প্রাণবন্ত: ‘কম্পেলিং জেশ্চারস’ প্রদর্শনীর একটি কাজ
পার্ক সার্কাসের মোড়ে নতুন গ্যালারি জনুস (সেন্টার ফর ভিসুয়াল অ্যান্ড পারফর্মিং আর্টস)-এ ‘কম্পেলিং জেশ্চারস’ নামে ন’জনের কাজ নিয়ে হল গ্যালারির উদ্বোধন ও প্রদর্শনী। যোগেন চৌধুরী-সহ আরও আট শিল্পীর কাজ এই প্রদর্শনীর অহংকার। শিল্পী ও ভাস্কর নির্বাচনে ছিল বৈচিত্রের স্বাক্ষর।
দু’টি ঊর্ধ্ব ও নিম্নগামী মনুষ্যমুখের বিষণ্ণ এবং কৌতূহলী অভিব্যক্তিকে জোরালো ভাবে ধরেছেন যোগেন চৌধুরী কালি-তুলির ড্রয়িংয়ে। অন্য দুই নারীর কমনীয় লাবণ্যময় ছন্দে মুখ দেখতে না-পাওয়ার ভঙ্গি ও প্রণামের ভঙ্গিতে হাঁটু মুড়ে নতমস্তক এক মানবশরীরের কাজটি অনবদ্য। রেখাঙ্কনের তীব্রতা, কমনীয়তা এবং একই সঙ্গে দৃঢ় টানটোনের রহস্যের পরম্পরায় রোমাঞ্চকর ও কাব্যময়! পটজোড়া কম্পোজ়িশন।
সমীর আইচের ছবি দেখলেই কৌতূহল তৈরি হয়। পট নানা ভাবে ভাঙায় বিশ্বাসী সমীর। স্পেসের আশ্চর্য ব্যবহারে, বর্ণ ও ইম্প্রেশনের রহস্যভেদ করা রচনার গর্ভে আত্মগোপন করে থাকে রূপবন্ধ ও তাকে অদ্ভুত ভেঙে ফেলার মতো ভিন্ন এক জ্যামিতি। রঙের অদ্ভুত বৈপরীত্যের ব্যবহার পটের টেক্সচারকে কাজে লাগিয়ে, ড্রয়িংকে করে তোলে আলঙ্কারিক অথবা চূড়ান্ত বিমূর্ত ফর্মেশনের এক ধাঁধা। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিয়ত লিপ্ত থাকা সমীরের ক্লিয়োপেট্রা কিন্তু ‘গোয়ের্নিকা’র কথা মনে করিয়ে দেয়।
পটজোড়া নাটকীয় ঘটনা-পরম্পরা তৈরির জন্য তাঁর জাদু-তুলির নিঃশব্দ প্রবেশে চিত্রময়তার অন্দরে আরও বেশি ধূসর ও বর্ণহীন রঙের নিহিত পাতালছায়ায় গুচ্ছ গুচ্ছ ক্রীড়নকের অবস্থান দেখে স্থির হতে হয়! শিল্পী হবিবুর রহমানের মিশ্র মাধ্যমের ক্যানভাসে বহু দূর অতীত ফুঁড়ে বেরোনো নীরব কোলাহলের অশ্রুত ধ্বনি, কাগজেও তারা ছড়ানো ছেটানো জ্যামিতিক চরিত্রে প্রবেশ করা কবিতা—শান্ত, অথচ সার্কাস-সদৃশ সাদা মানবকুলের পলাশরাঙা অজানা কলরোল! হবিবুরের অনবদ্য স্টাইলাইজ়েশনকে কুর্নিশ করতেই হয় চরম তৃপ্তির কারণে।
অদ্ভুত, আপাতবিকৃত, কৌতূহলী, বিকশিত-দন্ত ও বাঁকাচোরা মুখগুলির চামড়ার ভাঁজ ও গালের ডৌল উঠে আসা কিংবা বেঁকে যাওয়ার যে ছবি অর্ঘ্যপ্রিয় মজুমদার এঁকেছেন— তা ওঁর দীর্ঘকালের অধ্যবসায়ে তৈরি দর্শন। অদ্ভুত বিস্ফারিত চোখমুখের অভিব্যক্তি শুকনো রঙের নিস্তরঙ্গ অধ্যায়। গোটা পটে বড় মুখগুলিও ছবির ভারসাম্য চমৎকার রক্ষা করছে। রং ঘষামাজা, অনুজ্জ্বল। এ রং নরম আবহে তৈরি, একই মুখে চার চোখের দৃষ্টির গভীরতা অনন্য।
প্রসূন ঘোষের কঙ্কালখুলির বিক্ষত আদলে কোটরের শূন্যতার বৃহদায়তন ও বিচ্ছিন্ন বেরিয়ে থাকা দাঁতগুলি ভয়াবহতার উদ্রেক করে।
সীমা বড়ুয়ার লাল-কালোয় করা ছ’জন নারীর প্রত্ন-ভাস্কর্যের আদিমতা যেন অবিরাম প্রকাশ করছে কোনও অস্থির স্মৃতিকে। অন্য দু’টি অতি বিমূর্ত ঝোড়ো ব্রাশিং এবং প্রিন্টেড পেপার ব্যবহার করা নীল সাদা ও কালোর এক মুগ্ধ উচ্ছ্বাস! চার্লি মধ্যমণি— পিছন ফেরা সেই বিখ্যাত ভঙ্গিতে। বাকি কুশীলবেরা এচিংয়ের বিভিন্ন টোনের দৃশ্যায়নে প্রখর। সিদ্ধার্থ ঘোষ সাদা-কালো এচিংয়ে দীর্ঘ দিনের সিদ্ধহস্ত ছাপাই চিত্রকর। সূক্ষ্ম লাইন, স্ট্রোক, মিড্ল টোন, সলিড ব্ল্যাক— লেয়ারে পটের অন্য বাস্তবতা তুলে এনেছেন।
চন্দ্র ভট্টাচার্য বড় স্পেসের খয়েরি শূন্যতায় উল্লম্ব সাদা মানবশরীরের অর্ধাংশের রহস্যময় উপস্থাপনা দিয়ে চমৎকার কাজ করেছেন। অন্যটিতে উপরিভাগ থেকে হঠাৎ সাদা ঘোলাটে রং গড়িয়ে দিয়ে জাগলিংয়ে ভারসাম্য আনলেন কি?
পঁচাশিটি তালু-সহ উত্থিত হাতের সলিড ফাইবার ভাস্কর্য জমিতে যেন বর্তুলাকারে সাজিয়ে রাখা। তার ভিন্ন ভিন্ন অবয়ব ও ছায়া মিলে একটা ছন্দ তৈরি হয়েছে সুমিতাভ পালের কাজে। আস্থা-অনাস্থায় সমস্বরে হাত তোলা মুহূর্তটি যেন নিঃশব্দ এক প্রতীক! ফর্ম সামান্য বদলে নিয়ে ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যটি কি প্রস্তর-বিগ্রহ থেকে ওঠা পাঁচটি আঙুল বা ফুলে থাকা দস্তানায় পুচ্ছ ছড়ানো বিহঙ্গ?
নিজস্ব নৃত্যধারা ছাপ রাখে
অসতো মা সদগময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়...
এই পবিত্র বেদ মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র সদন প্রেক্ষাগৃহে শুরু হল স্বনামধন্য নৃত্যগুরু আদিত্য মিত্রর স্মৃতিসভা। যার আয়োজন করেছিলেন ইন্ডিয়ান কালচারাল এনসেম্বল-এর সদস্যরা। তাঁদের পুরোভাগে ছিলেন প্রয়াত নৃত্যগুরু আদিত্য মিত্রের পত্নী শর্মিষ্ঠা মিত্র।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রয়াত মিত্রের ছবির সামনে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানান নৃত্য ও সঙ্গীত জগতের বহু গুণিজন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। এর পরে নৃত্যগুরুর স্মৃতিচারণ পর্বে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করেন নৃত্য- সঙ্গীত জগতের নানা দিকপাল শিল্পী। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী প্রমিতা মল্লিক, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডান্স গ্রুপ ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক চন্দ্রোদয় ঘোষ, বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যগুরু অলকানন্দা রায়, নেহরু চিলড্রেন্স মিউজ়িয়ামের কর্ণধার সুদীপ শ্রীমল, গণনাট্য সংঘের গৌরী ঘোষ, নবান্ন-র সংস্কৃতি বিষয়ক ডেপুটি ডিরেক্টর বাসুদেব ঘোষ, স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী শুভাশিস ভট্টাচার্য ও প্রখ্যাত নৃত্যগুরু কলামণ্ডলম ভেঙ্কিট তাঁদের অন্যতম।
এই স্মৃতিচারণা ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের মধ্যে ইন্ডিয়ান কালচারাল এনসেম্বল-এর ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের প্রয়াত গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি রূপে শর্মিষ্ঠা মিত্রের সুদক্ষ পরিচালনায় পরিবেশন করেন উপভোগ্য সঙ্গীতানুষ্ঠান ‘সঙ্গীতাঞ্জলি’ এবং নৃত্যগুরু আদিত্য মিত্রের নিজস্ব নৃত্যধারা সংবলিত একটি অনুষ্ঠান। ওঁর প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকাদের নৃত্য-নির্মিতি দর্শকদের মুগ্ধ করে। আদিত্য মিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রয়াস-স্বরূপ এই স্মৃতিসভা দর্শকমন স্পর্শ করেছে নিঃসন্দেহে।
জয়শ্রী মুখোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy