Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

অভিনেত্রী না হয়ে শেষে হলাম বাচিক শিল্পী

বেশ রাত। আকাশবাণীর ‘আজ রাতে’ অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফিরছিলাম। একবারে ফাঁকা রাস্তা ধর্মতলা থেকে বাঁক নিতেই মনে হল এ শহরকে কি সবটা চিনি— রাতের আলোয় মনে হচ্ছিল ‘রোমের টার্মিনি’ কিন্তু না এ শহর তো আমার শহর কলকাতা।

মধুমিতা বসু
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০২
Share: Save:

বেশ রাত। আকাশবাণীর ‘আজ রাতে’ অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফিরছিলাম। একবারে ফাঁকা রাস্তা ধর্মতলা থেকে বাঁক নিতেই মনে হল এ শহরকে কি সবটা চিনি— রাতের আলোয় মনে হচ্ছিল ‘রোমের টার্মিনি’ কিন্তু না এ শহর তো আমার শহর কলকাতা।

মাঝে মাঝে শহরটা এমনি করেই চমকে দেয়। নতুন করে দেখতে দেখতে শেখায় আর পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমার শহর কলকাতা। গানের পরিভাষায় বলতে ইচ্ছে করে আমার শহর আমার সবটুকু জানে। সত্যিই জানে। এ শহরে এসেছি আমি বিয়ের পরে অর্থাৎ নতুন বউ হিসেবে। আজ ভাবতেই অবাক লাগে এই শহর, আমার শহর বদলে দিয়েছে আমার সব কিছু। আমার এই ‘আমি’ হয়ে ওঠা, তার পুরো কৃতিত্বই আমার শহরের।

বিয়ের আগে থাকতাম ইছাপুরে। তখন নিয়ম করে শহরে বেড়াতে আসতাম। কিন্তু বিয়ের পর পাকাপাকি টালিগঞ্জ ‘ম্যুর অ্যাভিনিউ’তে আমার শ্বশুরবাড়িতে চলে আসি। আর আমার জীবনের চাকাটাই শহরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বদলাতে শুরু করে। এই শহরের সংস্কৃতির আঙিনায় প্রথম প্রবেশ।

শহরে পা দিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই পাড়াতে ‘আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিলাম এবং তাতে প্রথম হই।’


মঞ্চে শিল্পী।

হঠাৎ জীবনে এল বেশ নতুন মোড়। আমি এবং আমার পরিবারের সকলের ধারণা হল আমি পারব। দক্ষিণ কলকাতা থেকে সোজা উত্তর কলকাতা। জোঁড়াসাকো ঠাকুর বাড়িতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যাল নাটক নিয়ে এম এ পড়তে ভর্তি হয়ে গেলাম। সেখানে। তখনও মেট্রোরেল দমদম পর্যন্ত হয়নি তাই এসপ্ল্যানেড/ ধর্মতলা থেকে বসে যাওয়া আসা। বেশি বৃষ্টি হলেই উত্তর কলকাতায় জল জমে যেত। গালে হাত দিয়ে বাসেই বাসে থাকতাম।

বাড়ির গণ্ডি পার হয়ে বেরোতেই চোখের সামনে শহরের ছবিটা ধরা পড়তে লাগল। আমার শহরে আছে ভিড়, যানজট, রাস্তার ওপরে প্রচুর দোকান, বহু মানুষের যাতায়াত তবু এ শহর তো আমার শহর, বেশ অবাক লাগে। আমার শহরের এত নাম, এত নামী মানুষ। অথচ আমি তো প্রথম প্রথম কাউকেই চিনি না কারণ সাংস্কৃতিক জগতে আমার পারিবারিক কোনও পরিচিতি নেই। তাই জীবনের এক-একটা দিকে এগোতে এগোতেই আমার এই উত্তরণ চেনাশোনা পরিচিতি।

আজও মনে পড়ে এ শহরে এসে প্রথম যে বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল বস্তুত প্রয়োজনেই আলাপ করতে গিয়েছিলাম। তিনি সংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী। রেডিওতে নাটকের অডিশান দেব তাই বই চাইতে গিয়েছিলাম। তখন তো মানে প্রায় ২৭ বছর আগে জেরক্স নেই তাই তাঁর বাড়ি বসে লিখে নিয়ে আসতে হয়েছিল ব্যস তার সঙ্গে প্রথম দিনেই আলাপ চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছিল।

প্রথম প্রথম সল্টলেকের দিকটা বেশি খালি খালি ছিল একা একা যাওয়া আসা করতে হত। তখন খোলামঞ্চে অনেক বেশি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে যেতাম। সকলেই বলত একা একা যাচ্ছ, ভয় করে না আমি শুধু বলতাম, গাড়ি তো আছে ভয় পাব কেন। সত্যি আজ পর্যন্ত তো কোনও অসুবিধে হয়নি।


সুমিত্রা সেনের সঙ্গে।

এই শহরের সঙ্গে জীবনটা এমন ভাবে জড়িয়ে গেছে, তার বেরোবার পথ নেই। যেখানেই যাই না কেন দেশে/বিদেশে যখনই দমদম এয়ারপোর্ট (ও নতুন নামটাই বলি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) বা হাওড়া শিয়ালদহ রেলস্টেশনে পৌঁছে যাই তখম যে কী একটা আনন্দ হয় বোঝাতে পারব না।

আমার জীবনের অনেকগুলো আনন্দধারার সঙ্গে জুড়ে আছে এই শহর। আজ আমার গতি পরিচিতি যা হয়েছে শ্রুতি নাটকের জন্য আর মঞ্চে সঞ্চালনার জন্য—সেখানেও তো আমার শহর, অভিনেতা বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রথম শ্রুতিনাটক করতে শুরু করি। এই শহরেই সুতানটি পরিষদের অনুষ্ঠানে। আজ তো শহরময় কত অনুষ্ঠানই করে থাকি। তবু সে দিনটার কথা বারবার মনে পড়ে কারণ শুরুটা যে এই শহরে।

প্রথম রবীন্দ্রসদন মঞ্চে অনুষ্ঠান শহরের ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান। আমার কাছে মন্দির। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে কখন যে এত কথা বলতে শিখলাম মনেই পড়ে না। কত মানুষ যে বার বার জানতে চাইছে আপনি কী ভাবে মন থেকে এত কথা বলেন—আবার কেউ লিখে রাখেন আমার বলা কথাগুলো।

এই শহরই আমাকে আমার নামে পরিচিত করিয়ে দিল। সে দিন বন্ধুদের বলছিলাম—দেখো সংযোজন করি অর্থাৎ অন্যের নাম বলি অন্যের নাম বলতে বলতেই নিজের নাম হয়ে গেল। আর কী চাই।

প্রতিদিন সকালে উঠেই আমরা পাওয়া আর না পাওয়ার হিসেব করি। কিন্তু যখন শ্রাবণী সেনের মতো একজন গুণী সঙ্গীতশিল্পী আমার সাংস্কৃতিক জীবনের ২৫ বছর পালনের উদ্যোগ নেন আর তা সফল করে তোলেন তার তো সাক্ষীও রইল এ শহর।

প্রচুর ভালবাসা পেয়েছি এ শহরের মানুষের কাছে। শিল্পী বন্ধু দাদাদিদিরা তো আছেই সর্বোপরি সাধারণ মানুষ আমাদের শ্রোতা বা দর্শক কী ভালবাসেন— ভাবুন তো এ শহরে না এলে এ সব জুটতো কপালে?


আড্ডা: অপরাজিতা আঢ্য, লীনা গঙ্গোপাধ্যায় এবং মধুমিতা বসু।

আজ আমাকে বেশি লোকই চেনেন বাচিক শিল্পী হিসেবে। অথচ আমার কাজ করার গল্প কিন্তু অন্য রকম। আমি বাংলা ছবিতে প্রচুর ডাবিং করতাম। অ়ঞ্জন চৌধুরীর কথা খুব মনে পড়ছে ওঁর ছবিতে ডাবিং করেছি আর বাংলা ধারাবাহিক মামা ভাগ্নেতে অভিনয়ও করেছিলাম রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে।

আর বেশ কয়েকটি বাংলা ছবি ও বাংলা ধারাবাহিকে কাজ করেছিলাম হরনাথ চক্রবর্তীর প্রথম ছবি তাতেও অভিনয় করি। খুব বন্ধুত্ব ছিল সকলের সঙ্গে, তাই কারও ছবি বা বড় কোনও অনুষ্ঠান হচ্ছে বেশ সবাই মিলে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তাম। অদ্ভুত একটা সম্পর্ক ছিল মানুষে মানুষে। এখন বাঁধন একটু ঢিলে হয়েছে। যত না বেশি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ তার চাইতে মোবাইল ফেসবুকে বেশি যোগাযোগ। বিজ্ঞান এমনই জিনিস যার খুব দ্রুত পরিবর্তনের ফলে এমনটা তো হবেই।

এ শহরে বেড়ে ওঠা নয় বস্তুত আমার বড় হয়ে ওঠার পিছনে দূরদর্শনের ভূমিকাও কম নয়। শুধু দূরদর্শন নয়, ওখানে উচ্চপদে আসীন মানুষদের ভূমিকা। তারা অনায়াসে বুঝেছিলেন আমার কাজের ইচ্ছে আছে চেষ্টা আছে। সব সময় আমাকে এগিয়ে দিয়েছেন কত মানুষের নাম করব। যেন একটা পরিবার। আজ এই পরিবার প্রথাটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সর্ব ক্ষেত্রে। এত কিছুর পরেও তারা-র ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে’ সঙ্গে তৈরি হয়েছে বন্ধুত্ব। এ শহরে বসেই পৌঁছে যাই বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শহরে।

কোনও দিন নির্দিষ্ট করে ভাবিনি বা ভাবতে শিখিনি যে কী করব। উপায়ও ছিল না। কিন্তু শহরের জ্ঞানী গুণী মানুষের সংস্পর্শ আমার ধারণাগুলো বদলে বদলে দিয়েছেন। তাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন বলেন যে শেষের কবিতায় ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ কবিতাটি তুমি পড়বে মানে লাবণ্য—তখন আনন্দ অহংকার দুটোই হয়।

প্রথম থেকেই বুঝতাম যে কালচারাল ফিল্ডের সব ধরনের লোকেদের সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব হয় আর তারা খুব ভালবাসেন। অভিনয় না করলেও অভিনয় জগতের বড়ছোট প্রায় সকলেই চেনেন, আড্ডা দিতে ভালবাসেন। তখন বুঝেছিলাম শিল্পের কোনও ভেদাভেদ নেই।

‘বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর’ সঙ্গে কাজ করার সুবাদে শহর, শহরের মানুষদের আরও নতুন করে চিনতে শিখছি—পুজোর সময় এত ভিড় হইচই গাড়ি আর চলে না। অনুষ্ঠানের সময় হয়ে গেছে। আমি বেশ বিরক্ত প্রকাশ করছি দেখে উনি বললেন দেখো লোকেদের কী অনাবিল আনন্দ চোখেমুখে। ভিড়ের মধ্যে তো এটাই তো পাওয়া।

এ শহরের আন্তরিকতা খুব। সামান্য খরচে জীবনধারণ করা যায় বলে দেশ বিদেশের বহু মানুষ এ দেশে চলে আসেন অনায়াসে। তবুও মনে হয় আমাদের অনেক আগে থেকেই যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল, তা হলে এতটা খারাপ হত না।


দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শিল্পী।

এখন অবশ্য উন্নতির চেষ্টা হচ্ছে। দেশবিদেশের কথায় মনে পড়ল প্রথম ‘বিদেশযাত্রা’ও এ শহর থেকে। রবিঠাকুরের সহযোগী শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ওপর অনুষ্ঠান করতে আমি, আশিস ভট্টাচার্য, সুছন্দা ঘোষ সকলে মিলে বাংলাদেশে যাই। আবার ইউরোপ গিয়েও বারবার মনে হয়েছে এই শহরের সঙ্গে মিল কোথায়। একটা জায়গাতে প্রথম হেরে যেতে হয় তা হল শহরের জনসংখ্যা। এত বেশি জনসংখ্যা যে ভাল কিছুই চোখে ধরা পড়ে না। তবুও এ শহর আমার সব কিছু। ট্রামে চড়ে উদাস দৃষ্টিতে ঘুরে বেড়ানো, গড়িয়াহাটের মার্কেটিং, ফুচকা খাওয়া আর অনুষ্ঠানে মঞ্চের অত লোকের কাছাকাছি চলে যাওয়া কোনওটাই কি সম্ভব হত এ শহরে না থাকলে।

তবে যে কথা বলতেই হয়, রাস্তাঘাটের পরিচ্ছন্নতা আরও বাড়াতেই হবে। বিদেশের সঙ্গে তুলনা করা বৃথা, তবে আজও চেষ্টা করলে আমরা যে নতুন করে গড়ে নিতে পারি এ শহরটাকে, সে বিশ্বাস আমার আছে। এক সময় মনে হত ভাল কথা বলেই লোকেদের বদলে দেওয়া যায়। এখন মনে হয় তার সঙ্গে একটু শাসনের প্রয়োজন। এ কথা যত তাড়াতাড়ি হবে ততই ভাল অপেক্ষায় রইলাম। বারবারই মনে হয় শহরটা ভাল হলে আমার ছেলেটাকে আর বিদেশে পড়ে থাকতে হবে না। এ শহরেই থাকতে পারবে। আমার কাছে।

লেখক: বাচিক শিল্পী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE