তিগত)

পরামর্শের জন্য লিখুন:

‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ,

আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১।

ই-মেল: bishoy@abp.in

ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Interest Investment Mutual Fund
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE