Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সাগরতট গণপতিপুলে

এই যে নারকেলবীথি আর ঝাউবনের সবজে-রঙা পাতাগুলো যেখানে গাছগুলোর ডালে ডালে দিনভর পাখিদের নিরন্তর ওড়াউড়ি। চাদ্দিক জুড়ে চৈত্র সূচনাতেও বসন্তের অদ্ভুত কানাকানি। এখানে আসন্ন ফাগ উৎসবের এখনও তেমন কোনও অদেখলেপনা নেই। তবু প্রকৃতির ফাগ ওড়ে। বসন্ত আর একটি ঘন হয়ে এলেই অনেকখানি সময় জুড়ে বিকেল।

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

২০ মার্চ ২০১৬ দুপুর ২.৪০
এম টি ডি সি হলিডে রিসর্ট
গণপতিপুলে-৪১৫৬১৫
জেলা রত্মগিরি মহারাষ্ট্র

এই যে নারকেলবীথি আর ঝাউবনের সবজে-রঙা পাতাগুলো যেখানে গাছগুলোর ডালে ডালে দিনভর পাখিদের নিরন্তর ওড়াউড়ি। চাদ্দিক জুড়ে চৈত্র সূচনাতেও বসন্তের অদ্ভুত কানাকানি। এখানে আসন্ন ফাগ উৎসবের এখনও তেমন কোনও অদেখলেপনা নেই। তবু প্রকৃতির ফাগ ওড়ে। বসন্ত আর একটি ঘন হয়ে এলেই অনেকখানি সময় জুড়ে বিকেল। ‘এই নীল নির্জন সাগরে/এলোমেলো ঢেউয়ের গান গাহি/ঘুরে ঘুরে আজ তরী বাহি’। দুপুরের চেনা বিহ্বলত গড়িয়ে যাচ্ছে। মাধুর্যের যাবতীয় আঁচ নিয়ে আরও কিছু পর বিকেল নামবে। আমারও ভেসে যাচ্ছি তাই প্রকৃতির আবিলতায়। যেখানে পায়ের পাতায় ধেয়ে আসছে খুনসুটি প্রবণ ফিচেল ঢেউগুলো। বালুতট ছেড়ে পর্যটকদের পদক্ষেপ মুছে নিয়ে ফিরে যায় ঢেউয়ের অনন্ত কোলাহল।

মুম্বই মহানগরের কোলাহল দূরে সরিয়ে রেখে চলে আসা নীল নির্জন সাগরবেলায়। প্রকৃতি তখন গা ঘেঁষে এসে বসে। এসেই যেন গা এলিয়ে দেয়। বস্তুত গেরস্থালি খুলে রেখে সমুদ্রগান শুনব বলেই তো এই গণপতিপুলে সাগরবেলায় আসা। যেখানে নোনা বাতাস ও নোনা ঢেউয়ের বিরামহীন প্রতিশ্রুতি নিয়ে অপাঙ্গে বিছিয়ে আছে সুনীলসাগর। নাগালের এক্কেবারে কাছটিতে। সেখানে কেবল সাগর আছে। সাগরের দিনরাত্রি আছে। আর আছে সাগরের ঢেউয়ের মাথায় উদয়অস্ত আলোর চিক্কণ। এখন কেবল প্রকৃতিই স্বয়ংবরা। আমাদের নভি মুম্বই থেকে গণপতিপুলের দূরত্ব ৩১১.৪ কিমি। সময় লাগে কমবেশি ৬.১৫ মতো। সড়ক পথে গাড়িতে অতটা জার্নি একলপ্তে পোষাবে না। তাই আগের দিন অর্থাৎ ১৯ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ ড্রাইভার আমোল চিরানেতাই ছাইরঙা কোয়ালিস গাড়িটা নিয়ে আমাদের আবাসনের দোরগোড়ায় হাজির ও স্বভাবসিদ্ধ একটা মিসড কল দিয়ে তার হাজিরা জানান দেয়। আমরাও বৈকালিক চা পর্ব সেরে আমার সাধের নিক্কন ক্যামেরা ও দুটো ট্রলি সুটকেশ নিয়ে বোরিয়ে পড়ি কোঙ্কন উপকুল আনন্দযাত্রায়। আমাদের এ বারের সফরযাত্রা মহারাষ্ট্রের কোঙ্কন উপকুলের গণপতিপুলে। রত্নগিরি, ভেলনেশ্বর, গুহাগর, হরিহরেশ্বর সৈকত, শ্রীবর্ধন সৈকত, দেওয়াগর সৈকত, আরাভি সৈকত ইত্যাদি ঘুরে বেশ কয়েক দফায় লঞ্চ যাত্রার বার্জে সটান গাড়ি-সহ কখনও বড় নদী মোহনা, কখনও সাগর পেরোতে হবে। আবার কখনও স্রেফ উপকুল পথ সাঁতরেই আমাদের এ বারের মতো ভ্রমণ চলবে। ছয় দিন পর দোলটোল কাটিয়ে মুম্বই ফেরার কথা। বস্তুত একটু হাটকে অন্য রকম এক কোঙ্কন উপকুল ভ্রমণের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। যেখানে সড়ক পথের বেশির ভাগ সময়টাই আমাদের সঙ্গে সওয়াড়ি থাকবে গাড়ির জানলার কাচের বাইরে আরব সাগরের নীল কোলাহল।

যাত্রাপথের খেই ধরে প্রথমে নভি মুম্বই থেকে সিওন পানভেল হাইওয়ে, তারপর মুম্বই পুণে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে পেনখাপোলি রোড। তারপরই শুরু হল জাতীয় সড়ক ৬৬। সন্ধের অন্ধকার চিরে হু হু করে গাড়ি চলছে। কর্তার স্মার্টফোনের জি পি এস অ্যাপ খোলা। পথের হদিশ বাতলে দিচ্ছে স্মার্টফোন। বেশ অনেকখানি চলার পর মুম্বই গোয়া হাইওয়ের উপর ওয়াদখল-এ হোটেল এসেই গণেশ ধাবায় রাতের আহার সেরে আরও কিছুক্ষণ গাড়িতে ৬০ কিমি পেরিয়ে মানগাঁওয়ের হোটেলে রাত্রিবাস। পথশ্রমে ক্লান্ত শরীর বিছানার নিভৃত আশ্রয়ে মুখ গুঁজে নিল।

আজ ভোরে স্নান সেরেই বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় ৩০ কিমি দূরে মাহাদ। ডান দিকে একটা নদী এসে সঙ্গ দিল। চলল সঙ্গে সঙ্গে। নদীটির নাম গান্ধারী। এই অঞ্চলে নদীর ধার বরাবর বেশ কিছু হোটেল রেস্তোরাঁ রয়েছে। আরও খানিক যেতেই যাত্রাপথের বাঁয়ে এক নাতিদীর্ঘ পাহাড়টিলা। দেখতে অনেকটা অজন্তার গুহার আদল। তক্ষুনি গাড়ি থেকে নেমে পড়ি ক্যামেরা নিয়ে।

বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে সমতলে দাঁড়িয়েই ক্যামেরা জুম করে পাহাড়টিলার ওই গুহার কিছু ছবি তুলে রাখি। সামনেই মহারাষ্ট্র সরকারের উর্দিধারী মহিলা ও পুরুষ পুলিশকর্মী নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। ওঁদের কাছেই জানলাম, এই স্থানটির নাম গান্ধারপালে। সমতল থেকে পাহাড়ের সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। নোটিশ বোর্ডে লেখা ‘পালে বৌদ্ধ নেনি’। মরাঠা ভাষায় নেনি মানে হল গুহা।

গান্ধারপালের ঝুপড়ি চা দোকানে চা পর্ব বিরতির ফাঁকে দোকানির কাছে জেনে নিই স্থানমাহাত্ম্য। নাতিদীর্ঘ এই পাহাড়টিলায় মোট ৩১টি হীনযান বৌদ্ধগুহা রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১০০-১৫০ সনে নির্মিত এই বৌদ্ধগুহাগুলি সে সময় বৌদ্ধ বিহার হিসাবে ব্যবহৃত হত। গুহার ভিতর ব্রাহ্মী ভাষায় কিছু শিলালিপি খোদিত আছে। আর আছে স্বপার্ষদ বুদ্ধমূর্তি। গান্ধারপালে বা পালে গুহার অদূরেই গান্ধারী ও সাবিত্রী নদীর মোহনা। নিকটবর্তী দুই গ্রাম গান্ধার ও পালে থেকে এই স্থানটির নাম হয়েছে গান্ধারপালে। এককালে এটি ছিল একটি প্রাচীন জনপদ। এগারোশো শতকে রাজা অনন্তদেবের আমলে এই সমগ্র অঞ্চলটির নাম ছিল পলিপাট্টান। পরিবেশ বেশ সুন্দর। বোঝাই যাচ্ছে রিমঝিম বর্ষায় বৃষ্টি শুশ্রূষায় সমস্ত পাহাড় টিলাটিই ঘন সবুজ আলোয়ানে জড়িয়ে রাখে নিজেকে।

গান্ধারপাল থেকে গণপতিপুলে আরও ১৮০ কিমি। স্মার্টফোনের জি পি এস পরিষেবা সমস্তটাই জানিয়ে দিচ্ছে। আবার কিছুটা ঘাট রোড অর্থাৎ পাহাড়ি পথ সাঁতরে চিপলুন। সদর শহর। একটি রেস্তোরাঁয় পোহা আর কফি সহযোগে প্রাতরাশ সেরে আবার গাড়িতে। চিপলুন থেকে গণপতিপুলের দূরত্ব ১১০ কিমি। সুন্দর পথশোভা। বশিষ্টি নদী, সঙ্গমেশ্বর ইত্যাদি পেরিয়ে দক্ষিণ কোঙ্কন উপকুলের রমণীয় সাগরতট গণপতিপুলে যখন পঁছলাম গড়িতে তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। মহারাষ্ট্র টুরিজমের সাগরমুখী ডিলাক্স রুমের দ্বিতল ঘরটি সপ্তাহ দুই আগে থেকেই অনলাইন বুকিং ছিল। সুসজ্জিত আসবাব ও আধুনিক স্নানাগার-সহ বিরাট ঘর। উপরিপাওনা হিসাবে অর্ধচন্দ্রাকারে সাগরমুখী ব্যালকনিটি প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ করেছিল। জিনিস ঘরে ফেলে রেখেই দে ছুট সৈকতে।

রিসর্টের সিঁড়ি নেমে গেছে সৈকত পর্যন্ত। পর্যটক সমাগম ভালই। তার উপর আজ রোববার। সপ্তাহান্তিকরা ছটিছাটার দিনে মুম্বই ও কাছেপিঠের মানুষজন বেড়াতে চলে আসেন এই সব অঞ্চলে। যেখানে দূরের গহীন নীল ও নিরবচ্ছিন্ন মিহি বালুতটে সাগরের আবাল্য খেলাধুলো। ঢেউগুলোকে একটি প্রশ্রয় দিতেই পায়ে এসে জাপটে ধরে। খানিক ঢেউয়ের সঙ্গে হুটোপুটি। হা হা হি হি। ঠা ঠা রোদে সৈকতে থাকা গেল না। বালির উষ্ণতা পায়ে কামড় দিচ্ছে। মন্দির দর্শনও মুলতুবি রাখলাম গরমের তাতে। রিসর্ট চত্বরে তরঙ্গ রেস্তোরাঁয় আধভেজা পোশাকেই আহার করলাম বিশুদ্ধ কোঙ্কনথালি। ছোট বাটিতে ভাত, দুটি রুটি, দুটি নিরামিষ সবজি, কোকম সরবত, দই, আচার, সেঁকা পাপড়, অড়হর ডাল।

২০ মার্চ ২০১৬ সন্ধে ৮.২৫

এম টি ডি সি হলিডে রিসর্ট

গণপতিপুলে-৪১৫৬১৫

জেলা রত্মগিরি, মহারাষ্ট্র

গণপতিপুলের আকাশে আজ দ্বাদশীর চাঁদখানা বেজায় রৌণক ছড়াচ্ছে। মাত্র দিন দুই পরেই দোল পূর্ণিমা। দৃশ্যত সন্ধঝের পিঠোপিঠি গণপতিপুলের আকাশে দ্বাদশীর ওই চতুর চাঁদ ভেসে উঠেছে। সাগরবেলায় অসামান্য অবকাশে এখন ক্রমান্বয় ঢেউ ভাঙার ছলাৎছল। সকালে আসার সময়ই গাড়ির জানলার কাচে চোখে পড়েছিল গণপতিপুলের মনোরম সৈকত। নারকেল গাছের সারি সযত্নে ঘিরে রেখেছে এখানকার বেলাভূমিকে। কোঙ্কন উপকুলে এমনই এক চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশে ছোট্ট এই গ্রামখানি। শান্ত নিরালা প্রকৃতির সঙ্গে সোনালি সৈকত ও ধর্মীয় পরিমণ্ডল। এই ত্র্যহস্পর্শে গণপতিপুলের চিত্তাকর্ষক বৈভব। মুম্বই থেকে মানগাঁও, মাহাদ, চিপুলন হয়ে পুরো পথটাই যেন সাজানো চিত্রনাট্যের খাতা। যেখানে হরিয়ালি আছে, নীল আছে, নির্জন আছে, রম্যতা আছে, শান্ত শ্রীমণ্ডিত বনেদিয়ানা আছে। প্রায় শ’খানেক বাড়িঘর নিয়ে সবুজে ছাওয়া গণপতিপুলে গ্রাম।

শেষ বিকেলে রোদের আঁচ খানিক ফিকে হতেই পৌঁছে যাই সাগরতটে। রিসর্ট চত্বরটাই এত পরিপাটি সাজানো যে এখানেই ঘুরেফিরে সময় কেটে যাবে অনেকখানি। রিসর্টের সিঁড়ি বেয়ে সৈকতে পা রাখতেই ঢেউরা উস্কানি মূলক ভাবেই ছেঁকে ধরে। ধরা দেব বলেই তো সৈকতে এসেছি। কর্তামশাইয়ের হাত ধরে কোমর জলে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের সঙ্গে দেদার খেলা চলতে থাকে বিরামহীন। এক্কেবারে ভুলে যাই, মাত্র পাঁচ মাস আগেই বেকায়দায় শিরদাঁড়ার হাড় ভেঙেছিল। স্থানীয় প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফাররা এগিয়ে এসে ওদের ক্যামেরায় ছবি তোলার অনুরোধ করে। অবশ্য ততক্ষণে নিজেদের ক্যামেরায় অনেক ছবি উঠে গেছে।

গণপতিপুলে সাগরজলে অর্কদেবের পাটে যাওয়ার অপরূপ দৃশ্যগুলিও ক্যামেরাবন্ধি হতে থাকে। খানিকপর সৈকতে মরাঠি ডাবওয়ালার নারকেলপাতার ছাউনিতে প্লাস্টিকের চেয়ারে আয়েশ করে বসি। প্রতিটি ডাবের দাম ৩০ টাকা। ডাবের মিষ্টি জলটুকু চোঁ চোঁ করে সাবড়ে তারপর নরম শাঁসটুকু কুড়ে কুড়ে খাই। সন্ধের অন্ধকারটুকু আরও যখন জাঁকিয়ে আসে সমুদ্রতট থেকে হোটেল ঘরে ফিরে ডায়েরি লিখতে বসি। এখনই কিছুটা না লিখে রাখলে স্মৃতি যদি ধোঁকা দেয়।

২১ মার্চ, রাত ৩টে ১০

এম টি ডি সি হলিডে রিসর্ট

কোনও মানে হয়? মাঝরাতে অকাতরে ঘুমন্ত আমাকে বেআক্কেলের মতো জাগিয়ে তুললেন তিনি। কী, না বারান্দার চেয়ারে বসতে হবে। ঘুম জড়ানো চোখে বারান্দায় গিয়ে বসি। বাইরে তখন দারুণ একখানা চাঁদ-ধোয়া রাত যেন ঠিক আমাদেরই অপেক্ষায়। কী জানি, চন্দ্রাহত হব বলেই বোধহয় ঘুমভাঙা রাতে জেগে উঠি। নারকেলগাছের ঝুঁকে থাকা তিরতির দুলে ওঠা পাতার ফাঁক গলে চাঁদের ফিচলেমি। ভাগ্যিস, তিনি বিছানার মায়া থেকে জাগিয়ে তুললেন। তাই না এমন নির্ভেজাল প্রকৃতিপাঠ। চাঁদ জোছনার টানে রাত বাড়ার সঙ্গেই সৈকত জুড়ে যেন থই থই। চন্দ্রাহত মুগ্ধতায় প্রকৃতিপ্রেমিক মগজে সহজাত প্রশ্রয় এসে ধরা দেয়। চাঁদের কাছে তখন নীরব আর্তি— চন্দা রে চন্দা রে কভি তো জমি পর আ, ব্যয়ঠেঙ্গে বাঁতে করেঙ্গে’।

পাঠক ঠিক ধরেছেন। মণিরত্নম পরিচালিত ‘রোজা’ ছবির মনকেমন করা সেই গানটি গুনগুন করতে থাকি। ডায়েরি লিখতে বসি আবার। এই রাতের চাঁদ-ধোয়া সুহানা সফরে আমরা বারান্দায় বসে কত গল্প করি। এলোমেলো মনের কুঠুরিতে গচ্ছিত রাখি কিছু কেয়াবত স্বপ্ন।

২২ মার্চ, সকাল ১১টা ৩৫

এম টি ডি সি হলিডে রিসর্ট

চারশো বছরেরও বেশি প্রাচীন ‘স্বয়ম্ভু’ দেবতা গণেশ বা গণপতি থেকে এসেছে। সকালে স্নান সেরে মন্দির চত্বরে যাই। কথিত আছে স্থানীয় কোনও এক উপজাতি মহিলার অসঙ্গত আচরণে গণপতিবাপ্পা রাগান্বিত হয়ে নিজ বাসভূমি থেকে সামান্য দূরে এইস্থানে এসে অধিষ্ঠিত হন। ভক্তদের ভিড়ে সব সময়ই ব্যস্ত মন্দির প্রাঙ্গণ। মূল ফটক থেকে পায়ে হেঁটে পৌঁছতে হয় মন্দির চত্বরে। জুতো খুলে রেলিং ঘেরা পথ ধরে আরও বেশ কানিকটা ভিতরে গিয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহ। লাল জবাফুলের মালা, নারকেল, সিঁদূর, লাড্ডু বিক্রি হচ্ছে নৈবদ্যের থালায়। অবাক হলাম, কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরগুলোর মতো পুজো দেওয়ার জন্য কোনও জোরজার, পিড়াপিড়ি নেই। মূল মন্দিরে ঢুকতেই একটি বিশালাকায় পিতলের ইঁদুরমূর্তি। ভক্তরা গণেশ বাহনকে পুজো দিচ্ছেন। প্রণাম করছেন। আরও ভিতরে মন্দির ট্রাস্টির কার্যালয়। লাড্ডু প্রসাদও বিভিন্ন দামে প্যাকেটজাত হয়ে বিক্রি হচ্ছে। ভেতরে কমলা সাদা রং করা হয়েছে গণপতি মন্দির। মন্দিরের ভিতর লাল সিঁদূর লেপা স্বয়ম্ভু গণেশের মূর্তি। আরও কিছু দেবতার মূর্তিও রয়েছে অন্য দিকে। মরাঠা ও কোঙ্কনবাসীদের কাছে খুবই পবিত্র এই মন্দিরধাম। অনেকখানি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত মন্দির প্রাঙ্গণের প্রধান ফটক ছাড়াও সাগরপাড়ে অন্য আরও একটি দ্বার আছে। লক্ষ্যণীয় ভারতীয় হিন্দু সমস্ত মন্দিরই সাধারণত পুবমুখী হয়। ব্যতিক্রমী গণপতিপুলে মন্দিরে বক্রতুন্ত গণেশ দেবতার অধিষ্ঠান পশ্চিমমুখী। পুজোর প্রথামত ভক্তরা সমগ্র মন্দির প্রাঙ্গণ প্রদিক্ষণ করেন। মাঘ চতুর্থীতে গৌরী গণপতি উৎসব পালিত হয়। আর হয় অঙ্গার কি অঙ্গার চতুর্থী উৎসব। এই উৎসব চলাকালীন অনুষ্ঠান শুধু দেখা নয়, ক্যামেরায় টুকে রাখার মতো বিষয়।

মন্দিরের কোল ঘেঁষে সাগর সৈকত। সৈকতর কয়েক ধাপ উপরে সার দিয়ে কিছু দোকানপাট। সেখানে নানান ধাতুর গণেশ মূর্তি। প্যাকেটজাত ড্রাইফ্রুট প্রসাদ, মোবাইল সিমকার্ড, দোকান টুপি, ছাতা, কানের দুল, রোদচশমা, গলার মালা। চুড়ি আমস্বত্ব ও কোকম সরবতের অঢেল পসরা সাজানো। এখানকার সৈকতে পর্যটকদের ভিড় বেশি। রয়েছে ঝলমলে চাঁদোয়ায় সাজানো উট, ঘোড়ায় টানা এক্কাগাড়ি, এবং জলকেলির হরেকরকম রাইডের ব্যবস্থা। হোটেলের ব্যবস্থাপনায় ‘পিস পার্ক টুর অ্যান্ড ট্রাভেল’ একদিন অথবা আধদিনের প্রোগ্রামে কাছেপিঠে অনক অঞ্চলে ঘুরে আসা যায়। অনুমোদিত কয়েকটি টুর প্রোগ্রাম থেকে নিজেদের সময় ও পছন্দ মতো ক) গণপতিপুলে-পাওয়স প্রাচীন কোঙ্কন, অ্যাকোরিয়াম, ভগবতী দুর্গ ও মন্দির, পাওয়স মন্দির, কেশবসুত বাসগৃহ, ভাটে, ব্ল্যাক সি, পতিতপাবন মন্দির, থিবা রাজপ্রাসাদ, লোকমান্য তিলক মূর্তি। খ) মারলেশ্বর-দেরয়ান মারলেশ্বর শিবমন্দির, গুহা, জলপ্রপাত, শিবশ্রুতি। গ) জয়গড়-হেদাভি ভেলেনশ্বর জয়গড় দুর্গ, বাতিঘর, জয় বিনায়ক মন্দির, কাহ্নেশ্বর মন্দির, ভেলনেশ্বর কালভৈরব মন্দির, ভেলনেশ্বর সৈকত, হেদাভি দশভুজ গণেশ মন্দির। ঘ) জয়গড় দুর্গ, জয়গড় জেটি, জয়গড় দুর্গ বাতিঘর, জয় বিনায়ক মন্দির, নির্মল নগরী সৈকত, কোলিসরে লক্ষ্মীকেশব মন্দির, পাণ্ডব মন্দির, কাহ্নেশ্বর মন্দির।

প্রাচীন কোঙ্কন মিউজিয়াম যেখানে প্রাচীন কোঙ্কনী জীবনযাত্রার ঝলক পাওয়া যাবে। গণপতিপুলে থেকে মাত্র ৩ কিমি দূরেই মালগুন্দ নামের ছোট্ট গ্রামটিতে মরাঠা কবি কেশবসুতের জন্মভিটে। আছে কবির মূর্তি। অপূর্ব সুন্দর গ্রাম্য পরিবেশে এই মরাঠা কবির বাসগৃহ। রয়েছে সংগ্রহশালা। টালির একচালা বাসভিটেটি সংস্কার করে সেখানে এখন একটি মরাঠি ছাত্রাবাস হয়েছে। মরাঠি সাহিত্য পরিষদ এখন ভবনটির দেখভাল করে। মরাঠি সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান হিসেবেও খ্যাত গণপতিপুলে। প্রায় ২০ কিমি দূরেই পাহাড়টিলার ওপর শিবাজি মহারাজের তৈরি জয়গড় দুর্গ। ১৭ শতকে স্থাপিত এই দূর্গ থেকে সঙ্গমেশ্বর নদীর আরব সাগরের বুকে আছড়ে পড়ার দৃশ্যটি চমৎকার। এলাকাটি মূলত মৎস্যজীবী মানুষজনের বসবাস। অদূরেই ১৯৩২ সালে নির্মিত বাতিঘর। বিকেল চারটে থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত অনুমতিসাপেক্ষে বাতিঘরের ভিতর যাওয়া যেতে পারে। যদিও সময় সঙ্কুলানের জন্য আমাদের যাওয়া হয়নি। তবে উৎসাহী পর্যটকদের অনেকেই সঙ্গমেশ্বর-জয়গড় খাঁড়ি ধরে নৌবিহারের আনন্দ উপভোগ করেন। ৮৫ কিমি দূরে মারলেশ্বর শিবমন্দির ও সুন্দর প্রপাতটিও অদেখা থেকে গেছে। এই পথে মালগুন্দ গায়ওয়ারির নির্জন সৈকতটিও মনোরম। সৈকতে প্যারাসিলিং ও নানাবিধ জলক্রীড়ারও বিনোদনী ব্যবস্থা আছে। ত্রিবরি বন্দরটিও মাত্র ৬ কিমি দূরত্বে।

(এর পর আগামী সংখ্যায়)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ganpatipule Maharashtra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE