Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
• ডোভার লেন সংগীত সম্মেলন •

অমলিন সাধনার সুধা

সংগীতময় উদযাপনের সাক্ষী ৬৫ তম ডোভার লেন সংগীত সম্মেলন। লিখছেন চিত্রিতা চক্রবর্ত়ী।বিমুদ্রাকরণের বাজারেও শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি মানুষের অনুরাগে যে ভাঁটা পড়েনি, ৬৫তম ডোভার লেন সংগীত সম্মেলনের জমজমাট প্রেক্ষাগৃহ তা প্রমাণ করে দিল।

আমজাদ আলি খান

আমজাদ আলি খান

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

বিমুদ্রাকরণের বাজারেও শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি মানুষের অনুরাগে যে ভাঁটা পড়েনি, ৬৫তম ডোভার লেন সংগীত সম্মেলনের জমজমাট প্রেক্ষাগৃহ তা প্রমাণ করে দিল। প্রতি বছরের মতো এ বারও চারদিনব্যাপী এই সংগীত সম্মেলনে নবীন-প্রবীণ শিল্পীরা উজাড় করে দিলেন অমলিন সাধনার সুধা। তাঁদের সেই সংগীতময় উদ্‌যাপনের সাক্ষী থাকলেন অগণিত শ্রোতা।

প্রজ্ঞা আর প্রমিত সঞ্চালনায় শ্রোতাদের আবিষ্ট করে রাখলেন উস্তাদ আমজাদ আলি খান। ভোররাতের আসরে সরোদে বেজে উঠল-- বিহারী, মিঞামল্লার, দুর্গা। দীর্ঘ রাগালাপের পরিবর্তে ছোট ছোট বন্দিশে ফুটিয়ে তুললেন সেনিয়া বাঙ্গাশ ঘরানার স্বকীয় শৈলী। দুর্গার আবেশ তখনও কাটেনি, উস্তাদজির সরোদে অনুরণিত হল মালকোষ। শুদ্ধ শাস্ত্রীয় সংগীতের রীতি অনুযায়ী আলাপ-জোড়-ঝালার পরে ঝাঁপতাল, একতাল ও তিনতালে শোনালেন তিনটি গত্‌। তাঁর সুরবিন্যাসে প্রতিস্থাপিত হল সুগভীর এক প্রশান্তি। রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া তাঁর সংগীতজীবন যে অসম্পূর্ণ, সে কথা জানালেন উস্তাদজি। বাজিয়ে শোনালেন ‘কোন খেলা যে খেলব কখন’ আর ‘একলা চলো রে’। সেখান থেকে আবারও ফিরে গেলেন মার্গ সংগীতে। এ বার শোনালেন কোমল ঋষভ আশাবরী। তার রেশ ধরেই স্থিত হলেন ভৈরবীতে। স্বভাবসিদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ততায় প্রতিটি রাগকে তিনি নিখুঁত পরিণতি দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও একটা অপ্রাপ্তি থেকেই গেল। এই মরসুমে উস্তাদজি ভোরের রাগ-রাগিণীর প্রতি খানিক বিরূপ থেকেছেন। কোমল ঋষভ আশাবরী আরও একটু শোনা গেলে ভাল হত। তবলায় তাঁকে সহায়তা করেছেন অনুব্রত চট্টোপাধ্যায় এবং শুভ মহারাজ। অনুব্রত চট্টোপাধ্যায়ের বাজনা অনেক পরিণত হয়েছে। শুভ মহারাজের বেনারস বাজনা দাগ কাটে।

পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সন্তুরবাদন নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। প্রবীণ এই শিল্পী বাগেশ্রী রাগে আলাপ-জোড়-ঝালা দিয়ে শুরু করলেন। পরে রূপক তালে একটি ও তিনতালে দু’টি গত্‌ শোনালেন তিনি। সন্তুরের সীমিত পরিসরে তাঁর উপস্থাপনাকে যথাসাধ্য পরিপূর্ণতা দিয়েছেন শিল্পী।

পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার উপস্থাপনায় ছিল নানা রাগের সমাহার। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাঁশিতে বেজে উঠল মারু বেহাগ, হংসধ্বনি, জয়জয়ন্তী, দুর্গা। অভিনব বিন্যাসে পরিচিত রাগগুলিতে বৈচিত্র আনলেও, বয়সের ভারে তাঁর সুরবিন্যাস মাঝে-মাঝেই বেপথু হয়েছে। তবলায় শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পাখোয়াজে ভবানী শঙ্কর তাঁকে যথার্থ সহযোগিতা করেছেন।

একই কথা প্রযোজ্য পণ্ডিত যশরাজের ক্ষেত্রেও। ডোভার লেন সব সময়ই প্রবীণ শিল্পীদের শোনার সুযোগ করে দেয়। সেই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কিন্তু বয়সের বিরোধিতায় তাঁদের সংগীত পরিবেশনা সব ক্ষেত্রে শ্রুতিনন্দন হয়ে উঠছে না। পণ্ডিত যশরাজের কণ্ঠও সেই কারণে শ্রোতাদের স্পর্শ করল না। তিনি শোনালেন শুদ্ধ সারং। তাঁকে কণ্ঠে সহযোগিতা করেছেন তৃপ্তি মুখোপাধ্যায় এবং রতনমোহন শর্মা। তৃপ্তি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর বেশ পাতলা এবং আড়ষ্ট। ফলে কোনও আবেদনই তৈরি হয়নি। অন্য দিকে রতনমোহন শর্মার গলায় আবেদন থাকলেও, বলিষ্ঠতার অভাবে ম্রিয়মাণ লেগেছে। পরবর্তী মধুমাধবী (মধমাদ) সারং এবং ভৈরবী রাগের উপস্থাপনাওw কিছু হয়নি।

এ বছর ডোভার লেনের তরফে ‘সংগীত সম্মান পুরস্কার’ পেলেন বর্ষীয়ান বেহালাবাদক শিশিরকণা ধর চৌধুরী। বাজিয়ে শোনালেন স্বসৃষ্ট দু’টি রাগ সুরধ্বনি ও তরঙ্গিণী। কম্পোজিশনগুলি শ্রুতিমধুর, সন্দেহ নেই। তবে স্বসৃষ্ট রাগের পাশাপাশি পরিচিত রাগও খানিক শোনা গেলে ভাল লাগত।

এ বারের অধিবেশনে শিল্পী রাশিদ খান এবং অজয় চক্রবর্তী বেশ হতাশ করেছেন। রাশিদ খানের ভৈরোঁ মন ছোঁয়নি। সহজাত শৈলীতে রাগটিকে খাড়া করলেও, বৈচিত্রের অভাবে মনে দাগ কাটেনি। অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠে রাগ আভোগীও শ্রোতাদের প্রত্যাশা পূরণে সমর্থ হয়নি। অতিরিক্ত গমক সহযোগে মন্দ্র সপ্তকের স্বরবিস্তার তাঁর কুশলতার পরিচয় বহন করলেও, শুনতে ভাল লাগেনি। সেই তুলনায় ঠুমরি এবং ভজন ভাল গেয়েছেন।

কণ্ঠসংগীতে নবীন শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম প্রাপ্তি অপূর্বা গোখালে। তাঁর গলায় ছায়ানটের উপস্থাপনা ভীষণ ভাল লেগেছে। আলাপ, তান, স্বরবিস্তার কোথাও কোনও খামতি রাখেননি শিল্পী। তিন সপ্তকে তাঁর অনায়াস বিচরণ সাধুবাদযোগ্য। রাগবিন্যাসে কৌশলের পাশাপাশি নান্দনিকতার দিকটিও সচেতনতার সঙ্গে রক্ষা করেছেন অপূর্বা।

অশ্বিনী ভিড়ের কণ্ঠে সাহানা কানাড়ার বিলম্বিত্‌ এবং সুহা কানাড়ার ছোট খেয়াল চমৎকার লেগেছে। বিশেষ করে সাহানা কানাড়ায় ‘সা ম প গ (কোমল) ম ধ ধ প’ স্বরবিন্যাস বারবার ফিরে আসায় রাগের চলনটি সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। তার সপ্তকের তানেও দাপুটে গলার পরিচয় রেখেছেন জয়পুর-আত্রাউলি ঘরানার এই শিল্পী।

অঞ্জনা নাথ বিলম্বিত একতালে পরিবেশন করলেন রাগ বাগেশ্রী। পরে ঝাঁপতাল ও তিনতালে দু’টি বন্দিশ শোনান। বাগেশ্রীর মতো চলনশীল রাগও তাঁর গলায় বৈচিত্রহীন লেগেছে। তানবিস্তারের সময় আড়ষ্টতা ফুটে উঠছিল তাঁর কণ্ঠে। ঠুমরি তুলনায় ভাল গেয়েছেন।

আগ্রা ঘরানার শিল্পী শওকত হুসেন খান শোনালেন যোগ রাগ। যে ভাবে দুই গান্ধার আর কোমল নিষাদের প্রয়োগ করছিলেন তিনি, তাতে মুনশিয়ানার ছাপ সুস্পষ্ট। তবে আলাপ যতটা শ্রুতিমধুর হয়েছে, লয়কারিতে একটু ম্লান লেগেছে তাঁর উপস্থাপনা। ছোট খেয়াল ‘সাজন মোরা ঘর আয়ে’ খুব ভাল গেয়েছেন।

রাজন এবং সাজন মিশ্রর গান তেমন ভাল লাগেনি। ভাটিয়ার রাগে একতাল বিলম্বিতের পরে তিনতালে একটি দ্রুত খেয়াল ও তারানা পরিবেশন করেন তাঁরা। মোটের ওপর গতানুগতিক লেগেছে তাঁদের উপস্থাপনা। ভাটিয়ারের বিন্যাসও বৈচিত্রহীন ছিল।

বাহাউদ্দিন ডাগরের রুদ্রবীণা এবং নির্মাল্য দে-র কণ্ঠসংগীতের যৌথ উপস্থাপনায় চমক ছিল। যোগ রাগে আলাপ, মধ্য আলাপ, দ্রুত আলাপের পরে তেওড়া তালে একটি ধ্রুপদ বন্দিশ পরিবেশন করলেন তাঁরা। তবে একই সুরে ঘোরাফেরা করায় মন্দ্র সপ্তকের আলাপ একটু একঘেয়ে ঠেকেছে। তুলনায় শওকত হুসেন খানের আলাপ অনেক বেশি বৈচিত্রমণ্ডিত ছিল।

কণ্ঠসংগীতে কৈবল্যকুমার গুরভও বেশ নিরাশ করেছেন। নটভৈরবের বিলম্বিত কিংবা দ্রুত কোনওটাই জমেনি। তাঁর কণ্ঠস্বর বিবৃত হওয়া সত্ত্বেও, তানবিস্তার ভাল লাগেনি। মুখগহ্বর কখনও সংকুচিত করে কখনও বা বিস্তৃত করে তানালাপ একেবারেই বেমানান লেগেছে।

শিল্পী সুধা রঘুনাথন কর্নাটকি সংগীতের উপচার সাজিয়েছিলেন শ্রোতাদের উদ্দেশে। রাগ বেহাগ তাঁর কণ্ঠে অভিনব লেগেছে। চতুস্র একতালে গণেশ বন্দনাটিও চমৎকার গেয়েছেন তিনি।

যন্ত্রসংগীতেও এ বারের সম্মেলন বর্ণময় ছিল। সানাইবাদক হাসান হায়দর খানের বিলাসখানি টোড়ি চলনসই ছিল। ঝুমরা তালে বিলম্বিত এবং পরে তিনতালে দ্রুত বন্দিশ বাজিয়ে শোনালেন তিনি।

ঝিঁঝোটি রাগে আলাপ-জোড়-ঝালা শোনালেন আয়ান আলি খান। দীর্ঘ আওচারে ঝিঁঝোটির সুমিষ্ট আবেশ ফুটিয়ে তুললেন। পরে জোড় ও ঝালায় ধীরে ধীরে গতিসঞ্চারেও দক্ষতার ছাপ রেখেছেন তিনি। পরবর্তী রাগ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কামোদ। তাঁর বাদনরীতিতে সেতারের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

সুজাত হুসেন খান শোনালেন স্বল্পশ্রুত রাগ সাজগিরি। আলাপ বেশ ভালই শুরু করেছিলেন। কিন্তু সাজগিরির মধ্যে পুরিয়া, ইমন, পূর্বী অঙ্গের চলন বারবার করে দেখাতে গিয়ে তাঁর বাজনা একটু বিষম ঠেকছিল। তুলনায় ভাল বাজিয়েছেন ইরশাদ খান। সুরবাহারে দরবারি অন্য রকম লেগেছে। দীর্ঘ আলাপে দরবারির গাম্ভীর্যকে যথাযথ প্রকাশ করেছেন শিল্পী। পরে সেতারে শোনালেন বেহাগ রাগে বেশ কিছু সুন্দর কম্পোজিশন। তাঁর বাজনা উস্তাদ বিলায়েত খানের কথা মনে করিয়ে দেয়।

শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং যোগেশ সামসির তবলা লহরা উপভোগ্য ছিল। তাঁরা শোনালেন তিনতাল। রেলা, কায়দা, টুকরা, পরণে সৃজিত তাঁদের উপস্থাপনায় বেশ নতুনত্ব ছিল।

হারমোনিয়ামে জ্যোতি গোহো, রূপশ্রী ভট্টাচার্য, তবলায় অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, তন্ময় বসু, সমর সাহা, শুভেন চট্টোপাধ্যায়, যোগেশ সামসি, শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ যথাযোগ্য সঙ্গতে শিল্পীদের সহায়তা করেছেন।

পিতৃদত্ত উত্তরাধিকারকে যথাযোগ্য মর্যাদায় এগিয়ে নিয়ে চলেছেন আমান আলি খান। তাঁর সরোদবাদন ক্রমশই গভীরতর হচ্ছে। বেহাগের দীর্ঘ আলাপে পাওয়া গেল তাঁর পরিণত হাতের ছোঁয়া। ধামার তালের বন্দিশটিতে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রেখেছেন শিল্পী। চারুকেশীর গত্‌টিও চমকার লেগেছে। মীড়ের কাজে আমান ক্রমশই দড় হয়ে উঠছেন। তবলার সঙ্গে কসরতেও পাওয়া গেল তাঁর সেই পরিণতমনস্কতার পরিচয়। কৌশলী শিল্পীর মতোই প্রতিবার সমে প্রত্যাবর্তন করছিলেন তিনি। রাগ ললিতে আলাপ ও গত্‌ বৈচিত্রময় হয়ে উঠেছে আমানের সরোদে। তাঁর ললিতের মধ্যমের লালিত্য এ বারের উৎসবের সেরা প্রাপ্তি।

ছবি: রণজিৎ নন্দী, সুদীপ্ত ভৌমিক

ভ্রম সংশোধন

গত শনিবার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘জগৎ জুড়ে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে মীনাক্ষী সিংহের পরিবর্তে মীনাক্ষী গোস্বামী মুদ্রিত হয়েছে। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dover Lane Music Conference 2017
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE