Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

উৎসব-পার্বণ-ছুটি, জানুয়ারি ডাকছে

পৌষ-মাঘ মেতে থাকে উৎসবে, পার্বণে, ছুটিতে। জানুয়ারি কলিং। উৎসবের আবহে লিখলেন মধুছন্দা মিত্র ঘোষ।নতুন বছর পড়তে না পড়তেই সময় তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলেছে। যেমন যায়। এই তো সে দিনই নতুন বছরের ক্যালেন্ডার আমাদের দরজায় সাজিয়ে দিল টাটকা ৩৬৫ দিনের বারমাস্যা। আমাদের প্রার্থিত চাওয়া-পাওয়া। আমাদের আগামী। আমাদের ঘটমান ভবিষ্যৎ। শীতের ফুটফুটে আমেজ মেখে জানুয়ারি মাস। উৎসবের আতিশয্যে, রঙে, মজলিসে, দেদার খুশি-খুশি অমোঘ প্রবণতায় পৌষ-মাঘ। ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি মানেই বনভোজন।

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

নতুন বছর পড়তে না পড়তেই সময় তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলেছে। যেমন যায়। এই তো সে দিনই নতুন বছরের ক্যালেন্ডার আমাদের দরজায় সাজিয়ে দিল টাটকা ৩৬৫ দিনের বারমাস্যা। আমাদের প্রার্থিত চাওয়া-পাওয়া। আমাদের আগামী। আমাদের ঘটমান ভবিষ্যৎ। শীতের ফুটফুটে আমেজ মেখে জানুয়ারি মাস। উৎসবের আতিশয্যে, রঙে, মজলিসে, দেদার খুশি-খুশি অমোঘ প্রবণতায় পৌষ-মাঘ। ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি মানেই বনভোজন। নতুন বছরের পয়লাই হোক কিংবা মনীষীর জন্মদিন, গোটা জানুয়ারির শনি-রবি, অন্যান্য ছুটির দিন, মকর সংক্রান্তি, প্রজাতন্ত্র— আমাদের মহিমা সারাটা জানুয়ারি জুড়েই।

এই সময়টা একটু উৎসবের আঁচ নিতে বরাবরই কলকাতায় থাকি। ঠান্ডা-মাখামাখি কলকাতা শহরের মরসুমি আমেজে ডুব দিয়ে কাটানো বহু দিনের অভ্যেস। একটু ব্যোমকেশ, একটু ফেলুদা দেখা হয়ে গেছে। ফুলকপির শিঙাড়া, চায়না টাউন, বিশ্ব কবিতা উৎসবে অংশগ্রহণ, লিটল ম্যাগাজিন মেলায় অংশগ্রহণ, লেপ-বালাপোষগুলো বক্স খাটের বন্ধ চৌখুপি থেকে বার করে এপিঠ-ওপিঠ রোদ্দুর খাওয়ানো। কলকাতায় ভরা শীতের রসায়ন মেনে নলেন গুড়ের সন্দেশ-রসগোল্লা থেকে জয়নগরের মোয়াও অনেক হল। কবি, সাহিত্যিক বন্ধুদের সঙ্গে খানিক আড্ডা। কলেজ স্ট্রিট কফিহাউস, পার্ক স্ট্রিট ফ্লুরিজ, কয়েকটা বাংলা সিনেমা-থিয়েটার। ওই মাত্র ক’দিনের জন্য প্রবাস থেকে কলকাতায় ফিরেই কলকাতাকে একটু চেটে পুটে খাওয়া আর কী।

ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে ‘পৌষ সংক্রান্তি’ উৎসব। প্রতিটি উৎসব পালনেরই নিজস্ব প্রথা আছে। গ্রামবাংলায় সদ্য মাঠ থেকে ধানের ছড়া তুলে তা কিছুটা রেখে দেওয়া হয়। নতুন ধান পবিত্র। তাতে লক্ষ্মীর বসত। নতুন ধান ভেঙে যে কনকচূড় খই পাওয়া যায় সেই কনকচূড় খইয়ের পিঠে থেকেই তো মোয়া হয়। নলেন গুড়-এলাচ-ঘি-কাজু-কিসমিস-কনকচূড় খইয়ের অদ্ভুত জাদুকরিতে তৈরি হয় শীত আভিজাত্যের মোয়া।

আর পৌষ সংক্রান্তি মানেই পিঠেপুলি। বাঙালির পৌষ সংক্রান্তির আয়োজনে নারকেল কোরা আর খেজুর গুড়ের অনবদ্য রসায়নে পিঠের মৌতাত। নতুন ধানের চাল গুড়ো, ঘড়াভর্তি খেজুর গুড়ের মায়াবী তরল, পাটালি, পৌষপার্বণ মানেই নবান্নের আহ্বান, সুগন্ধি আতপ চালের সঙ্গে খেজুর গুড়ের অকৃত্রিম পিঠের কৌলিন্য। গোকুল পিঠে, সিদ্ধ পুলি, পাটিসাপটা, রাঙাআলুর পুলি, ছানা পুলি, চুষি পিঠে, দুধ পুলি, রসবড়া, চিতৈ পিঠে— বাঙালির রসনাকে প্রলুব্ধ করতে কত আয়োজন। খেতেও তৃপ্তি। খাওয়াতেও।

আবার এ পার বাংলায় যেটি ‘পিঠে’, ও-পার বাংলায় সেটাই ‘পিঠা’। শীতের দোসর আমাদের কাছে ‘পিঠে’ মানেই মিষ্টি জাতীয় মুখরোচক পদ। খেজুর রস বা চিনির রস-দুধ-নারকেল কোরা দিয়ে প্রস্তুত মিষ্টান্ন। অথচ ওপার বাংলায় নাকি মিষ্টি স্বাদ ছাড়াও কিছু পিঠে প্রস্তুত হয় নোনতা বা ঝাল জাতীয়। যেমন বরিশালের জনপ্রিয় পাকান পিঠা, কিংবা মুগ পাকান পিঠা। এ ছাড়া লকসি পিঠা, চিড়ার পিঠা, আসকে পিঠা, আরও অনেক রকম ‘পিঠা’ প্রস্তুত হয়। শুধুমাত্র নিরামিষ পিঠা নয়। ডিম, শুঁটকি মাছ, মাছ, মাংসও ও-পার বাংলায় পিঠা প্রস্তুতিতে ব্যবহার হয়।

মাঘ পড়তেই, যখন অল্প অল্প করে শীত-শীত ভাব কিছুটা অস্পষ্ট হয়, উত্তুরে বাতাসও খানিক পালটে যেতে থাকে, উৎসব উৎসব গন্ধটা কিন্তু তখনও একটুও ফিকে হয় না। জানুয়ারি থিতু হতে না হতেই, আমাদের ভারতীয় ক্যালেন্ডারের পাতায় দু’দুটো লাল কালির দাগ থাকেই। এ বার আবার তার সঙ্গে ২৫ তারিখও রয়েছে সরস্বতী পুজো।

নেতাজির জন্মতিথি ইদানীং ‘দেশপ্রেম’ দিবস হিসেবে সারা দেশে পালিত হচ্ছে। এটা বাঙালিদের কাছে দারুণ গৌরবের। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে আমরা বাঙালিরা শ্রদ্ধায় অনেক কাছের মানুষ হিসেবে মান্যতা দিয়ে থাকি। নেতাজির মেধা, তাঁর শিক্ষা, তাঁর আদর্শ, তাঁর স্বপ্ন, তাঁর বিপ্লব, তাঁর সেনা-সংগ্রাম— সমস্ত কিছুকেই বাঙালি অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে আজও স্মরণ করে। এমনকী সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর অন্যতম গীতিনাট্য ‘তাসের দেশ’ রচনাটি সুভাষচন্দ্র বসুকে উৎসর্গ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে পূর্ণ সম্মান জানিয়ে তাকে ‘দেশনায়ক’ আখ্যা দেন। এটা তো খুবই প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী এবং একই সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক উপাধি লাভ তদানীন্তন সময়ে সুভাষচন্দ্রের কাছে যথার্থ ও যোগ্য সম্মান তো ছিলই, বাঙালি তথা সমগ্র জাতির কাছেও এটি অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়।

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতা উলটোলে দেখা যায় সুভাষচন্দ্র বসু পর পর দু’বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু গাঁধীজির আদর্শগত সংঘাত, বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করার জন্য তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। আজাদ হিন্দ ফৌজের আদর্শে সুভাষচন্দ্র সশস্ত্র বিদ্রোহের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি সর্বদাই মনে করতেন, গাঁধীজির তথাকথিত অহিংস আন্দোলন ভারতে স্বাধীনতা আনার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সুভাষচন্দ্র বসু ‘অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন, এ আমরা সবাই জানি। ব্রিটিশ শাসনে নেতাজিকে এগারো বার কারাবরণ করতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা লগ্নেই নেতাজি গোপনে ভারত ত্যাগ করেন। তিনি সোভিয়েত রাশিয়া, জার্মানি ও জাপানের কাছে ব্রিটিশ শক্তি প্রতিহত করার জন্য সহযোগিতা আশা করেছিলেন। জাপানিদের সাহায্যে তিনি গঠন করেন ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’।

বাঙালির মননে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব নেতাজির মৃত্যুরহস্য আজও চরম ধোঁয়াশাতে রয়ে গেছে। শাহনওয়াজ কমিশন অথবা খোসলা কমিশন কিংবা মুখার্জি কমিশন কোনও সঠিক মত দিতে অক্ষম হয়। বিখ্যাত সাংবাদিক অনুজ ধরের কিছু দিন আগে প্রকাশিত ‘Indias biggest cover up’ বইটিতে অনেক তথ্য জনগণের কাছে উন্মোচন করা হয়েছে। বিতর্কিত বইটি নিয়ে পাঠকসমাজে যথেষ্ট আলোড়নও হচ্ছে। এ দিকে রেনকোজি মন্দিরে নেতাজির চিতাভস্ম বলে যেটি রাখা আছে সেটির ডিএনএ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জরুরি পরীক্ষা করে জানা গেছে ওই চিতাভস্ম কখনওই নেতাজির নয়। অনেকেরই দাবি, নেতাজির তুমুল জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে উঁচুতলার ভারতীয় নেতারা এবং ইংরেজ সরকার মিলিত ষড়যন্ত্র করে নেতাজিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেন। তাই ভারত সরকার কখনও নেতাজির মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনে সচেষ্ট হয়নি।

নেতাজিকে নিয়ে পরবর্তীতে তৈরি হয়েছে অনেক মিথ। এমনকী গত শতকে উত্তরাখণ্ডের কোনও এক ‘গুমনাম বাবা’ নামের সাধুর সঙ্গে নেতাজির শারীরিক গঠনের আদল খুঁজতে চেয়েছিলেন সে সময়ের কিছু মানুষ। যদিও সে সব কিছুই শেষপর্যন্ত ধোপে টেকেনি। তবু এ সব নিয়ে বহু বিতর্ক বহু আলোচনা পর্যালোচনা হয়েছে। নানা ভাবেই চর্চিত হয়েছে, কালিমা লেপনের চেষ্টা করা হয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়েও। এমনকী এও বলা হচ্ছে এখন যে, রেনকোজিতে রাখা মহার্ঘ চিতাভস্মটিও নাকি নেতাজির নয়। নেতাজির মৃত্যুরহস্য নিয়ে এত ধোঁয়াশা সত্ত্বেও তদানীন্তন ভারত সরকার ও ব্রিটিশ শাসকদলও অদ্ভুত ভাবে ধামাচাপা দিতে চেয়েছেন এই ঘটনাকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় জনগণ কিছু বোঝেন না এমন তো নয়। সব জেনে বুঝেও তারাও থেকে গেছেন নিঃশব্দে।

আজ বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হত ১১৮ বছর। ওড়িশার কটক শহরের বিশিষ্ট আইনজীবী জানকীনাথ বসু ও প্রভাদেবীর নবম সন্তান সুভাষচন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক আদর্শ ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন এবং ধর্মীয় আদর্শ ছিলেন বিবেকানন্দ। স্কুল জীবনে পাঠ্যবইতে পড়া নেতাজির সেই বিখ্যাত উক্তি “তোমরা আমাকে রক্ত দাও। আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।” নেতাজির প্রতি সমর্পিত ‘দেশপ্রেম দিবস’ সামনে রেখেই ঝালিয়ে নেওয়া আমাদের বাঙালিত্ব ও সংস্কৃতিচেতনা ও দেশপ্রেম।

নেতাজি জন্মজয়ন্তীর ছুটিটার আমেজ পেরোতেই রবিবারটা বাঙালির বীণাপাণি আরাধনা। দেবী সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবে পূজিতা হন। সেই জ্ঞান কেবলমাত্র ব্যবহারিক জ্ঞান ও শিক্ষাগত জ্ঞানই নয়। যে জ্ঞানে মানবজীবনের মোক্ষলাভ হয়, সেই জ্ঞানেরও ধারক তিনি। স্বয়ং চতুর্বেদের জননীস্বরূপা দেবী সরস্বতী। প্রাচীনকালে পৌরাণিক ঋষিরাও সারস্বত মন্ত্রে দীক্ষিত হতেন। বেদব্যাস, যাজ্ঞ্যবল্ক, বৃহস্পতি, বশিষ্ঠ, পরাশর, ভরদ্বাজ প্রভৃতি ঋষিরাও সারস্বত মন্ত্র আরাধনা করতেন। মাতৃপূজার ভাবনা তো আমাদের দেশে বহু প্রাচীন। বেদের প্রতিটি অক্ষরভাষ্য বাগদেবী দ্বারাই সৃষ্ট। হিন্দু পৌরাণিক মতে বেদের চারটি ভাগ চারটি স্বরূপ সৃষ্টি করে। ঋক বেদ স্তোত্র ও কাব্য। যজু বেদ গদ্য। সাম বেদ সংগীত এবং অর্থব বেদ মাতৃশক্তি রূপে বিরাজমানা।

“ওঁ ঐং শ্রী শ্রী সরস্বতৈ নমঃ”—‘ঐং’ আবাহন মন্ত্রে দেবী ভারতীয় স্বর্গীয় রূপে মানবজীবনের চারটি দৃষ্টিভঙ্গির অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। বাগেশ্বরী মহাবিদ্যা দেবী সরস্বতীর সমগ্র অবয়ব মন, বুদ্ধি, আত্মস্বরূপ ও অহং এই চার প্রতিরূপের দ্যোতক। সরস্বতী দেবীর পদতলে তাঁর বাহন সাদা রাজহংস হল পক্ষপাতহীন ‘সত্ত্ব’ গুণের আধার। দেবীর শ্বেতশুভ্র বসন বিশুদ্ধতা ও নিগূঢ়তার প্রতিভূ। “শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পশোভিতা” অর্থাৎ শ্বেত পদ্মের আসনে দেবী উপবিষ্টা। “শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা” অর্থাৎ শ্বেতপুষ্পের আভরণ তাঁর সর্বাঙ্গে এবং তাঁর গাত্র বর্ণও সাদা। “শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা” অর্থাৎ তাঁর হস্তে শ্বেত সূত্র এবং শ্বেত চন্দনচর্চিত দেবীর অবয়ব। দেবীর ঋতবীণাটিও শুভ্র রঙা এবং দেবীর প্রতিটি অলঙ্কারও শ্বেতশুভ্র। “শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতলঙ্কারভূষিতা”।

দেবী সরস্বতীর আরাধনা হয় চান্দ্র মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে। জ্ঞান তথা বিদ্যা শিল্প সঙ্গীত নৃত্য বাদ্য কলা সমস্ত সংস্কৃতির দেবী হিসেবে পূজিতা হন দেবী সরস্বতী। পঞ্চমী তিথিতে দেবীর পুজো হয় তাই হিন্দুমতে এই পুজো অনুষ্ঠানকে ‘শ্রীপঞ্চমী’ বলা হয়। আমের মুকুল, যবের শিষ, আবির, অভ্র, হলুদ গাঁদা, দোয়াত, কলম, ফুল, শ্বেত চন্দন, পুস্তক ইত্যাদি অর্ঘ্য উপচারে দেবী সরস্বতীকে আরাধনা করা হয়।

সেই ‘হাতে-খড়ি’ দেওয়া শৈশব থেকে দেখে শুনে আসা শাশ্বত সেই বৈদিক আরাধনা মন্ত্র—

“ওঁ ভদ্রকালৈ নমো নিত্যং

সরস্বতৈ নমো নমঃ

বেদ বেদান্ত বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ।।

এষ সচন্দন বিল্বপত্র পুষ্পাঞ্জলীঃ

ওঁ ঐঁ শ্রীশ্রীসরস্বতৈ নমঃ।।”

দেবী সরস্বতীর একই অঙ্গে অনেক রূপব্যঞ্জনা। একাধারে তিনি শ্বেতবর্ণা, শ্বেতকমল আসীনা, মুক্তমালা পরিহিতা। পদ্মলোচনা। বীণা-পুস্তকধারিণী। চন্দ্রকলা তাঁর মস্তকে বিরাজমানা। শ্বেতপুষ্পে ও আভরণে সুশোভিতা। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে তিনিই পবিত্র সরস্বতী নদী স্বরূপা। কখনও তিনি বাগদেবী। কখনও ভারতী। কখনও বাগেশ্বরী, সারদা, বীণাপাণি, মহাশ্বেতা, শুভ্রা, বিরাজ, শতরূপা, আর্যা। কখনও সারদা অম্বা, বাণী, ব্রাহ্মী, বেদয়িত্রী, মহাবিদ্যা, বিদ্যাদায়িনী।

দেবী সরস্বতীর ঐশ্বরিক প্রভা ও রূপের বন্দনায় সেই শৈশব-কৈশোর থেকে আজও আমরা ‘শ্রী পঞ্চমীর’ সকালে হাতের মুঠোয় হলুদ গাঁদা, দোপাটি ফুলের সাদা পাপড়ি, বেলপাতা কুচি নিয়ে মুদিত নয়নে অঞ্জলি দিই বহু চেনা প্রায় মুখস্থ হয়ে যাওয়া মন্ত্রোচারণে—

“ওম সরস্বতী মহাভাগে

বিদ্যে কমললোচনে

বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী

বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে।।

জয় জয় দেবী চরাচর সারে

কুচযুগশোভিতা মুক্তাহারে

বীণারঞ্জিত পুস্তকহস্তে

ভগবতী ভারতী

দেবী নমোহস্তুতে”।।

এ বার শ্রী পঞ্চমীর পরের দিনই প্রজাতন্ত্র দিবস। স্কুলজীবনে নিচু ক্লাসে পড়ার সময়ে, মানে ওই প্রাইমারি সেকশনে পড়াকালীন প্রায়ই গুলিয়ে ফেলতাম ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ ও ‘স্বাধীনতা দিবসে’র আক্ষরিক অর্থ। সত্যি খুব বিভ্রান্ত হতাম ‘স্বাধীনতা’ দিবসটা কী আর প্রজাতন্ত্র দিবসটাই বা ঠিক কী। কারণ বছরে ওই দুই দিনই স্কুলে পতাকা উত্তোলন। প্যারেড। মার্চ পাস্ট। কুচকাওয়াজ। শেষে স্কুলের প্রত্যেকে ধোপদুরস্ত স্কুল ইউনিফর্মে ‘রিফ্রেশন’, খাবারের প্যাকেট প্রাপ্তি। ওই দুটো দিনই সকাল থেকে জমজমাট অনুষ্ঠান স্কুলে। এমন কী পাড়ায়ও। গমগম করে পাড়ার লাউড স্পিকারে বাজছে “সাঁরে জহাঁসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হমারা” “নান্না মুন্না রাহি হুঁ...দেশ বা সিপাহি হুঁ...বোলো মেরে সঙ্গ জয় হিন্দ জয় হিন্দ জয় হিন্দ।”

১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি ভারত ইতিহাসে নতুন সাংবিধানিক রাষ্ট্রের তকমা দেওয়া হয়। এই নির্দিষ্ট দিনটিতে ‘প্রজাতন্ত্র’ বা ‘গণতন্ত্র’ দিবসের এক রাষ্ট্রীয় পবর্। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে লাহৌরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় জওহরলাল নেহরুর পৌরোহিত্যে। যেখানে লিখিত প্রস্তাব পাঠ করে ঘোষণা করা হয়, ইংরেজ সরকার যদি আগামী ২৬ জানুয়ারি ১৯৩০ এর মধ্যে ভারতে Dominion states এর মর্যাদা প্রদান না করেন, তা হলে ভারত নিজেরাই নিজের দেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করবে। ইংরেজ সরকার আদৌ মানেনি সেই প্রস্তাব। ভারত কিন্তু ১৯৪৭ পর্যন্ত এই দিনটিকে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে এসেছে। এরও পরে স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতকে ‘সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

মুম্বইয়ে প্রজাতন্ত্র দিবসে গত কয়েক বছর যাবৎ ‘ডাব্বাওলারা’ প্যারেডে অংশ নিচ্ছেন। ১২৫ বছরেরও বেশি পুরনো এই পেশাটি মুম্বইয়ে জনমানসে খুবই বিখ্যাত। প্রতিবেদনটিতে এই সম্বন্ধে লিখতে বসেই মনে পড়ে যাচ্ছে বছর দেড়েক আগে প্রকাশিত বহু প্রশংসিত ‘লাঞ্চ বক্স’ সিনেমাটির কথা। সেই সিনেমাটিতে এই ডাব্বাওয়ালাদের রোজনামচা জীবনের ছবি অনেকখানি অংশ জুড়ে আছে। আর আছে ইরফান খান ও ক্যাডবেরি গার্ল নিমরীত কাউরের অপূর্ব অভিনয়। যাই হোক যা বলছিলাম, মহারাষ্ট্র সরকারও আশা রাখেন প্রজাতন্ত্র দিবসে ডাব্বাওলাদের প্যারেড The best tableau of the year হওয়ার দাবি রাখে নিজস্ব মরাঠি অস্মিতা।

নতুন বছর আসে। যায়। একটু আমোদে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে আরও একটু বেশি বেশি ভাল থাকতে চায় সবাই। পৌষ-মাঘ মেতে থাকে উৎসবে, পার্বণে, ছুটিতে। জানুয়ারি কলিং।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mumbai anandabazar madhuchhanda mitra ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE