আকাশের রং ক’দিন ধরেই কী নীল হয়ে উঠেছে, বাতাস আঘ্রান করলে এক সুগন্ধী প্রাণময়তা অনুভব করা যাচ্ছে, ধূসর বর্ণহীন পাতা ঝরে গিয়ে গাছের শাখাগুলো ঢেকে যাচ্ছে কচি কচি নতুন পাতায়। শীতের রুক্ষ দিনের অবসান ঘটিয়ে ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’! আর বসন্ত কালকে রঙে রঙে রঙিন করে তোলে যে উত্সব, তা হল দোলোত্সব বা হোলি খেলা। নতুন করে জেগে উঠে, নতুন আনন্দে নতুন আশায় রঙিন হয়ে ওঠার এই উত্সব শীতল রুক্ষতার আগল ভেঙে বলে ওঠে, “ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল/ স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল, দ্বার খোল দ্বার খোল।’
সেই কোন সুদূর অতীত কাল থেকে এই দোলোত্সব গোটা ভারতের একটি প্রাচীন প্রাণোচ্ছল উত্সবে পরিণত হয়ে মানুষকে মাতিয়ে চলেছে। ফাগের রঙিন স্পর্শে হিন্দোলিত হয়ে অন্তর বলে ওঠে, ‘দোলে দোলে দোলে প্রেমের দোলনচাঁপা হৃদয় আকাশে/ দোল ফাগুনের চাঁদের আলোর সুধায় মাখা সে।’ মনে পড়ে যায়, সেই কবে বৃন্দাবনে প্রেমিক যুগল রাধাকৃষ্ণের রঙের উত্সবে মেতে ওঠার কথা—‘বসন্ত আওল রে! মধুকর গুনগুন অমুয়ামঞ্জরী কানন ছাওল রে।’
প্রাচীন ইতিহাস ও প্রাচীন চিত্রে দোল বা হোলির অসংখ্য চিত্র অঙ্কিত হয়ে আছে। রাজস্থানে রাজপুতদের কাছে হোলি খেলা কার্যত প্রাণের উত্সবে পরিণত হয়েছিল। শুধু রঙেই নয়, গোলিখেলাকে কেন্দ্র করে রাজপুতদের জাতীয়তাবোেধের পরিচয়ও বারবার দেখা গেছে। জাতির সম্মান পুনরুদ্ধারে ভূনাগ রাজার রানি কী করেছিলেন?
‘পত্র দিল পাঠান কেসর খাঁরে
কেতুন হতে ভূনাগ রাজার রানী
লড়াই করি আশ মিটেছে মিঞা?
বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া
এসো তোমার পাঠান সৈন্য নিয়া
হোরি খেলব আমরা রাজপুতানী’।
কেসর খাঁ তো মনের আনন্দে দলবল নিয়ে হোলি খেলতে এলেন বিস্তর যত্ন করে সাজগোজ করে। মুখে আর হাসি ধরে না, রঙের রঙিন উত্সবে রেঙে উঠতে চলেছেন যে! কিন্তু কীসে শেষ পর্যন্ত রঙিন হল কেসর খাঁ?
‘শুরু হল হোরির মাতামাতি
উড়তেছে ফাগরাগ সন্ধ্যাকাশে
নববরন ধরল বকুলফুলে
রক্তরেণু ঝরল তরুমূলে
ভয়ে পাখি কূজন গেল ভুলে
রাজপুতানীর উচ্চ উপহাসে।’
ফাগের বদলে রক্তে রঙিন হল কেসর খাঁ আর তার সৈন্যদের দেহ।
রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী ঠাকুরবাড়ির দোল উত্সব সম্পর্কে লিখেছেন, “দোলপূর্ণিমারও একটি বিশেষ সাজ ছিল। সে হল হালকা মসলিনের শাড়ি, ফুলের গয়না আর আতর গোলাপের গন্ধমাখা মালা। দোলের দিন সাদা মসলিন পরার উদ্দেশ্য ছিল যে, আবিরের লাল রং সাদা ফুরফুরে শাড়িতে রঙিন বুটি ছড়িয়ে দেবে।” কণ্ঠ থেকে কণ্ঠে সে দিন ধ্বনিত হত:
‘ওরে আয়রে তবে
মাতরে সবে আনন্দে
আজ নবীন প্রাণের বসন্তে
পিছনপানের বাঁধন হতে
চল ছুটে আজ বন্যাস্রোতে
আপনাকে আজ দখিন হাওয়ায়
ছড়িয়ে দে রে দিগন্তে...।’
শান্তিনিকেতনে এই দোলখেলা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে ‘বসন্তোত্সব’ হিসেবে এক অসাধারণ ও অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। সে দিন শান্তিনিকেতনে মেয়েরা হলুদ শাড়িতে, চুলে লাল পলাশফুল দিয়ে নিজেদের সাজিয়ে তোলে। শাল শিমুল পলাশে ঘেরা শান্তিনিকেতনের অনন্যসাধারণ প্রকৃতিতে সঙ্গীত আর আবিরের ছোঁয়া লেগে রঙিন হয়ে ওঠে চতুর্দিক। কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে/ ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে/ আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে।’
সত্যিই আকাশ তখন রঙে রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। শত শত কণ্ঠে ধ্বনিত সঙ্গীত নিখিল বিশ্ব সম্পর্কে মানুষকে উদাস করে দেয়। মনে হয়, ‘আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে/ সুরের আবীর হানব হাওয়ায়, লয়ের আবীর হাওয়ায় জানে।’
দোল বা হোলি উত্সব ভারতে কবে প্রচলিত হয়েছিল, সেই সন-তারিখ নিয়ে অঙ্কের কচকচি মার্জনা করা হল। কল্পনার ডানা মেলে দিয়ে আমরা কল্পচোখে দেখতে পাই যেন কোনও সুদূর অতীতে নরনারী আবির-কুমকুমে নিজেদের রাঙিয়ে তুলছে, সুগন্ধ ভরা বাতাসে ভেসে যাচ্ছে রঙিন ধোঁয়া, মাত্রাধিক রঙের আধিক্যে যা ক্রমাগত রূপবদল করছে।
আর যদি ইতিহাসের দিকে তাকাইতবে বেদ, পুরাণ, শব্দপুরাণ, ভবিষ্যত্ পুরাণ, মহর্ষি জৈমিনির মীমাংসা সূত্র প্রভৃতিতে হোলি উত্সবের উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাত্ খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকেই হোলি উত্সব প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। বিবাহিতা মহিলারা তখন পূর্ণ চন্দ্রকে পূজা করতেন সংসারের সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য। পরবর্তী যুগে আনন্দ-উত্সবের মাধ্যমে এই উত্সবটি পালিত হতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে হয়ে ওঠে বসন্ত-মহোত্সব কিংবা কাম-মহোত্সবের প্রতীক! চিরকালীন প্রেমিক-প্রেমিকা রাধাকৃষ্ণের হোলিখেলার স্মৃতিকে কেন্দ্র করে যেমন আজও ফাগের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে বৃন্দাবন।
‘রঙে রঙে রক্তিল আকাশ, গানে গানে নিখিল উদাস/ যেন চলচঞ্চল নব পল্লবদল মর্মরে মোর মনে মনে/ ফাগুন লেগেছে বনে বনে/ ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে।”
বাস্তবিকই শুধু দোল বা হোলি উত্সবের ইতিহাস আলোচনা নয়, এই উত্সব আমাদের শীতের রুক্ষতাকে বিদায় জানিয়ে নবীন বসন্তকে আহ্বান জানায়। বলন্ত যদি শুধু মাত্র আমাদের ঋতু পরিবর্তনকে মনে করাত, তা হলে বসন্তের মহিমা ক্ষুণ্ণ হত না কিছুই। কিন্তু শুধু এইটুকু পরিচয়ের মাধ্যমে বসন্ত কালের পরিচয় প্রদান করা যায় না। বসন্তকাল আমাদের নতুন ভাবে বাঁচতে সাহায্য করে, নতুন উত্সাহ জোগায় আমাদের অন্তরে। সে জন্যই হৃদয় বলে ওঠে, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে/ ময়ূরের মতো নাচেরে।’
দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় আকাশে পূর্ণচন্দ্র যখন আলোয় চতুর্দিক উদ্ভাসিত করে তোলে, তখন কার প্রাণ বলে উঠবে না। কে রক্ত লাগালে বনে বনে/ ঢেউ জাগালে সমীরণে/ আজ ভুবনের দুয়ার খোলা/ দোল দিয়েছে বনের দোলা/দে দোল দে দোল দে দোল!’
ফাগুন হাওয়ায় মনপ্রাণ শীতল হয়ে ওঠে—আগতপ্রায় গ্রীষ্মের চোখরাঙানিকে ভুলে গিয়ে শান্তিতে হৃদয় ভরাতে ইচ্ছা হয়— ইচ্ছে হয় বলি, ‘ফাগুন হাওয়ায় রঙে রঙে পাগলঝোরা লুকিয়ে ঝরে/ গোলাপ জবা পারুল পলাশ পারিজাতের বুকের পরে।’ আমরা জানি, জীবন সব সময় সুখের নয়। বিবাদ অশান্তি দুঃখ-দুর্দশা সেখানে আছেই। এই সব নিয়েই আমাদের চলতে হয়। কিন্তু দুঃখ-অশান্তির কালিমায় মনে আবৃত রাখলে কি আমাদের জীবন সুচারু রূপে চলবে? না। কারণ জীবন পরিবর্তনশীল। দোল উত্সবের আনন্দ উত্সবের মধ্যে রয়েচে সেই উত্সাহেরই বার্তা। যে উত্সব বার্তা দেয় সকল দুঃখ দৈন্য তুচ্ছ হোক, মুছে যাক সব ক্লেদ-কালিমা—জীবন পূর্ণ হোক আনন্দরসে।
পাঠক, এই লেখার শেষ পাতে দোল বা হোলি উত্সবের ইতিহাসের একটু ছোঁয়া না দিলে অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। স্কন্দপুরাণ বলছে, হোলিকা রাক্ষসী হরিপ্রেমে মাতোয়ারা প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন পুড়িয়ে হত্যা করার জন্য। কিন্তু কী আশ্চর্য! হরির কৃপায় প্রহ্লাদ পুড়লেন না এতটুকুও। বরং পুড়ে মারা গেল হোলিকা রাক্ষুসী স্বয়ং। এর থেকেই নাকি হোলি উত্সবের শুরু। হোলির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ফাল্গুন পূর্ণিমার আগের শুক্লা চতুর্দশী তিথির সন্ধ্যায় মেড়া পোড়ানোর উত্সব। পুরাণ থেকে জানা যায়, শ্রীকৃষ্ণ মেড়া তথা মেষাসুরকে বধ করার পর যে আনন্দ-উত্সব হয়েছিল, সেই মেড়া তথা পরবর্তী কালের অপভ্রংশে ‘নেড়া পোড়ানো’ উত্সবের সেই ছিল সূচনা।
রঙের উত্সব, নতুনকে আহ্বান করার উত্সব হল দোল। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় তিনশো বছর আগের এক ভারতীয় গুহালিপিতে দোল উত্সবের কথা আছে। এই গুহালিপি রয়েেছে মধ্যপ্রদেশের রামগড়ে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে বাত্সায়ন রচিত কামসূত্রে পাওয়া যায় দোল খেলার কথা। দেবতাকে কেন্দ্র করে রঙের উত্সবে মেতে ওঠার গল্প। চতুর্থ শতকের শেষ দিকে এই হোলি উত্সবকে শবরস্বামী তাঁর দর্শনশাস্ত্রে বর্ণনা করে গেছেন ‘হোলক উত্সব’ বলে।
এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে যায় বৃন্দাবনে যমুনার তীরে অদ্বৈত বটের নীচে কৃষ্ণমন্দিরের গুলাব-পাপড়ি হোলির কথা। ভক্তরা মন্দিরপ্রাঙ্গণে একে অপরকে সুগন্ধী গোলাপের পাপড়ি ছুড়ে হোলি খেলেন। মনে হয় যেন শ্রীকৃষ্ণ আর শ্রীমতী রাধা সূক্ষ্ম শরীরে এখানেই বিরাজ করছেন।
দোলপূর্ণিমার এই পুণ্যলগ্নে নবদ্বীপের গঙ্গাপাড়ে জন্মেছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। হরিপ্রেমে মাতোয়ারা, হরিনামে উন্মত্ত শ্রীচৈতন্য এই দিনে জন্মেছিলেন বলেই এই ফাল্গুনী পূর্ণিমার দোলের দিনটিকে ‘গৌরপূর্ণিমা’ও বলা হত। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং শ্রীগদাধর পণ্ডিত দোলায় চড়েছিলেন ও তাঁদের অনুগামী ভক্তবৃন্দ তাঁদের আবির কুমকুমে মাখিয়ে ভক্তি সহকারে পূজা করেছিলেন। এই অসাধারণ সুমধুর ঘটনাটিকে ‘হিন্দোলিকা বিহার’ বলা হয়। আজও নবদ্বীপ ও মায়াপুরের ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস বা ‘ইসকন’ সংস্থাটি পৃথিবীর যত জায়গায় তাদের শাখা সংগঠন আছে সর্বত্রই দোলোত্সব পালিত হয় মহা সমারোহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy