Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

আসুন এ বারও সবাই বইমেলায় যাই

কলকাতা বইমেলার বয়স হতে চলল ঊনচল্লিশ। ১৯৭৬-এর ৩ মার্চ ৫৪টা স্টল নিয়ে বিড়লা তারামণ্ডলের উল্টোদিকে ছোট মাঠটায় যে বইমেলা শুরু হয়েছিল তার এই ৩৯ বছরের যাত্রাটা কেমন? তথ্য বলবে ক্রমশ ফুলতে থাকাই সেই যাত্রার চরিত্র। তার খতিয়ানের জন্য একটি তালিকাই যথেষ্ট। সে মেলার প্রধান পণ্য যতই আন্তর্জাতিক বলা হোক না কেন, বাংলা বই। আর সে বইয়ের অবস্থাটা কী?

শর্মিষ্ঠা দত্ত
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

কলকাতা বইমেলার বয়স হতে চলল ঊনচল্লিশ। ১৯৭৬-এর ৩ মার্চ ৫৪টা স্টল নিয়ে বিড়লা তারামণ্ডলের উল্টোদিকে ছোট মাঠটায় যে বইমেলা শুরু হয়েছিল তার এই ৩৯ বছরের যাত্রাটা কেমন? তথ্য বলবে ক্রমশ ফুলতে থাকাই সেই যাত্রার চরিত্র। তার খতিয়ানের জন্য একটি তালিকাই যথেষ্ট। সে মেলার প্রধান পণ্য যতই আন্তর্জাতিক বলা হোক না কেন, বাংলা বই। আর সে বইয়ের অবস্থাটা কী?

অনেকে বলবেন, বইমেলায় তো অনেক নতুন বই প্রকাশিত হয়. হয় বটে, কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখুন এমন বিশালবপু বইমেলায় প্রকাশকের ঘরে কটি নতুন আর কটি পুরনো বহু পুরনো গ্রন্থসকল. বিপণনের প্রথম কথা পণ্য। বাংলা বই নামক পণ্যটি কী ভাবে ‘তৈরি’ হয় কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায়? অধিকাংশ বই তৈরির তিনটি মাত্র ধাপ। এক, লেখক-প্রকাশক কথাবার্তা (অধিকাংশ ক্ষেত্রে, প্রকাশকের খরচ নেই, বই ছাপার খরচ দেন লেখকই)। দুই, পাণ্ডুলিপির প্রেস ও দপ্তরির ঘর গমন। তিন, প্রচ্ছদ তৈরি (অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডিটিপি অপারেটরেরাই প্রচ্ছদশিল্পী) এবং বাঁধাই।

বারো মাসে তেরো পার্বণে আর একটি নতুন পার্বণ এ বছর যুক্ত হল, বই-পার্বণ। বইমেলা নামে বই নিয়ে একটি বিস্তর বাড়াবাড়ি প্রতি বছর সরকারি আনুকূল্যে ঘটে থাকে। সেটা মোটামুটি বাঙালির গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সদ্য গোলদিঘিতে আতসবাজি-সহকারে যে উৎসবটির সমাপন হল সেটিকে, এককথায় বলা যায় এক ধরনের সুভাষণ।

ঘরে চাল না থাকলে গৃহিণীরা বলে থাকেন চাল বাড়ন্ত। বিশ্ব বই দিবস উপলক্ষে এত কাল বইয়ের যে গুদাম সাবাড় সেল আয়োজন করতেন পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড, সেই বইবাজারই এখন বই-উৎসব।

আসলে বাজার শব্দটা বাঙালি বইটইয়ের ক্ষেত্রে কোনও দিনই খুব ভাল মনে নেয় না। তেল-সাবান, চিনি-নুন, শাড়ি-জামার মতো বইটাও যে একটা পণ্য এটা ভাবতেই আমাদের কষ্ট হয়। আর, হাতিবাগানের চৈত্র সেলের সঙ্গে কলেজ স্কোয়্যারে গ্রন্থসেলের যে বিশেষ কোনও ফারাক নেই সে কথাটা বলতে গেলে বিদ্বজ্জন বাঙালি বুঝি তেড়েই আসবেন রে রে করে।

কিন্তু এই প্রশ্ন যদি তোলা যায় যে এত বই কেন?

এই প্রশ্নে স্পষ্টত, কোনও সম্পাদকের স্থান নেই। লেখক কী লিখলেন, তথ্য ও যুক্তি কতদূর ঠিক থাকল সেটি দেখে দেওয়ার কেউ নেই। তারই ভূরি পরিমাণ ফসল ছড়িয়ে থাকে বাংলা বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। আর অধিকাংশত সে সব নিয়েই বছরে এই বইপাড়ায় তৈরি হয় প্রায় আড়াই হাজার নতুন বই। পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের হিসেব অনুযায়ী, কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ৫০০ প্রকাশক আছেন।

পরিমাণটা আপাতদৃষ্টতে, নেহাত কম নয়। একটি আঞ্চলিক ভাষায় প্রতি বছরে প্রকাশকপিছু গড়ে পাঁচটি করে নতুন বই হিসেবটা সারা ভারতে বইপ্রকাশের গড় হিসেবের কাছাকাছিই। কিন্তু পরিমাণে তুল্যমূল্য হলেও গুণমানে িবেশ্বর তো দূরস্থান, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রকাশনার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এমন প্রকাশনা দু আঙুলেই গুনে শেষ করা যায়, এমনটাই মনে করেন বইবিশেষেজ্ঞরা।

কিন্তু কেন? অনেকের মতে কারণটা ভাষাগত। যেমন বলছেন আনন্দ পাবলিশার্সের সুবীর মিত্র, ‘‘ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের একটা বিশ্ববাজার আছে। বাংলা বইয়ের বাজার অত্যন্ত সীমিত। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ছাড়া আর যা কিছু বাংলা বইয়ের বিক্রি তার প্রায় সবটাই প্রবাসী বাঙালিদের কাছে। বাংলাদেশ একটা বড় বাজার হতে পারত, কিন্তু সেখানে এ বাংলার প্রকাশকদের বই-ই বিক্রি হয়, কেবল সেগুলো এখানকার ছাপা নয়। ফলে প্রোডাকশন তুলনায় খারাপ হবেই। তবু সীমিত বাজারেও এখন বাংলা বইয়ের যথেষ্ট ভাল প্রোডাকশন হচ্ছে।’’

‘প্রোডাকশন’ মানে কী? প্রচ্ছদ, বাঁধাই, কাগজ, ছাপা সাধারণ ভাবে ‘প্রোডাকশন’ বলতে এটাই বোঝেন বেশির ভাগ বাঙালি প্রকাশক। কিন্তু পাণ্ডুলিপি থেকে বই হয়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াটিকেই ‘প্রোডাকশন’ বলা উচিত। সে প্রক্রিয়ায় প্রথম কাজ হওয়া উচিত পাণ্ডুলিপি ছাপতে দেওয়ার জন্য ‘তৈরি’ করা এবং বার বার প্রুফ দেখে বইয়ের টেক্সট বা মূল পাঠ্যকে বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য করা আর সে কাজে যে কী বিপুল পরিমাণ অবহেলা দু’একটি চাল টিপে দেখলেই তা স্পষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে সুবোধ ঘোষ, জীবনানন্দ থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে এমন প্রায় কেউ নেই যাঁর লেখায় প্রকাশকের কল্যাণে কমবেশি পাঠবিকৃতি না ঢুকেছে।

বাংলা বই নামক ‘প্রোডাক্ট’টির গুণমানের হাল মোটের উপর এই। আর, অনেক প্রকাশকের মতে বাণিজ্যের সঙ্গেই নাকি জড়িয়ে আছে বইয়ের গুণমান। বাংলা বইয়ের ব্যবসাটা যেহেতু সামগ্রিক ভাবে মার খাচ্ছে নানা কারণে, তাই অর্থাভাবে গুণমানের ক্ষেত্রেও বাংলা বই অনেক পিছিয়ে। বস্তুত হাতে গোনা দু’একটি প্রকাশক ছাড়া বাংলা বইপাড়ায় গ্রন্থ সম্পাদক বলে কেউ নেই। তারও কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে, প্রকাশকদের বক্তব, ‘অর্থাভাব’। কিছু কাল আগে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে গ্রন্থ-সম্পাদক শমীক বেন্দ্যাপাধ্যায় যেমন বলছেন, ‘‘ভারতীয় বাজারের সঙ্গে তুলনায় বাংলা বইয়ের অধিকাংশ সম্পাদকেরা এতই কম পারিশ্রমিক পান যে তাঁদের কাছ থেকে ভাল কাজ আশা করা বৃথা। তা ছাড়া বাংলা বইয়ের জগতে সম্পাদক বলতে ঠিক কী সে ধারণাটাই তৈরি হয়নি।’’ অনেকের মতে, সম্পাদকের এই অভাবের ফলেই অধিকাংশ বাংলা বইয়ের পাঠ থেকে প্রচ্ছদ সবই যেনতেনপ্রকারেণ বাজারজাত হয়।

কিন্তু গ্রন্থ-সম্পাদক নেই কেন? এর কারণ নানা রকম. একটা হতে পারে, আঞ্চলিক ভাষা বাংলাটা আর তেমন করে শেখার দরকার পড়ছে না এই ই-দুনিয়ায়। আর একটা, গ্রন্থ-সম্পাদনাও যে একটা পেশা হতে পারে, সেটা খায় না মাথায় দেয় সে বিষয়েই ধারণা এখনও গড়ে ওঠেন. অথচ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর আগেই চালু হয়েছে প্রকাশনার পাঠ্যক্রম। যাদবপুরেও পড়ানো হয় বিষয়টি. আর অতি সম্প্রতি সিগাল চালু করেছে এমন একটি পাঠ্যক্রম। প্রশ্ন হল, এ সব পাঠক্রম থেকেও কি কেউ উঠে আসছেন না? সবিতেন্দ্রনাথবাবুর অভিজ্ঞতা, কিছু কাল আগে বলেছিলেন, ‘‘আমাকে ওখানে বলতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কথা বলে বুঝেছি আর পাঁচটা বিষয়ের মতো বই সম্পাদনার বিষয়টাও পরীক্ষা পাশের মতো করে শেখানো হয়।’’

এর পাশাপাশি আছে বাংলা বইয়ের অলংকরণ। কিন্তু পঞ্চাশের দশক তো অনেক পরের কথা, এমন বিবিধ চমক লুকিয়ে থাকা যে বাংলা গ্রন্থচিত্রণের ইতিহাস তার কিছুটা বিচার না করলে বা সেই পূর্ব প্রেক্ষিতটি ছাড়া সত্যজিতের শিল্পী প্রতিভাটি বুঝে নেওয়া যাবে না. বাংলা গ্রন্থচিত্রণের প্রায় একশো বছরের ইতিহাসে। ১৮১৬ সালে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ‘অন্নদামঙ্গল’ অলংকরণ করেছিলেন রামচাঁদ রায়, শুরু সেই থেকে। তার পরে চোখভোলানো, মন জাগানো কত কাজ ছড়িয়ে আছে এবং হারিয়ে যেতে বসেছে পত্রপত্রিকার পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার অলংকরণ করেছিলেন ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, বঙ্কিমের উপন্যাস ‘চন্দ্রশেখর’ পুরোপুরি ছবিতে কমিকসের ঢঙে ফেলে তৈরি হয়েছিল চন্দ্রশেখর চিত্রে, তার শিল্পী ছিলেন নরেন্দ্রনাথ সরকার। একেই কি তবে আজকের পরিভাষা অনুযায়ী বলা যাবে ‘গ্রাফিক নভেল’। সাহিত্যসংরূপের সেই তর্ক থাক, মোটামুটি ভাবে বলা যেতে পারে বাংলা গ্রন্থচিত্রণের এই দীর্ঘ ধারায় একটা বৈশিষ্ট্য হল খুব কম শিল্পীই ন্যারেটিভ-এর বাইরে বেরিয়ে গিয়ে অন্য রকম কাজ করেছেন। আসলে গল্প বা উপন্যাস ঠিক যে ঘটনা বিবৃত করছে ঠিক সেটিরই চিত্ররূপ দেওয়াটাই অলংকরণশিল্পীর কাজ বলে মনে করতেন অনেকে. অলংকরণটাও যে একটা শিল্প এবং সেখানে যে সম্পূর্ণ একটা নতুন মাধ্যমে বিষয়টিকে দেখা আর নতুন মাধ্যম বলেই যে তার রীতি ও প্রকরণগত বিশিষ্টতার কারণেই সেখানে আর একটি মাধ্যমের ঘটনা বা কাহিনির যথাযথ চিত্ররূপ দেওয়াটা যে শিল্পের প্রাথমিক শর্ত মেনেই অসম্ভব এই বোধটা জাগতে অনেক সময় নিয়েছিল. তাই বাংলা অলংকরণের ইতিহাসের একটা বড় সময় ধরে শিল্পীরা মুখ্যত রীতি ও কৌশলের অসামান্য ঐশ্বর্য সত্ত্বেও সকলেই প্রায় গল্পটাই বলেছেন ছবির ভাষায়। ব্যতিক্রম কেবল রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, সত্যজিৎ রায়, কিছুটা পূর্ণেন্দু পত্রী এবং হিরণ মিত্র যাঁরা ছবির ভাষায় রচনার একটা আলাদা ভাষ্য দিতে চেয়েছেন. কিন্তু সে পথ আলংকারিকের ঠিক পথ হওয়া উচিত কি না সে নিয়ে তর্ক উঠতে পারে।

পণ্যটি সুনির্মিত কিনা সেই প্রশ্ন তার বিপণনের সময় ওঠে। আর এই সুনির্মাণে অলংকরণ থেকে সম্পাদনা বই তৈরির সব দিকই জড়িত। সেখানে খামতি থেকেই যায় বাংলা বইপাড়ায়।

সে কারণেই কি বইপাড়ার অধিকাংশ প্রকাশক তাকিয়ে থাকেন বইমেলার দিকে? পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চেট্টাপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বইমেলা তো অবশ্যই বাংলা বইয়ের ব্যবসার জন্য দরকার।’’ দে’জ পাবলিশিংয়ের সুধাংশুকুমার দে বলছেন, ‘‘বইমেলায় বই বিক্রি হওয়ার আশা যতটা না থাকে তার চেয়েও বেশি থাকে অনেক পাঠককে বই দেখানোর আশা। কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকদের সে ভাবে কোনও শোরুম নেই, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বই বিক্রিটাও আয়ত্ত হয়নি অনেকের, ফলে বইয়ের বিপণনে এখনও বইমেলাই ভরসা।’’ সুবীরবাবু অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্নমত। বললেন, ‘‘বই বিপণনের নানা পদ্ধতি আছে। বইপাড়ায় আনন্দই প্রথম টেলিফোনে অর্ডার নিয়ে বাড়িতে বই পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করে। তা ছাড়া শহরের দু’প্রান্তে আমাদের নিজস্ব শোরুমও আছে। এখন আমরা নানা জায়গায় আরও শোরুম খুলছি.’’

দুর্বল বিপণনের জন্য বাণিজ্য হয় না, বাণিজ্যে মন্দা বলেই বই-পণ্যের মান নিচু, আবার নিচু মানের পণ্য বলেই বাণিজ্যও দুর্বল ডিম-মুরগি ধাঁচের এই ধাঁধাবৃত্তের প্যাঁচেই আপাতত ফেঁসে আছে বাংলা বই।

কিন্তু বই মেলা তবু জমজমাট হওয়ারই আশা, এই চল্লিশের প্রায় দোরদোড়ায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sharmistha dutta mumbai anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE