Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শ্মন্+শান=শ্মশান

বিশেষ্য শব্দ, শবদাহের স্থান। মশানও বলা যায়।এমনই জানিয়েছে অভিধান, কিন্তু অভিধানের বাইরে শ্মশানের ব্যাপ্তি অনেক বড়। এ এমন এক জায়গা যেখানে মানুষকে এক দিন না এক দিন যেতে হবেই। অবশ্যই যাঁরা অন্ত্যেষ্টিতে শ্মশান ব্যবহার করেন তাঁরাই। বাংলা গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটকে শ্মশানের ভূমিকা রয়েছে অসীম। দেবাদিদেব মহাদেব তো শ্মশানচারী। শ্মশানচারী মানে যিনি শ্মশানে চারণ করেন। অর্থাৎ বসবাস করেন। সর্বাঙ্গে ছাই মেখে অনুচর পরিবৃত হয়ে।

রূপক চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

এমনই জানিয়েছে অভিধান, কিন্তু অভিধানের বাইরে শ্মশানের ব্যাপ্তি অনেক বড়। এ এমন এক জায়গা যেখানে মানুষকে এক দিন না এক দিন যেতে হবেই। অবশ্যই যাঁরা অন্ত্যেষ্টিতে শ্মশান ব্যবহার করেন তাঁরাই। বাংলা গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটকে শ্মশানের ভূমিকা রয়েছে অসীম। দেবাদিদেব মহাদেব তো শ্মশানচারী। শ্মশানচারী মানে যিনি শ্মশানে চারণ করেন। অর্থাৎ বসবাস করেন। সর্বাঙ্গে ছাই মেখে অনুচর পরিবৃত হয়ে। ‘চিতাতেই সব শেষ’ নামে একটি জনপ্রিয় বাংলা গান রয়েছে কিশোরকুমারের। একই সঙ্গে ভয় পাওয়া ও দার্শনিকতার শ্রেষ্ঠ জায়গা শ্মশান। ভয়ের কারণ অতি অবশ্যই কিশোরদের ভূতের গল্পে শ্মশানের ভূমিকায়। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের মোহনপুরের শ্মশানে বলে বড় গল্প পড়ে অল্প বয়েসে রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছিল। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজেরও কিশোরদের ভূতের গল্পে শ্মশানের অসাধারণ বর্ণনা রয়েছে। সম্ভবত বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ শ্মশান বর্ণনা করেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর শ্রীকান্ত উপন্যাসে। রবীন্দ্রনাথের মহামায়া গল্পেও শ্মশানের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। মহামায়া গল্পের পটভূমিকায় শ্মশান না থাকলে গল্পটি তৈরি-ই হয় না। অথচ এ গল্প এক প্রবল দার্শনিকতায় আচ্ছন্ন। যদিও মনে রাখতে হবে শ্মশানের চরিত্রও পাল্টাচ্ছে। বিশেষ করে শহরের শ্মশানের চরিত্র তো প্রবল ভাবে পাল্টে গিয়েছে। গা ছমছমে ব্যাপারটাই নেই। সে গা ছমছমে ব্যাপার রয়েছে গ্রামের শ্মশানে। অনেক দিন আগে গিয়েছিলাম পাণ্ডবেশ্বর। যাঁর বাড়িতে উঠেছিলাম সেই সোমনাথদা মানে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় নিয়ে গিয়েছিলেন অনেক রাতে পাণ্ডবেশ্বর শ্মশানে। সেখানে এক বিরাট মন্দির আর তার চালা রয়েছে। রয়েছে এক সাধুবাবাও। সেই সাধুবাবা আমায় দেখালেন—ওই যে দূরে অজয়ের ধারে চিতা জ্বলছে ওটাই শ্মশান। আমি খুব অবাক হয়ে যাই। কেওড়াতলা বা নিমতলায় যেমন দেখেছি—একটা কাউন্টার থাকে। সেখানে কাগজপত্র দেখিয়ে দাহ করবার বৈধ অনুমতি নিতে হয়। সাধুবাবা বলেছিলেন, ‘এই গণ্ডগ্রামে কে কোন কাগজ দেখবে! তা-ও আবার রাত্রিবেলা। ও এমনিই নিয়ে এসে জ্বালিয়ে দেয়। আমাদের এখানে কাঠই চলে। বড়লোক-গরিবলোক সবাই-ই কাঠে দাহ হয়।

আমরা এখনও ইলেকট্রিক চুল্লির কথা কল্পনাও করি না।’। অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। মাঝেমাঝে আকাশে গুমগুম মেঘের ডাক। কালো স্লেটের ওপর চকের দাগের মতো বিদ্যুতের ঝিলিক। অজয় বয়ে যাওয়ার ঝিরিঝিরি টিরিটির শব্দ। তার মধ্যে হলুদ আলো জ্বলা মন্দিরের চাতাল। দূরে চিতা জ্বলছে। পুরো জিনিসটাই অতিপ্রাকৃত লাগে। এ শ্মশান যেন মনে হয় পৃথিবীর শেষ প্রান্তে রয়েছে। তার পর যেন আর মনুষ্য বসতি কোথাও নেই। আবার শহরের মাঝখানে কেওড়াতলা ঝাঁ চকচকে। তার ভেতরে গাড়ি পার্কিয়ের জায়গা থেকে শুরু করে শ্মশানযাত্রীদের প্রতীক্ষালয়। রাস্তার ধারে পর পর খাবারের দোকান। চার দিকে আলো ঝলমলে জমজমাট। শোক বা দার্শনিকতা এখানে যেন কম। এখানে যেন নেহাতই একজন মৃত মানুষকে দাহ করতে আসা। এ শ্মশানে অপার্থিব কোনও পরিবেশই নেই। যেন সেটা অনেকটা রয়েছে নিমতলা শ্মশানে। সেখানে শ্মশানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুবিশাল চেহারার গঙ্গা। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত স্মৃতিফলক। বাইরে রাস্তার ধারে ধারে ছোট ছোট গাঁজার দোকান। অনেকগুলো কচুরি-সিঙারা-মিষ্টির দোকান। এখানে ইলেকট্রিক আর কাঠের পাশাপাশি সমন্বয় দেখার মতো। আর গঙ্গার বয়ে যাওয়া এবং বাগবাজারের পর কাশীপুরের দিকে বাঁক নেওয়া চেহারা যেন শ্মশান-বৈরাগ্য এনে দেয়। পুরীর স্বর্গোদ্বারের শ্মশান অন্য চেহারার। শহরের মাঝখা, সমুদ্র পাড়ে। ছোট্ট শ্মশান। কাঠ ছাড়া অন্য কোনও পথ বা পদ্ধতি নেই। তা ছাড়া মৃত্যু মানে জীবনের শেষ। তার পর দাহ পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাওয়া। এই প্রেক্ষাপটে সমুদ্রের অসীমত্ব অন্য বার্তা বয়ে আনে। অন্য মাত্রা দেয়। কাশীর মণিকর্ণিকা ঘাটের শ্মশান জগৎ বিখ্যাত। এতটাই বিখ্যাত যে সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা সেই সময় বিট-কবি, পরবর্তী কালের বিখ্যাততম কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ এবং তাঁর সঙ্গী পিটার অরলোভস্কি মণিকর্ণিকা দেখতে চলে গিয়েছিলেন সেই ষাটের দশকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যদিও অবশ্য দশ্বাশ্বমেধ ঘাট কালীর গঙ্গা তীরবর্তী শ্মশান প্রবাদে পুরাণে রয়েছে রাজা হরিশচন্দ্রর জন্য। তোতাপুরির মতো বিখ্যাত সাধক এই সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। সত্যজিৎ রায়ের জয়বাবা ফেলুনাথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শুটিং হয়েছিল কাশীর এই জায়গাতেই। আজ থেকে বহুদিন আগে গিয়েছিলেন ইলামবাজার জঙ্গলের ভেতর বাবলি নামের একটা রিসর্টে। সকালবেলা কিছুই বোঝা যায়নি। রাত্রিরবেলা রিসর্টের বারান্দায় বসে অদ্ভুত ধরনের মন্ত্রপাঠ শুনে আমরা যখন জিজ্ঞেস করলাম ওখানকার কর্মীদের, ওঁরা জানালেন বাবলির পাঁচিলের গায়েই এখানকার শ্মশান। সেখানেই কোনও কাজকর্ম হচ্ছে। শুনে সে রাত্তিরে গায়ে কাঁটা দেওয়ার অবস্থা। বেড়াতে গিয়ে কোনও রিসর্ট বা হোটেলের পাঁচিলের গায়ে শ্মশান! এ প্রায় আশ্চর্যতম ঘটনা বললেও কম বলা হবে। আর সেই রাত্তিরের সেই শ্মশানচারীদের দূরাগত মন্ত্রধ্বনি যে কী বিচিত্র ‘ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক’ তৈরি করেছিল তা আজও আমার স্মৃতিতে অক্ষয়, জাগরুক। যদিও এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল—একটা সময় একটা বেসরকারি চ্যানেলে বেশ কিছু দিন চাকরি সূত্রে যোগ ছিল। সেখানে গোটা পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে একটা ধারাবাহিক হয়েছিল। নাম ছিল বাংলার মুখ। সেই বাংলার মুখের একটা এপিসোড ছিল তারাপীঠ।

মা তাঁরার সাধনপীঠে পৌঁছেছিলাম বিরাট একটা শুটিংয়ের দল। সেখানে সে রাত্তিরে দেখা চার জনের একটা-যজ্ঞ। তারা এক সঙ্গে অদ্ভুত মন্ত্র পড়ে চলেছেন। আমাদের অতজন লোকটোক রয়েছে। ক্যামেরা রয়েছে। অত আলো। তবুও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এমনকী এ-ও মনে হয় এদের বোধহয় কোনও দিনও সকালবেলা দেখতে পাব না। একটা সময় ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার কবিরা শ্মশানে খুব আড্ডা মারতেন। সে কথা নিজেই কবুল করেছেন স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এ প্রসঙ্গে আরও বলে নেওয়া ভাল তাঁরই কবিতা রয়েছে—‘আমি কপাল থেকে ঘামের মতো মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম/আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাওয়ার বদলে মাইরি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম’। সেই ষাটের দশকে বাংলা কবিতায় এত অবলীলাময় ‘শ্মশান’ শব্দের ব্যবহার—প্রায় ভাবাই যায় না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্মশান ব্যবহার যদি এই হয়, তা হলে তাঁর ‘গুরু’র শ্মশান ব্যবহারও বাংলা সাহিত্যে প্রবাদপ্রতিম। প্রশ্ন উঠবে ‘গুরু’-কে? এক এবং অদ্বিতীয় কমলকুমার মজুমদার। কমলকুমার তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ রচনা করেছিলেন পুরোটাই প্রায় শ্মশানভিত্তিক। এ রচনায় দেখা যায় বা আমরা জানি সে সময়ে গঙ্গা পাড়ে মারা যাবে এমন বৃদ্ধদের রেখে আসা হত। এই পটভূমিকায় উপন্যাসটির কাহিনি। যার শেষ লাইন আজও বাংলা ভাষায় অমর হয়ে আছে—‘কিছু মায়া রহিয়া গেল’। আমাদের তথা হিন্দুদের জীবনে শ্মশান এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ। ভিখিরি হও বা কোটিপতি হও শেষ পর্যন্ত তোমার ওই শ্মশান। বাংলা সিনেমা থেকে হিন্দি সিনেমা—কত যে শ্মশানের দৃশ্য সাধারণ মানুষ দেখেছে তা বলার নয়। তবে কী, এই দু’হাজার পনেরোতেও সবই কাঠের চিতার ব্যবহার। সম্ভবত এতে মেলোড্রামা বেশি আসে। বাংলা তথা মুম্বইয়ের মেগাস্টার এবং বর্তমান রাজ্যসভার সদস্য মিঠুন চক্রবর্তীর একটি বিখ্যাত সংলাপ তো প্রবাদেও পরিণত হয়েছে— ‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে’। অর্থাৎ কি না গতি-অগতি-সুগতির শেষ কথা শ্মশান। চোখের সামনে উত্তমকুমার থেকে প্রমোদ দাশগুপ্ত, জর্জ দেবব্রত বিশ্বাস, সুভাষ চক্রবর্তী—সবই দেখা শ্মশানগামী মানুষের ভিড়। একটা সময় ছিল, যখন ও জায়গায় আড্ডা মারাটা যেন রুটিন ছিল। আলাপ হয় মন্টু-রাখাল-হরেন-তিলকদের সঙ্গে। ওরা কেওড়াতলা শ্মশানে কাজ করে। এখানকার শ্মশান অনুযায়ী ওদের ‘ডোম’ বলা যায় না। ওদের কথা অনুযায়ী—‘ও সব আপনাদের হাতে অনেক সময় আছে বলে নানা চিন্তাভাবনা। আমাদের কী আছে মশাই! মানুষ মারা গেছে। আমাদের কাছে এনেছেন। আইন অনুযায়ী পুড়িয়ে দিচ্ছি। ব্যস। এর পর কী আছে, আর কী থাকে? ও সব চিন্তাভাবনা করলে পেট চলবে?’ সত্যিই তো ভেবে অবাক বই। এটাও একটা পেশা তো বটেই। জীবন শেষ। মৃত্যু, দাহ এ সব বিষয় নয়। শ্মশানও এখন একটা রোজগারের জায়গা। যেখানে জীবন দাহ হয়। এটার উপর নির্ভর করে অনেকেই খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে। এ কম কথা নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pollution Crematorium rupak chakrabarty nimtala
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE