Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দেশভাগের সেই কান্না ভুলিয়ে দিয়েছে এই শহর কলকাতা

আমার শৈশব যে ঠিক শিশুর সারল্যে কেটেছে এমন নয়। জন্ম হয়েছিল রংপুরে। তখন নেহাত অবোধ শিশু। তবু কোথাও একটা বড় ভাঙচুরের উৎকণ্ঠা যেন আবহাওয়ায় ভাসছিল। তখনও বুঝিনি দেশভাগের মতো একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। বুঝলাম অনতিকাল পরেই, যখন আমরা চলে আসছি এ পারে। সে দিন সেই স্টেশনে, ট্রেন বদলের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বুকভাঙা কান্না আর থামতেই চাইছিল না। হায় এ কোন অভিশাপ? এসে পড়লাম রায়গঞ্জে।

বিজয়লক্ষ্মী বর্মন
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

আমার শৈশব যে ঠিক শিশুর সারল্যে কেটেছে এমন নয়। জন্ম হয়েছিল রংপুরে। তখন নেহাত অবোধ শিশু। তবু কোথাও একটা বড় ভাঙচুরের উৎকণ্ঠা যেন আবহাওয়ায় ভাসছিল। তখনও বুঝিনি দেশভাগের মতো একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। বুঝলাম অনতিকাল পরেই, যখন আমরা চলে আসছি এ পারে। সে দিন সেই স্টেশনে, ট্রেন বদলের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বুকভাঙা কান্না আর থামতেই চাইছিল না। হায় এ কোন অভিশাপ? এসে পড়লাম রায়গঞ্জে। তখন আরও মফসসল। বার তিনেক বাসা বদলের পর নিজেদের বাড়ি হল। বাবা নাম দিলেন ‘হারানো নীড়’। সে বাড়ি তখন একেবারে খোলা মাঠের মাঝখানে। আমার কিন্তু মজাই লাগত। রংপুরে থাকতে বাবার কোলে বসে প্রথম শিক্ষা। তার ভিত যে খুব পাকা ছিল সেটা এখনও বুঝি। ইস্কুলে ভর্তি প্রথম রায়গঞ্জেই। একেবারে ক্লাস ফাইভে। বিস্তর পড়তাম অ-পাঠ্যপুস্তক। বারণ ছিল না কোনও। আর বাবার গলায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা শুনতাম। আমিও বলতাম।


‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ নাটকের একটি দৃশ্যে

এই সুখে, এই নিশ্চিন্তিতে বেশি দিন কাটেনি। বাবা গুরুতর অসুস্থ হলেন। চলে আসতে হল কলকাতায়। কতই বা বয়স তখন আমার। দশে পা দিয়েছি। কিন্তু কলকাতা আমার ঘাড় ধরে শৈশবের চৌকাঠ পার করিয়ে, কৈশোরকে পাত্তা না দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল তারুণ্যের দরজায়। ভর্তি হলাম কলকাতার স্কুলে। জীবন ছুটতে লাগল।

অতঃপর? আমার বাবা-মা দু’জনেই সুন্দর গাইতেন। খুব চেষ্টা ছিল আমাকে গান শেখানোর। কিন্তু গান আমার গলায় নেই। কবিতার চর্চাটা অবশ্য চলত। আর বাবা যে হেতু শয্যাবন্দি, রোজ তাঁকে নানা ধরনের গদ্য-পদ্য-গল্প-প্রবন্ধ পড়ে শোনানো রুটিনের মধ্যে ছিল। আমি তখন দশম শ্রেণি, বাবা মারা গেলেন। আমার তিন ভাই নেহাতই ছোট। মা-র বয়সই বা কত! গান-কবিতা বাবার সঙ্গেই যেন শেষ হয়ে গেল। কোনও মতে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়া।

‘কাছের মানুষ’ নাটকে দেবশঙ্কর
হালদারের সঙ্গে বিজয়লক্ষ্মী।

বেশ অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে গেল। তবে পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে যেমন আমার মায়ের উৎসাহ ছিল, তেমনি ছিল আমার স্বামীরও। তিনিই উপলব্ধি করলেন যে আমি একটু আধটু কবিতা বলতে পারি। শুরু হল চর্চা, প্রতিযোগিতায় নাম লেখানো। তখনই জানলাম এই কবিতা বলা ব্যাপারটার একটা পোশাকি নাম আছে—আবৃত্তি। তখনকার বিখ্যাত আবৃত্তিকারদের কণ্ঠে শুনতে লাগলাম আবৃত্তি। তখন তো ডিস্ক। বাড়িতে রেকর্ড-প্লেয়ারও এসে গেল। এর পর অন্য জীবন।

আগেই বলেছিলাম, কল্লোলিনী কলকাতা আমায় আমূল বদলে দিল। যখন কলকাতার স্কুলে ভর্তি হলাম স্কুলের দিদিমণিরা দেখলেন আমি লেখাপড়ায় মোটামুটি ভাল। ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার যে আমার ইংরেজি জ্ঞানটা ক্লাসের বাকিদের থেকে আরও ভাল। কিন্তু একটা ব্যাপারে বড় পিছিয়ে পড়েছিলাম। লজ্জায় যেন মরে যেতাম। যখন দিদিমণিরা জিজ্ঞেস করতেন, ‘তুমি কোথায় থাকতে এর আগে?’ আমাকে বলতেই হত, ‘রায়গঞ্জে।’ ব্যস, ক্লাস সুদ্ধ হাসির হল্লা। যেন অন্য আজব জগৎ থেকে এখানে এসেছি। শুধু তাই নয়, এর পরে বলা হত, ‘সেটা কোথায়?’ আমি আরও লজ্জায় রাঙা হয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলতাম, ‘পশ্চিম দিনাজপুর।’ আরও হাসির হল্লা। অতএব? এ বার আমাকেও শুরু করতে হল কলকাতার মতো নিজেকে তৈরি করা। হাব-ভাব বদলে ফেলা। জামা-জুতো থেকে কলকাতার স্টাইলে চুল আঁচড়ানো। চুলে তেল না দেওয়া। মানে নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলা। অন্যদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলাম। পড়াশোনার একটু ক্ষতি তো হল বটেই। তবু বলতে দ্বিধা নেই, আমার যা কিছু বৈভব, যা দীনতা, যতটুকু শ্লাঘা এবং গ্লানি, যতটুকু মর্যাদা এবং যত রকম উপেক্ষা— সব আমাকে দিয়েছে এই কলকাতা। এই শহরকে আমি ভালবাসি। যেমন করে ভালবাসার মানুষকে সবাই দ্যাখে তার দোষ-গুণ সমেত, ঠিক তেমনই। কলকাতার নিন্দে অনেকেই করেন, কিন্তু কালোটাই দেখব, ভালটা নয় কেন? আর শহরটার সৌন্দর্যহরণে আমারও কি কোনও দায়ভাগ নেই?


শম্ভু মিত্রের সঙ্গে শিল্পী।

মনে পড়ে, ছেলেবেলায় যখন উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় আসতাম, দেখতে পেতাম ভোরবেলায় রাস্তা ধোওয়া চলছে। উফ্ তখন ওই ময়লা জলের স্রোত দেখে আমার কী যে মন খারাপ হত বোঝাতে পারব না। তখুনি ফিরে যেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু এখন? শহর মিশে গিয়েছে আমার মনে। সে ভাল হোক বা খারাপ। সব মনখারাপ ভ্যানিশ। খেলা পাগল, থিয়েটার পাগল, কবিতা পাগল, সিনেমা পাগল, রাজনীতি পাগল, আড্ডা পাগল, গান পাগল কলকাতার মতো এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের জোয়ার পাব কোথায়?

নাটক ‘চারদুয়ার’

সত্যি কথা বলতে কী, প্রতিযোগিতাই হোক বা মঞ্চে নেমেই হোক, কবিতা বলা এবং কবিতা পড়া ব্যাপারটাকেই বেশি ভালবেসে ফেলেছিলাম। এখনও এই বয়সেও কোনও আবেগঘন কবিতা পড়তে পড়তে চোখে জল চলে আসে। থিয়েটারে আমি আর কিছুই পারি না, একটু-আধটু অভিনয় করা ছাড়া। কিন্তু তাতেও থিয়েটার আমাকে গভীর প্রেমে মজিয়েছে। মঞ্চের পর্দা খুলে গেলে আবছা অন্ধকারে দর্শকরা, আর আলোর বৃত্তে অভিনেতা। অথচ কী এক অদৃশ্য তরঙ্গের আদানপ্রদান চলে এই আলো আর অন্ধকারে। এক রহস্য, রোমাঞ্চ, ভয়ে বুক শুকিয়ে যাওয়া অথচ অদ্ভুত এক আনন্দ— এই নিয়েই তো থিয়েটারের জগৎ।

এই সুখ নিয়েই আমার বেঁচে থাকা।

লেখক: আবৃত্তি শিল্পী ও মঞ্চ অভিনেত্রী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE