Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

যত দিয়েছে, নিয়েছে তার অনেক গুণ

ভাবনার বাঁধনে ধরা পড়ি আমি। সেই কিশোরীবেলা থেকে এই ষাটোর্ধ্ব বয়স পর্যন্ত চির চেনা কলকাতা সত্যিই দু’হাত ভরে অনেক কিছুই দিয়েছে আমাকে। কলকাতাতে আমাদের পড়াশোনা, দিনযাপন ও বড় হয়ে ওঠা। এখন সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে এত কিছু পরিবর্তন এ শহরের বুকে দেখলাম যে, সে কথা মননের কোণে খালি অনুরণন তোলে।

মঞ্জুশ্রী দাস
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

ভাবনার বাঁধনে ধরা পড়ি আমি। সেই কিশোরীবেলা থেকে এই ষাটোর্ধ্ব বয়স পর্যন্ত চির চেনা কলকাতা সত্যিই দু’হাত ভরে অনেক কিছুই দিয়েছে আমাকে। কলকাতাতে আমাদের পড়াশোনা, দিনযাপন ও বড় হয়ে ওঠা। এখন সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে এত কিছু পরিবর্তন এ শহরের বুকে দেখলাম যে, সে কথা মননের কোণে খালি অনুরণন তোলে।

সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ব্ল্যাক আউট, জানলায় ঘষা কালো কাচ, মিলিটারির বুটের আওয়াজ আর বাবার জন্য মায়ের অধীর অপেক্ষা— সব কিছু যে এই কলকাতারই বুকে। এ শহর তখন স্বাধীনতার দামাল নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে দাঙ্গা আর দুর্ভিক্ষের অসহ্য জ্বালা সহ্য করে শরণার্থীদের বুকে টেনে নিচ্ছে। তখন আমার এক জেঠতুতো দাদা আর দিদি সৈয়দপুর থেকে আসার সময় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। বাকিরা দাঙ্গায় খুন হয়। সেই দাদা আর দিদি চারা গাছের মতো ঠাঁই পায় কলকাতার বুকে।

আমি তখন বেলগাছিয়ার রেল কোয়ার্টার থেকে দু’বিনুনি ঝুলিয়ে সরস্বতী স্কুলে পড়তে যাই। দাদা, ছোড়দা মনোহর অ্যাকাডেমির ছাত্র। বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপো, পরেশনাথের মন্দির, অদূরে গঙ্গা— সবই কি সেই আগের মতন আছে? না, নেই! কলকাতা যে বদলাচ্ছে! কত নতুন উড়ালপুল, বিদ্যাসাগর সেতু, মিলেনিয়াম পার্ক, সল্টলেক সিটি সেন্টার সবই তো নতুন হল। কত অদলবদল হল নিউ মার্কেটের। কিন্তু, যে দিন বাবা আমায় হগ মার্কেটের রহমানের দোকান থেকে একটা সিল্কের জামা কিনে দিয়েছিল— সেই দিনটা আজও আমার কাছে মনে হয় নতুন। পিছন ফিরে দেখলে ফিপরো-র কেক খেয়ে বড়দিনে যে রোমাঞ্চ পেতাম তা আজ গঙ্গাবক্ষে চলমান রেস্তোরাঁয় বসে বা ঝাঁ চকচকে কোনও মলের খাবারে পাই না।

কেন পাই না? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো এটাই, সব বদল সবাই সমান ভাবে গ্রহণ করতে পারে না! তাই হয়তো চলমান কলকাতাকে আমি আমার শ্লথ পায়ের গতিতে ধরতে পারি না। এ আমারই ব্যর্থতা।

বেলগাছিয়ার লাইনে শান্টিং হচ্ছে। হাতে ধরা পরোটা খেতে খেতে লাইন পার হচ্ছি আমি। পিছনে ঠাকমা— গঙ্গা স্নান করতে যাচ্ছেন আমার সঙ্গে। যে ঠাকমার জন্য আমি অনেকটা বয়স বাড়িতেই পড়েছি, তিনি দেহ রাখলেন এ শহরের বুকে— জীবনে প্রথম পরিচয় হল মৃত্যুর সঙ্গে।

চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে কণ্ঠনালীর ক্যানসারের শেষ স্টেজে বাবা— ক্লাস নাইনের আমি আর আইএসি পরীক্ষা দেওয়া ছোড়দা গিয়েছে দেখতে— সে দিনই শেষ দেখা। বাবার মৃত্যু জীবনের আর এক কঠিন সত্যির সামনে দাঁড় করালো। ভেঙে যাওয়া মন নিয়ে বিধবা মায়ের অসীম লড়াই— সবই এই চিরদেখা, চিরচেনা শহরের বুকে। তাই এই শহরকে আমি এত ভালবাসি।

পৃথিবীর অন্য যে কোনও উন্নত শহরের সঙ্গে এর তুলনা করা বড় কঠিন। রুগ্ন কিন্তু সূক্ষ এর বোধ। নতুন করে ভাবায় সেই কবেকার ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে শোনা ভি বালসারার সুর, সন্ধ্যা, হেমন্ত, মান্নার গান। বেলগাছিয়ার রেল কোয়ার্টারের মাঠে দুর্গাপুজো আর ভানু-জহরের কমিকস— ভাগ্যিস তখন চ্যানেলে চ্যানেলে লাফটার শোয়ের মতো কিছু আবিষ্কার হয়নি— তাই আমি এত ভাল ভাল অনুষ্ঠান ঘুম ঘুম চোখে মায়ের পাশে বসে শুনতাম।

আর যখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ছাত্রী, তখন নতুন করে ভালবেসেছিলাম কলেজ স্ট্রিট ও বইপাড়াকে। বইয়ের পাতার ভোম্বল সর্দার, অপু, কিরীটি, ব্যোমকেশ জ্যান্ত হয়ে ধরা দিত আমার কাছে। কলেজ স্কোয়ারের জলে দামাল ছেলেমেয়েদের সাঁতার দেখতে দেখতে কখন যেন বই শুধু বই হয়ে গেল আমার মনের জানালা। এই সে দিনও ময়দানের বইমেলায় মেয়ের সঙ্গে ধুলো উড়িয়ে বই কিনেছি— যা আজ সত্যিই স্মৃতি। তবু বইকে ভালবাসার মধ্যে দিয়ে কলেজ স্ট্রিট ধরা দিয়েছিল আমার মননে, যা আমায় নতুন করে চিনিয়েছিল বিশ্বকে, এই কলকাতাতেই বসবাস করে।

ইডেন গার্ডেনে টেস্ট ম্যাচ দেখে বড়দার সঙ্গে বেড়িয়ে টিয়ার গ্যাসের কালো ধোঁয়ার মধ্যে পড়ি। আর এ-গলি ও-গলি দিয়ে অনেক রাতে যখন বাড়ি ফিরি। বুঝি কিশোরী আমি যুবতী। এ বার পরের ঘরে যাবার পালা। বিয়ের পর পার্ক-সার্কাসের পুজোয় রমেশ পালের হাতের তৈরি মূর্তি দেখতে দেখতে ঠাকমার কথা মনে পড়ত। ঠাকমা কুমোরটুলির ঠাকুর গড়া দেখতে আমায় নিয়ে যেত, আর কিনে দিত জিবেগজা।

এখনকার কলকাতা শহরের মিষ্টির দোকানে জিবেগজা, রাবড়ি ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ রকম আরও অনেক জিনিসই হারিয়ে গিয়েছে এ শহরের বুক থেকে বিলুপ্ত প্রজাতির মতো। যেমন হারিয়ে গিয়েছে এ শহরের মানুষের মনের সদিচ্ছা আর সাহস। তাই পর পর ঘটে চলে নারীত্বের চরম অপমান। আমি মা হয়েও লজ্জায় মুখ ঢাকি।

ষাটোর্ধ্ব আমি যখন প্রবাসে মেয়ের কাছে যাই বা ভারতের অন্য কোনও শহরে যাই, ফিরে এসে মনে হয় এ শহর বড় বেশি ধূলি-ধূসরিত, বড় মলিন— সতেজতার বড় অভাব। আমার চিরচেনা শহরকে আরও সবুজ করে দেয় যদি কেউ!

কলকাতার সতেজতা মিছিলে নয়, মিটিং-এ নয়, খেলার মাঠে নয়, নাটকে বা পাড়ার মোড়ে নয়— এ শহরের সতেজতা মানুষের মনে, যার আজ বড়ই অভাব।

*****

১৯৪৭ কলকাতার বেলগাছিয়া রেল কোয়ার্টারে জন্ম। স্নাতক হয়েছেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে। বই পড়া ও কবিতা লেখা নেশা।
স্বামীর কর্মসূত্রে সমগ্র ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়ানো আর লেখালেখি করা অন্যতম শখ। এক কালে বিভিন্ন প্যাটার্নের সোয়েটার বোনা
ও টুকিটাকি রকমারি রান্নায় বন্ধুমহলে খুবই পরিচিতি ছিল। আজ শুধু বই আর বই-ই বন্ধু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE