মেট্রো যে কত সময় বাঁচায়। সেই তাকে আমরা কতই না গাল মন্দ করি!
ভাড়া বাড়ানো দরকার। যেন ভাড়া বাড়ালেই সব্বাই হাসিমুখে মেনে নেবেন। মেট্রোর যাত্রীরা যেন আজকাল কেমন হয়ে গিয়েছে। কী সব মন্তব্য! ‘এক্কেবারে যেন বনগাঁ লোকাল।’ ভাবখানা এমন, যেন বনগাঁ লোকালে কোনও সভ্য লোকজন যাতায়াত করেন না। ‘কেন ইনফ্রাস্ট্রাকচার না বাড়িয়ে উত্তরে আর দক্ষিণে ষ্টেশন বাড়িয়ে দিল।’ ‘বেশ তো চলছিল দমদম থেকে টালিগঞ্জ অবধি।’ যেন সব সুবিধা একাই ভোগ করবে। দু’এক জন হয়তো বললেন, ‘এতে তো ওই সব অঞ্চলের বাসিন্দারা উপকৃত হচ্ছেন।’ অমনি হাউমাউ করে সম্মিলিত জনতা তাঁদের থামিয়ে দিলেন। এ ধরনের একাত্ম বোধ সাধারণত দুর্বলের বিরুদ্ধেই হয়ে থাকে। দেখবেন, আসল প্রতিবাদের ক্ষেত্রে এদের উপস্থিতি অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। জমে ওঠে তর্ক-বিতর্ক রোজ রোজ। কিন্তু, এ সব চলে স্বল্প সময়ের জন্য। যে যার গন্তব্যে পৌঁছে ওটা শিকেয় তুলে রাখেন পরের বারের জন্য। মাটির নীচে দিয়ে, উপর দিয়ে— শহরের বিভিন্ন প্রান্ত ছুঁয়ে পরিষেবা চালাচ্ছে কলকাতার এই গর্ব।
ইদানীং, অনেকেই ভারতের সঙ্গে অন্যান্য দেশের তুল্যমূল্য বিশ্লেষণে বসেন। কিন্তু, আমাদের এই ‘পোড়া’ দেশে সব কিছু লুটেপুটে খেয়েছে তো অনেকেই। শুধু পার্থিব ধনসম্পদ নিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, চরিত্রের ভেতরটাও অনেক ক্ষেত্রে চুরি করে নিয়ে গেছে। এ সব কথা কে কাকে বোঝাবে! যাঁরা বোঝেন না, তাঁদের বোঝাবার চেষ্টা করতে গেলেই নানা ভাবে পিছিয়ে আসতে হয়। আর যাঁরা বুঝে গিয়েছেন, তাঁরা চির কালই অন্যের খুঁত ধরে বেড়ান। এক বারও বলেন না যে, চলুন আমরা চেষ্টা করি। একটা সমাধান বের করি।
উত্তর থেকে দক্ষিণের যোগাযোগ হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। দক্ষিণ কলকাতায় আড্ডা মেরে উত্তরের ডেরায় ফেরা একদম জলভাত। মনে হয় যেন পাশের পাড়ায় ঘুরতে গিয়েছি। আমি তো লোকজনকে জিজ্ঞাসা করি, ‘‘তোর বাড়ি থেকে মেট্রো স্টেশন কত দূর?” বন্ধুরাও জানে, যে কোনও একটা মেট্রো স্টেশনে আমাকে নামিয়ে দেয়। তাতে সময়ও বাঁচে। হর্ন নেই, অহেতুক ব্রেক কষে বাসের ঝাঁকুনি নেই। তবুও মেট্রো গালি খায়, আসতে যেতে। বেচারা! এখন তো বেশ কিছু মেট্রো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, হাল্কা সুরের গান বা যন্ত্র সঙ্গীত— এ সবই আছে। পুজোয় ঠাকুর দেখা, ভরসা সেই মেট্রো। বন্ধের দিনে, বৃষ্টির দিনে— মেট্রোই সব কিছুর মুশকিল আসান। তবে যে দিন মেট্রো বিগড়ায়, ভোগান্তি আর কাকে বলে!
আমার দৈনন্দিন জীবন মেট্রো ছাড়া অচল। গাড়ি যত বেশি, রাস্তা তত কম। আমার বাড়ি থেকে অফিস মেট্রোতে পনেরো মিনিট, বাসে এক ঘণ্টা, ড্রাইভ করে গেলে পৌনে এক ঘণ্টা লাগে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট করে দু’বারে আমি দেড় ঘণ্টা সময় বাঁচাই আর অনেক কাজ সারি। মেট্রো না থাকলে উত্তর থেকে গিয়ে দক্ষিণের সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে তালিম নেওয়ার কথা ভাবতেই পারতাম না। সবই অফিস ছুটির পর। অনেক দিন এমনও হয়েছে যে, রবীন্দ্র সদনে অনুষ্ঠানের পর আবার অফিস ফিরে গিয়েছি বাকি কাজ শেষ করতে। আমার মতোই অনেকেরই জীবন যাপনের সঙ্গে মেট্রো এক অপরিহার্য অংশ হিসেবে জড়িয়ে গিয়েছে। তবুও বেচারা গালমন্দ খেয়েই মরল।
মাঝে মাঝে মেট্রো বিগড়ে যায় আর তখনই আমাদের হাতে হ্যারিকেন অবস্থা! তেমনই এক দিনের ছবি—
গুরুজির কাছ থেকে তালিম নিয়ে টালিগঞ্জ থেকে মেট্রোয় চেপেছি সে দিন। রবীন্দ্র সরোবরে এসে শুনলাম, ‘ময়দানে একটি মেট্রো যান্ত্রিক বিভ্রাটের দাঁড়িয়ে আছে। আর সে কারণে সাময়িক ভাবে মেট্রো পরিষেবা বন্ধ আছে।’ অপেক্ষা করলাম কিছু ক্ষণ। তার পর আস্তে আস্তে উপরে উঠে এলাম। ট্যাক্সি যেতে চাইছে না। যদিও বা এক দু’জন যাবে বলছে, বাড়তি ভাড়া দাবি করছে। খানিক ক্ষণ উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করার পর আমার বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া একটা রুটের বাস পেলাম। কেন্দ্রীয় প্রকল্প জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিন্যুয়াল মিশন (জেএনএনইউআরএম)-এর বাস। আমাদের কাছে ‘জুনু রামের’ বাস। এ ধরনের বাসের ভেতরটা প্রশস্ত থাকে বলে, মনে মনে একটু আস্বস্ত হলাম যে, চিঁড়ে-চ্যাপটা হলেও শ্বাস নিতে পারব।
বাসের পাদানিতে পা রাখতেই কন্ডাক্টর হেঁকে একদম বাসের শেষ প্রান্তে পাঠিয়ে দিয়ে আপন মনে গাদাগাদি যাত্রী বোঝাই শুরু করল। তার সঙ্গে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো এক একটা সিগন্যালের আগে ঠিক অঙ্ক কষে দাঁড়িয়ে পড়ছে। কাজেই অতিষ্ঠ যাত্রীদের সঙ্গে কন্ডাক্টরের তুমুল বচসা। চার-পাঁচ অক্ষরের গালিগালাজের প্রতিযোগিতার মাঝেই বাস সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে গজেন্দ্র গমনে এগোতে লাগল উত্তর থেকে দক্ষিণে। আর এক একটা মেট্রো স্টেশন থেকে জন সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বাসের দেওয়ালে।
যাত্রীরা আর কেউ নামছেন না। বাসে ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা যেন পাথর হয়ে গিয়েছে! শোভাবাজারের কাছে আসতে লটারি পাওয়ার মতো আমার সামনের ভদ্রলোক উঠে পড়লেন আর আমিও হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো তাতে বসে হাঁপ ছাড়লাম, অনেক দীর্ঘ শ্বাসের মাঝে।
এর প্রায় আধ ঘণ্টা বাদে আমি আমার গন্তব্যে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত সওয়া ১০টা। প্রায় দু’ঘণ্টা খামোখা নষ্ট হল। পরে ভাবলাম, যখন মেট্রো ছিল না, তখন এমন কত সময় নষ্ট হয়ে যেত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy