শুকনো পাতা উড়ছে এলোপাথাড়ি। দিশাহীন দামাল হাওয়ার মাতাল ছোটাছুটির মধ্যেই আন্দাজে সেই আলো-অন্ধকারে দ্রুত পায়ে এগোচ্ছেন মানুষটি। হঠাৎ বাধা পড়ল এক পিছুটানে। কে যেন তার ঢিলেঢালা আলখাল্লার প্রান্ত ধরে আছে পিছন থেকে। কে? এমন ছন্নছাড়া আবহাওয়ায় সামান্য শিউড়ে উঠেই পেছন ফিরে দেখলেন, কে? ছোট্ট একটি নিষ্পাপ ফুলের গাছ। এই অস্ফুট আবছায়ায় যেন ভারী মিনতি-ভরা কণ্ঠে মানুষটিকে জিগ্যেস করছে—‘আমার কথা তুমি লিখবে না তোমার কবিতায়? বড়ই অকিঞ্চিৎকর আমি পৃথিবীর অজস্র ফুলের বাগানে। তবু তো প্রকৃতি তাঁর কোলে ঠাঁই দিয়েছেন আমায়...আমি কি কোথাও থাকব না তোমার কাব্যে?’ হ্যাঁ, আছে বৈকী! সেই মালতী-করবী-মল্লিকা, দোদুল্যমান মাধবীলতার আলো-করা সভায়, অতি নগণ্য সেই ফুল আকন্দকেও ঠিক মনে করে রেখেছেন কবি। আমাদের অন্তরের মানুষ রবীন্দ্রনাথ। অন্তরে-বাহিরে, সুখে-দুঃখে, ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়, তপের তাপশর নিদাঘ দ্বিপ্রহরে অথবা অঝোরঝরন বর্ষায়— সকল সময়ে প্রায়-ঈশ্বর বা চিরকালের অবতারের মতো নিকটে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদেরই জন্য কোনও না কোনও উপহার নিয়ে।
শান্তিনিকেতনের এক সন্ধ্যায় ওপরে কথিত ঘটনাটি ঘটেছিল। সেই আবছা অন্ধকারে, অমন ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও দিনেন্দ্রনাথের কাছে ছুটতে ছুটতে যাবার সময়, পথের প্রান্তে অপেক্ষমাণ একটি নগণ্য আকন্দ গাছের সঙ্গে তাঁর হঠাৎ আলাপ। তাকেও ভোলেননি কবি। মনে মনে তাকে-দেওয়া কথাও তিনি রেখেছেন—কবিতার অক্ষরে অক্ষরে। দিনলিপির মতনই লিখে উপহার দিয়ে গেছেন আমাদের ও তাঁর ‘আকন্দ’ গাছটিকে। কবিতাটি প্রায় সকলেরই জানা। তবু, রবীন্দ্রনাথ পুরোনো হন না বলেই প্রসঙ্গক্রমে পুনরায় বলা যায় : ‘সন্ধ্যাকালে সোনার খেয়া পাড়ি যখন দিল গগন-পারে/অকূল অন্ধকারে/ছমছমিয়ে এল রাতি ভুবনডাঙার মাঠে/একলা আমি গোয়ালপাড়ার বাটে।/নূতন-ফোঁটা গানের কুঁড়ি দেব বলে দিনুর হাতে আনি/মনে নিয়ে সুরের গুনগুনানি/ চলেছিলেম। এমন সময় যেন সে কোন পরীর কণ্ঠখানি/ বাতাসেতে বাজিয়ে দিল বিনা ভাষার বাণী।/ বললে আমায় দাঁড়াও ক্ষণেক তরে/ ওগো পথিক, তোমার লাগি চেয়ে আছি যুগ যুগান্তরে/ আমায় নেবে চিনে/সেই সুলগন এল এতদিনে।/ পথের ধারে দাঁড়িয়ে আমি, মনে গোপন আশা/ কবির ছন্দে বাঁধব আমার বাসা/ দেখা হল, চেনা হল সাঁঝের আঁধারেতে,/ বলে এলেম, ‘তোমার আসন কাব্যে দেব পেতে’।.../ ...সভার দুয়ার হল বন্ধ/ সব পিছে রইল আকন্দ।’’
এই ঠাকুরের কোনও সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করবার যোগ্যতা আমার এ জন্মে হবে না। তবে, ব্যক্তিগত ভাললাগার ভিতর এই কবিতাটি অসাধারণ কোনও উচ্চতায় ঠাঁই পেতে পারেনি অন্যান্য হাজার সৃষ্টির সুবিশাল উদ্যানে। তবু এই অকিঞ্চিৎকর বিষয়ও তাঁর ভাল লেগেছে, যদিও তিনি অন্য কোনও সৃষ্ট সুর মনে রেখে রেখে দ্রুত হাঁটছিলেন—পাছে অন্য কোনও ভাবনার বাতাসে সেই গানটি হারিয়ে না যায়। ঝোড়ো বাতাস, শুকনো পাতা উড়ছে, ধুলোর উথালিপাথালি ছোটাছুটির মধ্যে নিজেও দ্রুত দৌড়চ্ছেন বিশেষ ভাবনাটিকে নিয়ে,— এমন অসাব্যস্ত অবস্থায় প্রকৃতির এক নগণ্য সৃষ্টি ‘আকন্দ’ অনাহূত, অবাঞ্ছিত হলেও, বিশ্বকবি তাকে সযত্নে ঠাঁই দিয়েছেন মনের কোণে। তার আবদারও তিনি অগ্রাহ্য করেননি বিরক্তিভরে। তাকে দেওয়া কথা রেখে তার আসনও পেতে দিয়েছেন তাঁর কাব্যে। অসামান্য মানুষ ব্যতীত এ ঘটনা এমন সুন্দর পরিসমাপ্তিতে পৌঁছত না। হারিয়ে যেত নানান ভাললাগা, নানান ব্যস্ততার জীবনে।
আর একটি দুর্ভাগ্যময় কাণ্ড হত এবং এমন বিপুল ধনভাণ্ডার মোটেই পেতুম না আমরা, কবির জন্ম যদি ঘটত এ কালে। ভাবুন, একবিংশ শতকের প্রথম দশক পেরিয়ে এসেছি আমরা। আজকের দিনের যে কোনও একদিন সূর্যের আলো নিভে আসছে। শান্তিনিকেতনের পথে পায়চারি করছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। হুবহু সেই ঝোড়ো হাওয়ার সন্ধে। পায়চারি করতে করতে সুরের সঙ্গে বাণী মিলিয়ে ‘গানের কুঁড়ি’টি পেয়ে গেলেন মনে। ভারী পছন্দ হল তাঁর। দামাল বাতাসের মধ্যে ‘দিনু’র হাতে সেই সুর-বাণী পৌঁছবার জন্য ছুটতেই হল না মোটে। লম্বা সেই বিখ্যাত আলখাল্লার পকেট থেকে আজকের মহা-যন্ত্র (তথা যন্ত্রণা) মোবাইলটি বের করে আনলেন। টুক করে নম্বর টিপে কানে লাগিয়ে কথা বললেন বিশ্ববন্দিত মানুষটি। ব্যস! গেল সব হারিয়ে। না হল দেখা তাঁর ‘আকন্দ’র সঙ্গে। না পেলুম আমরা তাঁর লেখা কবিতাটি।
এ তো গেল শুধু একটি সম্ভাবনা। এর পরেও থাকছে। যেমন, আমরা যারা কিঞ্চিৎ লেখালিখির মধ্যে থাকি, আমরা কি জানি না একটি লেখা মোটামুটি আপন পছন্দমতো ‘দাঁড়’ করাতে গেলে কত কাটাকুটি, কাগজের কত পৃষ্ঠা যে ছুড়ে ফেলে দিতে হয়, তার হিসেব আমরা রাখি না। আর রবীন্দ্রনাথ! তিনিও তো তাঁর হাতে লেখা এক একটি গান বা কবিতা লিখতে গিয়ে অজস্র পরিবর্তন করেছেন, পছন্দ হচ্ছে না বলে। সেই কাটাকুটি করতে করতে শেষ অবধি যা তাঁর পছন্দ হয়েছে, সেটিই আমরা মুদ্রিত রূপে দেখতে পেয়ে ধন্য হয়েছি। আর ওঁর হস্তাক্ষরে লেখা পাণ্ডুলিপির ‘কপি’তেও তাঁর অন্য পরিচয়ের রূপ ফুটে উঠেছে। সুন্দরের পূজারি কবিগুরু তাঁর শব্দ-অক্ষর কাটাছেঁড়াগুলিকে চিত্রকল্প করে সাজিয়ে রেখেছেন। কাব্যশিল্পের সুন্দর সম্মিলন।
হ্যাঁ, যা বলছিলুম। যত লেখা আমরা মুদ্রিত বা পাণ্ডুলিপি হিসেবে পেয়েছি সেগুলি তো কাটাকুটি বা বাতিল পৃষ্ঠাদের বাদ দিয়ে। কবি যা লিখে গেছেন, আমরা যা পেয়েছি, তাছাড়াও কত শত পৃষ্ঠা যে বাতিল করেছেন, তার হিসেব কে রেখেছে? ভেবে দেখুন, একটি লেখা জুতসই করে লিখতেই আমরা হিমশিম খাই। আর রবিঠাকুরের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত, মুদ্রিত বা হস্তাক্ষরের পাণ্ডুলিপি ছাড়াও যে কী পরিমাণ লেখা লিখে গেছেন— ভাবলে অত প্রকাণ্ড, যেন অন্তবিহীন কবিজীবনের প্রতি আপনা-আপনিই বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়।
এক একজন মহামানুষের এক জীবনের লেখা, আমার ক্ষুদ্র ধারণায়, মনে হয়—যে কোনও মানুষ বা পাঠক তার একক জীবনে পড়ে শেষ করতে পারেন কি? এবং গর্ব করে বলতে পারেন কি, ‘‘আমি আগাগোড়া সমস্ত ‘রবীন্দ্রনাথ’ পড়ে শেষ করেছি?’’ মনে হয় না। জানি না, শুনিনি।
সব শেষে বলব একটি গোপন কথা। আজ যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মাতেন বা জীবিত থাকতেন, তাহলে তাঁর স্বহস্তে লেখা হাজার হাজার পত্র আমরা পেতুম কি? লেখালেখির বদলে ‘কমিউনিকেশন’ করতেন টেলিফোনের মাধ্যমে। ইন্টারনেটও আমাদের সঙ্গে ‘আমাদের আপন’ কবির সম্পর্কের মধ্যে মস্ত অন্তরায় হয়ে দাঁড়াত। কবিগুরুকে এবং তাঁর সকল সৃষ্টিকে প্রণাম জানিয়ে একটি স্বীকারোক্তি করব। অমন প্রকাণ্ড মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার ভরপুর ইচ্ছা থাকলেও, বেশি কথা বলতে মোটেই ভরসা পাই না। কারণ, তাহলে প্রকাশ হয়ে পড়বে যে, রবিঠাকুর বিষয়ে আমি কত কম জানি! তার জন্য, হে কবি, এই নগণ্য ক্ষুদ্র তোমার সেই ‘আকন্দ’র মানুষকে ক্ষমা করে দিও। প্রণাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy