Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
(প্রথম সংখ্যার পর)

তাঁরই হাঁটা পথে

ভ্যাটিকান শহরে বর্তমান রোমের বা পৃথিবীর কোনও শহরেরই আধুনিকতার শোরগোল নেই। ফলে এই সেন্ট পিটার গির্জার চৌহদ্দির মধ্যে এক বার ঢুকে পড়লে মনে হবে জগৎময় পার্থিব গোলমাল, হানাহানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা তথা শব্দ দূষণের আওতায় দমবন্ধ হয়ে আসছিল ‘শান্তির’ ‘নৈঃশব্দে‌’র। এখানে এই ঈশ্বরের শহরে নিশ্চিন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে। তাই অ্যাতো বিশাল জন সমাবেশে সামান্য গুঞ্জনের আওয়াজ আছে বটে, তবুও চারপাশে কেমন প্রশান্তি বিরাজ করছে। মনতাজ-এ মিলন মুখোপাধ্যায়।ভ্যাটিকান শহরে বর্তমান রোমের বা পৃথিবীর কোনও শহরেরই আধুনিকতার শোরগোল নেই। ফলে এই সেন্ট পিটার গির্জার চৌহদ্দির মধ্যে এক বার ঢুকে পড়লে মনে হবে জগৎময় পার্থিব গোলমাল, হানাহানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা তথা শব্দ দূষণের আওতায় দমবন্ধ হয়ে আসছিল ‘শান্তির’ ‘নৈঃশব্দে‌’র।

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৩৮
Share: Save:

এই গির্জায় জোরে কথা বলা যায় না। বারণ নেই। তবু বলা যায় না। সবাই ঘুরে তাকাবে আপনার দিকে। ভুরু কুঁচকে চোখ পাকিয়ে। মানুষ-মানুষি বা খেলনা পুতুলেরা, সাবেক কালের পাথরে তৈরি মূর্তিরা, সিংহাসনে শুন্যতা সবাই আপনার দিকে বকুনি দেবার মতো তাকাবে। বেশি শব্দ করে হেসে ফেললে হয়তো গোটা সেন্টপিটার গির্জা তার সমস্ত ইতিহাস, বিশ্বাস এবং সমগ্র সৌন্দর্য নিয়ে ভেঙে পড়বে আপনার ওপর। মারিয়ার মা বাতাসের শব্দে প্রায় শোনাই যায় না এমন মৃদু কণ্ঠে জানালেন, ‘‘তোমরা যাও। ঘুরে এসো। আমি আর উপরে উঠতে চাই না। বরং, এই খানে নতজানু হয়ে ততক্ষণ উপসানা করি।’’

সিঁড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ করলাম, মেঝেতে দাগ দিয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত নানান গির্জার নাম খোদাই করা রয়েছে। বুঝলুম, সেন্ট পিটারের শেষ প্রান্ত থেকে এই অবধি অমুক গির্জার আয়তন। আর একটু এগিয়ে। আবার দাগ কাটা। পাশে লেখা অপর একটি গির্জার নাম। এমনি করে পৃথিবীর অন্তত সাত-আটটি প্রাচীন ঐতিহ্যময় চার্চের থেকে সেন্ট পিটার আয়তনে কত বড় তা দেখানো হয়েছে।

পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলুম দুজনে। ঘোরানো সিঁড়ি। কুতুব মিনার বা আমাদের সাধের ‘মনুমেন্ট’ অথবা ‘শহিদ মিনারের’ মতোই। তবে এটি বেশ চওড়া। নিরেট বড় বড় পাথরের সিঁড়ি। দু’ধাপ আগে আগে মারিয়া উঠছে। উত্তেজিত পাখির মতো দেখাচ্ছে ওকে। সার বেঁধে অনেক লোক উঠছে আমার আগে পেছনে। শুধু উঠছে। নামার পথ ভিন্ন।

মাটি থেকে একেবারে মাথার ওপরে ক্রুশ চিহ্ন পর্যন্ত উচ্চতা একশো বত্রিশ মিটার। অন্তত শ’খানের মিটার তো ঠেলে উঠতেই হবে। পাঁচশো সিঁড়ি। বেলা বাড়তে বাড়তে মধ্যাহ্ন শেষের ইঙ্গিত পাই। বুকে ধরে হাঁফ, টান ধরে শিরায় শিরায়। চারপাশের দেওয়ালে উৎসবের বাজনা বাজছে মনে হয়। খৃষ্টের জন্মদিন ও ইংরেজি নতুন বছরের যুগল উৎসব চলে এখানে সাত দশ দিন ধরে। ক্লান্ত পায়ে সিঁড়ি ভাঙছি আলো অন্ধকারে। এক দঙ্গল ভিড় এগিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। পেছনে দলের গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছি পাথরের দেওয়ালে দেওয়ালে। ওরই মধ্যে খুব কাছে থেকে সুর ভাসছে। যেন পিঠ পিছনের ধাপে কেউ দাঁড়িয়ে পড়েছে কানের কাছে। ফিসফিস করে ‘ক্রিশমাস ক্যারল’ গাইছে।

‘‘ We wish you a merry chrismas and a happy new year’’

বড়দিনের শুভেচ্ছা ও কয়েক দিন আগে যে নতুন বছর সুরু হয়েছে, তাকে স্বাগতম জানিয়ে ‘বিশ্ববাসীর ভাল হোক’ প্রার্থনার আনন্দময় সুর।

‘‘ So this is x’mas/what have you done? Another year over a new one just begian so, this is x’mas/I hope you have fun…. For the near and the dear one,

The old the young/very merry chrismas/and a happy new year…for the weak and the strong/for the rich and the poor.The war is so wrong/Hope it’s a good one….’’

দারুণ সুরে, মন ভরে গিয়ে চোখে আপনা আপনি জল এসে যাবার মতো আন্তরিক গান বাজছে ডান দিকের এবং বাঁদিকের কানের কাছে। তারপাশে।

দু’পাশে পেছনে তাকিয়ে ঘুরে দেখি কেউ নেই। পেছনে সফরকারীদের দলের গুঞ্জন উঠে আসছে। কেমন যেন অস্বস্তি লাগল। ক্লান্তি কাটিয়ে ওপরে উঠতে লাগলুম। মারিয়াকে দেখা যাচ্ছে না। ওকে ধরে ফেলবার চেষ্টায় দ্রুত উঠছি আবার ওই কণ্ঠস্বর পেছনে, দু’পাশে। নাকি সারা দেবালয় জুড়ে? অথবা, নিজের মনের অন্দরমহলে?! ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। অনেকটা দেশের শেষ রাতে হালকা শিশির পড়ার মতো, অথবা এই বিদেশে বর্তমান সময়ে তুষারপাতের মতো হাল্কা, ফিসফিস করে কথা বলার মতো কণ্ঠস্বর। অথচ, গম্ভীর এবং ক্লান্ত, এখনও তোমাদের জীবিত প্রাণের মায়ায় জড়িয়ে রয়েছি—চারিদিকের ভার বোঝা বয়ে বয়ে দিন যাপন—’’….

পেছনের দলবল উঠে এসেছে প্রায়। স্তম্ভিত, মন্ত্রমুগ্ধের মতো অস্ফুট ইংরেজি কথাগুলি শোনাবার চেষ্টা করছি। ভয় সরিয়েও দিতে পারছি না। অথচ, একলা এই আধো-অন্ধকার সিঁড়িতে দাঁড়াতেও কেমন গাছমছম করছে। ভাগ্যিস এই বিলিতি সংসার কাচ্চাবাচ্চা সমেত কিচিরমিচির আওয়াজ তুলে, খলবলিয়ে উঠছে। পায়ে পায়ে ওদের সঙ্গ নিলুম। ধন্ধ কাটল না।

ঘুরে ঘুরে পাথুরে চওড়া সিঁড়ি। যুগ যুগান্তর ধরে শিল্পীদের হাতে হাতে এর ভোল পাল্টেছে। নকশা বদলেছে। অজস্র শিল্পীর স্পর্শ দেওয়ালে দেওয়ালে। অনেক সময়ের। ‘‘কুপোলো’’ তৈরির ব্যাপারে চিত্রশিল্পী র‌্যাফেলকে ডাকা হয়েছিল। নানা কারণে-অকারণে প্রায় তিরিশটি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। হাত দেননি কাজে। তার পর এসেছে মাইকেল অ্যাঞ্জেলো। ১৫৪৬ সালে। এখানকার স্নেট পিটার গির্জার ‘‘কুপোলা’’ বা প্রধান গম্বুজটি তাঁর প্ল্যান অনুযায়ী তৈরি হয়েছে।

মিনারের মাঝামাঝি পথ সিঁড়ি বেয়ে ওঠবার পর গম্বুজের ভেতরের ঘেরা বারান্দা সারা গম্বুজ ঘিরে চক্রাকার। রেলিং ধরে নীচে চোখ যেতেই টের পেলুম অনেক উঁচুতে উঠে এসেছি। পাঁচ-ছ’তলা তো হবেই। সুবিশাল বৃত্তাকার হলঘরের মতোনই নীচের গির্জার চত্বর। প্রচুর মানুষ-মানুষির জমায়েত। হঠাৎ খেয়াল করলুম এখানে দাঁড়িয়ে সম্মিলিত গুঞ্জনের ভেতরে আর কোনও অলৌকিক ধ্বনি বা গান অথবা কথা কানে আসছে না। সেই অপ্রাকৃতিক তুষারপাতের শব্দ আর বাজছে না মনের কল্পনায় বা বাস্তবে। যাকগে ভুলেই গেলুম চারপাশের মহার্ঘ দৃশ্যাবলিতে চোখ পেতে। ওপরে তাকালুম এ বার। ছোট ছোট চৌকো মার্বেল পাথরে বা মোজাইক গায়ে গায়ে একের পর এক লাগিয়ে বিরাট আকারের ছবি সারা দেওয়াল জুড়ে। গম্বুজের চক্রাকার দেওয়ালে মস্ত ‘মিউরাল’। পাশাপাশি ছোট্ট দুটি টুকরোয় রঙের বা আলোছায়ার প্রভেদ এত সামান্য যে চোখেই পড়ে না। হালকা-গাঢ় রং, উজ্জ্বল আলো এবং গভীর ছায়া সুন্দর ভাবে মিলে গেছে। খুঁটিয়ে এ সব লক্ষ করছি, ধীর পায়ে গোল গম্বুজের গায়ে গায়ে ঘুরছি।

চোখের আড়াল হয়ে গিয়েছিল মারিয়া। হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হল। জিগ্যেস করলে,

‘‘এ কি? এখানে কতক্ষণ ঘুরবেন! ওপরে যাবেন না?’’

‘‘আবার ওপর কীসের?’’

‘‘ওমা! আরও ওপরে সিঁড়ি আছে। আপটু টপ। কাম অন….।’’

আগের মতোই ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলুম। পাথরের পর এ বার লোহার সিঁড়ি। ঘুরছে ঘুরছে। যখন ছাতে পৌঁছুলুম, দমশুন্য বুক নিয়ে কোথাও বসতে পারলে বাচি। ঝড়ের মতোনই বাতাস বইছে। দমকা নয়, একটানা। ধুলোর চিহ্নমাত্র নেই। বিশুদ্ধ রোমের প্রাচীন বাতাসে হা-ক্লান্ত এবং ধুমসো গরম পোশাকের ভেতরে গলদ ঘর্ম শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। ছাত, মানে, গম্বুজের চূড়ার চারিপাশ ঘিরে চক্রাকারে বারান্দা। কলকাতার মনুমেন্ট বা শহিদ মিনারের মতো। এখন ওপরে, খুব কাছাকাছি গির্জার ক্রশচিহ্ন। বিশাল স্তম্ভ বা থামের তৈরি গম্বুজের চূড়া এত বড় যে, যেখানে দাঁড়িয়েছি তার ও পিঠে কী আছে দেখা যায় না। আস্তে আস্তে চক্রাকারে হাঁটছি হাত-পা ছেড়ে নয়। কেননা, চারপাশের ঘেরানো জায়গা খুবই সংকীর্ণ। রেলিংয়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে আর দেখতে হবে না। পাথরে ঘা খেতে খেতে পতন ছিন্নভিন্ন শরীর।

ঘুরে অন্যপাশে যেতে দেখি, স্তম্ভের দেওয়ালে হেলান দিয়ে মানুষটি দাঁড়িয়ে শুন্য চোখে সামনে, নীচে চেয়ে আছেন। হালকা বৃষ্টি বরফের ছাঁটে চোখে আবছা দেখায় সেই ঘষা কাঁচের মতো ঝাপসা দেওয়ালের ওপাশে চোখ রেখে মনে মনে শিউরে উঠলুম। এ কাকে দেখছি!? বাতাসের একটানা হু হু আওয়াজ ছাপিয়ে সেই তুষারপাতের মতো রোমাঞ্চকর কণ্ঠস্বর। যেন দিকবিদিক থেকে ভেসে আসছে। অথবা নিজের ভেতরেই বাজছে।

‘‘আমি তোমাদের কাছেই রয়েছি যেমন ছিলাম দু’হাজার বছর আগে’’

তুষার জলকণায় ভেজা, ঝাপসা চোখের সামনে কয়েক হাত দূরেই রয়েছেন, তবুও স্পর্শের নাগালের বাইরে। রুক্ষ, অযত্নের গোঁফ দাড়ি বাতাসে উড়ছে। গায়ে ছেঁড়া কালছে কম্বলের টুকরো। কৌপীনের মতো মলিন কাপড়ের ছিন্ন অংশ। অসাব্যস্ত কটা দীর্ঘ চুল এলোমেলো। মুখ কী অল্প অল্প নাড়ছে। কী যেন বলছেন বিড়বিড় করে। ভারতে হয়তো পথেঘাটে এমন পাগল বা ভিখারিকে দেখা যায় অহরহ। কিন্তু এখানে? এই দেবালয়ের চূড়ায়!?

‘‘তোমাদের জন্যে ‘উৎসব’ বয়ে এনেছি। নতুন বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষা। তোমরা ভাল হও। ভাল থেকো। ওই যে নীচে, দূরে ‘টিগ্রিস’ নদীর পাশে ‘ইউফ্রাতেনে’ বড় ঘিঞ্জি বস্তি ‘টিগ্রিস’ নীদের পাশে ‘ইউফ্রাতেনে’ বড়, ঘিঞ্জি বস্তি রয়েছে—ইহুদিকে ‘ঘেটো’, ‘টেস্টে ভিয়ার’ লেফট ব্যাঙ্কের চার ধারের দরিদ্র-দুঃখিত মানুষ জন ওদের ভালবাসা, একটু ভরসা দিও। আলো দিও। রং-আনন্দ দিও।’’

রোমের ভ্যাটিকান শহরের অবাস্তব হওয়ায় কেমন যেন দৈববাণীর মতোন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত ইচ্ছে প্রকৃত-অপ্রকৃত ক্লান্ত কণ্ঠস্বর। অথবা আমিই হয়তো অবচেতন অন্তরের মধ্যে কল্পনা-বাস্তবের সীমারেখা বুঝতে পারছি না। হু হু বাতাসই যেন এই সব কথাগুলি আমার অর্ধ চেতনার মধ্যে কারও কণ্ঠস্বরে বাজছে।….

আসলে গোটা শহর জুড়েই যেন যিশুখ্রিস্ট বিরাজমান। তাঁরই উপস্থিতি দিকে-দিগন্তে। এই প্রাচীন গির্জায়, এই রোম শহরে, বাতাস হয়তো তাঁরই বাণী বয়ে বেড়াচ্ছে যুগ যুগান্তর ধরে।

সিক্ত চোখে, ক্লান্ত অবসন্ন শরীর এলিয়ে পাথরে বসে পড়লুম। অ্যাতো ভেদাভেদ মানুষ-মানুষে যে মানুষের জন্যে ঈশ্বরের পুত্র তাঁর প্রাণ দিয়েছেন, দুঃখি-দরিদ্র-হতভাগ্যদের মানুষের মতো জীবনযাপন যাতে করতে পায় তারই জন্যে ভয়ঙ্কর ভেজা কাষ্ঠদণ্ড বা ক্রুশদণ্ড নিজেই বয়ে এনেছিলেন আজও কি সেই ভার তিনি বহে বেড়াচ্ছেন? কে জানে!

এবং এই একটানা বাতাসেই যেন সেই মসীহার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাচ্ছি আশীর্বাদ করছেন আমাদের সব্বাইকে, —‘‘ভাল থাকো ভালো হও আমেন’’।

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

vatican church mumbai
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE