সদ্য বিলেত ফেরত, বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষিত এক বাঙালি যুবক প্রেসিডেন্সি কলেজে অস্থায়ী অধ্যাপকের পদে যোগ দিয়েছিলেন। ‘নেটিভ’ বলেই অন্য শ্বেতাঙ্গ সহকর্মীদের তুলনায় তাঁর বেতন মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ ধার্য্য করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, অস্থায়ী পদ বলে তাঁর বেতন অর্ধেক কেটেও নেওয়া হত। এই অসম্মানের প্রতিবাদে সেই বাঙালি যুবক এক অদ্ভূত পন্থা নিয়েছিলেন। মাইনে বাবদ যে চেক আসত তা তিনি ছুঁতেন না। দীর্ঘ তিন বছর বিনা বেতনে কলেজে কাজ করেছিলেন। অবশেষে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা এই বাঙালি যুবকের তেজস্বিতা ও কমর্নিষ্ঠার কাছে হার মেনেছিল। উপযুক্ত বেতনে স্থায়ী পদে বহাল করে, তিন বছরের প্রাপ্য টাকা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল।
সে দিনের সেই বাঙালি যুবক আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। যিনি বিজ্ঞানের বিশ্ব দরবারে বাঙালির স্বতন্ত্র পরিচয় স্থাপন করেছিলেন।
১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর জগদীশচন্দ্রের জন্ম। তাঁর পৈতৃক নিবাস ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার রাড়ীখাল গ্রামে। এখানেই জগদীশের ছোটবেলা কেটেছিল। তাঁর পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। নানা বিষয়ে উৎসাহী মানুষটি ছিলেন কর্মঠ প্রকৃতির। পাঠশালায় বাংলা শিক্ষা শেষ হলে জগদীশচন্দ্রের বাবা ইংরেজি শিক্ষার জন্য তাঁকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন তিনি। পরে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত করার জন্য ভগবানচন্দ্র ছেলেকে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি করেন। এই সময় জগদীশচন্দ্র হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করতেন।
ছোট থেকেই তিনি বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেছিলেন। তাই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে তাঁকে বেশ কিছু সমস্যায় পড়তে হয়। প্রথম প্রথম ঠাট্টা-টিটকিরিও শুনতে হয়েছিল। ষোলো বছর বয়সে জগদীশচন্দ্র এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। এই সময়ে তিনি ফাদার লাফঁ-এর সংস্পর্শে এসেছিলেন। মূলত তাঁর কারণেই জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়।
১৮৯৯ সালে এফএ এবং ১৮৮০তে বিজ্ঞান শাখায় বিএ পাশ করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসে জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হবেন। কিন্তু, বাবার আপত্তি থাকায় তা সম্ভব হয়নি। ভগবানচন্দ্র চেয়েছিলেন ছেলেকে বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য বিলেত পাঠাতে, যাতে ফিরে এসে জগদীশচন্দ্র দেশের কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি করতে পারেন। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত এই সময় পিতৃঋণ তাঁর মাথায় চেপেছিল। এবং বিলেত যাত্রার ক্ষেত্রে তাঁর মা প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ান।
পরে অবশ্য মায়ের অনুমতি পেয়ে ডাক্তারি পড়ার জন্য জগদীশচন্দ্র বিলেত যাত্রা করেন। এই সময় তিনি বার বার কালাজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছিলেন। লন্ডনে পৌঁছে ডাক্তারি পড়া শুরু করলেও শব দেহ ব্যবচ্ছেদের সময়ে কটু গন্ধ তাঁকে কাবু করে ফেলত। এর দরুণ তাঁর প্রবল জ্বর আসত। এমন এক পরিস্থিতিতে তিনি ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। এখানে পড়াকালীন পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও উদ্ভিদবিদ্যার প্রতি তাঁর আকর্ষণ বাড়ে। অধ্যাপকদের মধ্যে মাইকেল ফস্টর ভাইনস, ফ্রান্সিস ডারউইন এবং লর্ড রালে জগদীশচন্দ্রকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। এখানে চার বছর পড়ার শেষে তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে ‘ট্রাইপস’ এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন।
বাঁ দিক থেকে জগদীশচন্দ্র বসু, লোকেন্দ্রনাথ পালিত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শুরু হল ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা তাঁর কর্মজীবন। দেশে ফিরে একটি পরিচয়পত্র নিয়ে তিনি তৎকালীন বড়লাট লর্ড রিপনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এর প্রেক্ষিতে লর্ড রিপন বাংলার সরকারকে চিঠি দিয়ে সুপারিশ করেছিলেন তাঁর চাকরির জন্য। তবুও বাংলার শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর তাঁর নিয়োগ নিয়ে দেরি করতে লাগলেন।
এর পরে জগদীশচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে অস্থায়ী অধ্যাপকের পদে যোগ দিলেও অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করে তিন বছর বিনা বেতনে কাজ করেছিলেন। পরে তিনি মাইনে বাবদ যে টাকা পেয়েছিলেন তা দিয়ে পিতৃঋণ শোধ করেছিলেন।
জগদীশচন্দ্রের জীবনের সুখ-দুঃখের যথার্থ সঙ্গী ছিলেন তাঁর স্ত্রী অবলা বসু। ১৮৮৭তে তাঁদের বিয়ে হয়। জগদীশচন্দ্র যত বার বিদেশ গিয়েছেন, তিনিও সঙ্গে ছিলেন।
জগদীশচন্দ্রকে সে কালে প্রেসিডেন্সি কলেজে সপ্তাহে ২৬ ঘণ্টা পড়াতে হত। এ ছাড়াও তিনি ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। আজকের দিনে ভাবতেও অবাক লাগে যে, বেতন ছাড়া জগদীশচন্দ্র তাঁর গবেষণার জন্য কোনও প্রকার সরকারি সাহায্য পাননি। প্রথমে জগদীশচন্দ্র বৈদ্যুতিক গবেষণায় মগ্ন ছিলেন। ১৮৯৫তে তাঁর প্রথম প্রবন্ধ ‘রিফ্র্যাকশন অব ইলেকট্রিক রেজ’ এর পরে কয়েকটি প্রবন্ধ বিখ্যাত ‘ইলেকট্রিশিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে তিনি যে প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলেন তা, হয়ে উঠেছিল এক ইতিহাস। পরে অবশ্য জগদীশচন্দ্রের বিশ্বজোড়া খ্যাতি দেখে ভারত সরকার তাঁকে বছরে আড়াই হাজার টাকা গবেষণার জন্য বরাদ্দ করেছিল।
এর পরে তিনি বিনা তারে টেলিগ্রাফ যন্ত্রের উদ্ভাবনে মগ্ন হয়ে পড়েন। এই সময় বিশ্বের মাত্র তিন জন মানুষ এই নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলেন। আমেরিকায় লজ্, ইতালিতে মার্কনী আর ভারতে জগদীশচন্দ্র। তাঁর ছোট যন্ত্রের সাহায্যে নিজের বাড়ি থেকে এক মাইল দূরে কলেজের সঙ্গে বিনা তারে সঙ্কেত আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। কিন্তু, এরই মাঝে বিদেশযাত্রার ডাক আসায় সেই কাজ অসমাপ্ত রয়ে যায়। শোনা যায়, জগদীশচন্দ্রের এক মার্কিন বন্ধু তাঁর এই আবিষ্কার নিজের নামে পেটেন্ট করে নিয়েছিলেন। জগদীশচন্দ্র এর কোনও প্রতিবাদ করেননি।
১৮৯৬ সাল নাগাদ গবেষণার প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর ইউরোপে যাওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। প্রথমে বাংলার গভর্নর তাতে সম্মত না হলেও, পরে তিনি সম্মতি দেন। সেখানে পৌঁছে লিভারপুলে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে তিনি বক্তৃতা দেন তিনি। এই সময় লন্ডনের বৈজ্ঞানিক মহলে জগদীশচন্দ্রকে নিয়ে একটা সাড়া পড়ে যায়। এ ছাড়াও রয়্যাল ইনস্টিটিউটের বিখ্যাত শুক্রবারের বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এখানে থাকাকালীন দেশে একটি বিজ্ঞান মন্দির স্থাপনের ইচ্ছে জেগেছিল তাঁর মনে। ১৮৯৭তে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
গবেষণাগারে জগদীশচন্দ্র।
পরে ১৯০০ তে আবার প্যারিস থেকে নিমন্ত্রণ পত্র আসে আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ্যা বিষয়ক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য। নানা প্রকার লাঞ্ছনা সহ্য করে শেষমেশ তিনি প্যারিস গিয়েছিলেন। প্যারিসের এই প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। দু’জনের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়। আবিষ্কারগুলির প্রচারের জন্য তিনি ইউরোপ যান ১৯০৭-এ । এ বার তিনি সেখান থেকে আমোরিকাও যান।
১৮৯৭ সালে জগদীশচন্দ্র যখন তাঁর প্রথম বিলেত সফর শেষে দেশে ফিরেছিলেন, এক দিন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অভিনন্দন জানাতে আসেন। দু’জনের মধ্য নিবিড় শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে থাকতেন, মাঝে মাঝে জগদীশচন্দ্র সেখানে দু’-চার দিন ছুটি কাটিয়ে আসতেন। সিস্টার নিবেদিতার সঙ্গেও তাঁর এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। শুধু বিজ্ঞান নয়, দেশের শিল্প, সাহিত্য এবং ঐতিহ্যের প্রতি জগদীশচন্দ্রের সমান আকর্ষণ ছিল। শোনা যায়, প্রতি বছর দু’বার তিনি সস্ত্রীক ভারতের নানা তীর্থ, গুহা, মন্দির এবং ঐতিহাসিক জায়গায় বেড়াতে যেতেন। বদ্রীনাথ ও কেদারনাথ বেড়ানোর সময় সিস্টার নিবেদিতা তাঁদের সঙ্গী হয়েছিলেন।
১৯১৭ তে তাঁর দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’-এর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তেমনই বহু চেষ্টার পরে অবশেষে ১৯১৮ তে গড়ে উঠেছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের একটি বড় ল্যাবরেটরি। জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কারগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ‘বৈদ্যুতিক তরঙ্গ উৎপাদন ও তার অস্তিত্ব নির্ধারণ’, ‘অদৃশ্যালোকের স্বরূপ নির্নয়’, ‘বেতার বার্তাবহ’, ‘উদ্ভিদের হৃদ্কম্পন’ ইত্যাদি।
১৯৩৭-এর ২৩ নভেম্বর গিরিডিতে তাঁর মৃত্যু হয়। পর দিন কলকাতায় তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy