Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

পাগলা দাশু ৭৫

মধ্য সত্তরেও তাঁর রেকর্ড অধরা! রহস্যটা কী? সুকুমার রায়ের দাশরথির পিছু নিলেন বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৪৬
Share: Save:

থ্রি ইডিয়টস-এ সেই আমির খানি কাণ্ডের কথা মনে পড়ে?

কলেজের বই পড়া ভালো ছাত্রের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল দিশি ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার।

ইংরেজি সে যত জানে, পরিশুদ্ধ হিন্দি তত জানে না। ফলে লাইব্রেরিয়ানবাবু সাজিয়ে-গুছিয়ে ‘শুদ্ধ’ হিন্দিতে ভাল ছেলের জন্য ভাষণ লিখে দিলেন।

সেই ভাষণের জায়গায় জায়গায় শব্দ বদলে দিল আমির খান— আর তাতে যে কী কাণ্ড হল তা বলার নয়। এক্কেবারে শব্দকল্পদ্রুম!

ভাল ছাত্রের কপালে আগুন। থ্রি ইডিয়টস-এর ভাষণের এই শব্দ বদলের কাণ্ড-কারখানা বাঙালির কিন্তু খুব চেনা।

ইংরেজ আমলে এক চণ্ডীপুরের ইংরেজি ইস্কুলে দাশরথি ভাল ছেলে জগবন্ধুকে প্রায় এই ভাবেই শায়েস্তা করেছিল।

সেখানে ইংরেজি পড়াতেন বিষ্টুবাবু। বই নিতেন জগবন্ধুর কাছ থেকে। ভাল ছাত্র জগবন্ধুর সেজন্য বেজায় দেমাক।

দাশরথি একবার জগবন্ধুর কাছ থেকে একটা ইংরেজি কথার মানে জিজ্ঞেস করেছিল।

দেমাকি জগবন্ধু বললে, ‘আমার বুঝি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? আজ এঁকে ইংরাজি বোঝাব, কাল ওঁকে অঙ্ক কষে দেব, পরশু আর একজন আসবেন আর এক ফরমাইস নিয়ে— ওই করি আর কি!’

এই নম্বর পাওয়া ছেলে আসলে ভাল স্বভাবের নয়, সে ‘হিংসুটে ভিজে বেড়াল’। তাকে দাশরথি ঠান্ডা করলে। সবুজ কাপড়ের মলাট দেওয়া গ্রামার বই বদলে ওইরকম দেখতে একখানা বই রেখে দিল জগবন্ধুর ব্যাগে, চুপিচুপি।

ইংরেজি ক্লাসে গ্রামারের বদলে সে বই বিষ্টুবাবুকে দিয়ে জগবন্ধু বেজায় নাকাল। এই বই বদলে দেওয়া দাশরথি, শব্দ বদলে দেওয়া থ্রি ইডিয়টসের আদিগুরু, বাংলা সাহিত্যের ‘ফেমাস’ পাগলা দাশু ।

তবে সেই দাশুর গল্প অবধি আসতে বাঙালি পাঠককে বেশ অনেক দিনই অপেক্ষা করতে হয়েছিল । দাশু ও দাশুর সহপাঠীদের নিয়ে গল্পগাছা লেখার অনুকূল সময় পরিবেশ চাই। যার তার কম্ম নয়।

বিশেষ দেশকালে বিশেষ প্রতিভাধর সুকুমার আগে আবির্ভূত হন তবে তো। বাল্মীকি না এলে রামের গল্প লিখবে কে !

এমনিতে বাংলা ভাষায় জমিয়ে ইস্কুলের গল্প লেখা শুরু হল ইংরেজরা আসার পর।

রংদার মজাদার সব গল্প ।

তার মানে এই নয় পশ্চিম থেকে সাদা সাহেবরা আসার আগে আমাদের দেশে পড়াশুনোর ব্যবস্থা ছিল না, সেই সব শিক্ষায়তনে মজাদার ঘটনা ঘটত না। ছিল, ঘটতও। তবে সেভাবে লেখা হত না।

বাংলা ভাষায় সাহেবরা আসার আগে, বাংলা ছাপাখানা তৈরি হওয়ার আগে পদ্যে যে সাহিত্য লেখা হয়েছিল তাতে ইস্কুলের গল্প খুব একটা নেই।

যা আছে, যেটুকু আছে তার সঙ্গে ‘আধুনিক’ ইস্কুলের গল্পের তুলনাই চলে না।

বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’-এ চৈতন্যদেবের পড়ুয়া জীবনের কথা রয়েছে। তবে চৈতন্যদেব তো ‘অসাধারণ’ ব্যক্তিত্ব, ভক্তকবির চোখে স্বয়ং কৃষ্ণ। হাতেখড়ি দেওয়ার পরেই ‘দৃষ্টিমাত্র সকল অক্ষর লিখি যায়’।

পরে নিমাই অবশ্য গঙ্গাদাস পণ্ডিতের কাছে পড়তে গেলেন। সেখানে তাঁর ‘অদ্ভুত বুদ্ধি’-র লীলা। ‘গুরুর সকল ব্যাখ্যা করেন খণ্ডন’।

এই মহামানবের দুষ্টুমির কথা ‘চৈতন্যভাগবত’-এ কিছু আছে—নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাটে নানা পণ্ডিতের শিষ্যরা স্নান করতে যেতেন। তাঁদের এক দলের সঙ্গে অন্য দলের ‘কোন্দল’— কাদের গুরু পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ তাই নিয়ে লড়াই । তবে নিমাইয়ের বুদ্ধির কাছে সবাই হেরে ভূত।

সে কাহিনির মধ্যে নানা ভাবের ওঠা পড়া নেই, কী হয় কী হয় ভাব নেই। নাটকীয়তা নেই।

সর্বোপরি সুকুমারী দাশুত্ব নেই।

ইস্কুলের গল্প যিনি ‘সেকালে’ চাইলে জমিয়ে লিখতে পারতেন তিনি ভারতচন্দ্র, রায়গুণাকর।

বিদ্যাসুন্দরে যে ফাজলামি করেছেন তাতে ইস্কুলের গল্প তাঁর হাতে খুলত ভাল। অভিজ্ঞতাও ছিল। এমনিতে ভারতচন্দ্রের বিদ্যা-সুন্দরে সুকুমারের খুড়োর কলের অন্য প্রয়োগ দেখা যায়!

সামনে চণ্ডীদাসের খুড়োর কলে খাবার ঝোলালে ‘পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা যাবে দেড় ঘণ্টায় চলে’। দক্ষিণ দেশের রাজপুত্র সুন্দরের সামনে খাবার বদলে বিদ্যা-সুন্দরী। সে সুন্দরীর কল্পনা করতে করতে সুন্দর কয়েক মাসের পথ সাত দিনে চলে গেল।

যে ভারতচন্দ্র এমন বড়দের খুড়োর কল লিখতে পারেন তিনি কি ইস্কুলের গল্প লিখতে পারতেন না!

চাকরির বাজারে আরবি-ফারসির তখন বেজায় কদর। এদিকে ভারতচন্দ্র বাড়ির অমতে প্রথমে শিখলেন সংস্কৃত। বাড়ির লোকজন তো রেগে টং। তখন ফের আরবি-ফারসি শিখতে হল।

ভারতচন্দ্রের লেখার যা মর্জি তাতে এই দু’রকম ভাষা শেখার ‘ইস্কুলের গল্প’ জমিয়ে লিখতেই পারতেন কিন্তু ‘ইস্কুলের গল্প’ সেকালে বাংলা সাহিত্যের ‘বিষয়’ নয় ।

‘একালে’ ইস্কুলের গল্প বাংলা সাহিত্যের বিষয় হয়ে উঠল।

রাজনারায়ণ বসু হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পরের সময়কে ‘একাল’ বলতেন। আজকের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের আদি কাঠামো সেদিনের হিন্দু কলেজ।

সমকালে শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা সাময়িকপত্র ‘দিগদর্শন’ লিখেছিল পশ্চিমি শিক্ষার মাহাত্ম্যের কথা— এই শিক্ষাগুণেই তো পৃথিবীর অন্যান্য জাতের ওপর সাদা-সাহেবরা ছড়ি ঘোরাচ্ছেন।

আরবি-ফারসি-সংস্কৃত-উর্দু ভাষা জানা রামমোহন রায়ও সেকথা হাড়ে হাড়ে জানতেন, মানতেন। তিনি নিজে পরে ইংরেজি শিখেছিলেন— সাহেবি কায়দায় পড়াশোনা করা ছাড়া যে নেটিভদের গতি নেই গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টকে চিঠি লিখে তা জানিয়েছিলেন । পড়তে হবে গণিত, রসায়ন, অ্যানাটমি, কাজে লাগে এমন বিজ্ঞান।

এই চিঠির সূত্রে সুকুমারের দাশুদের ইস্কুলের ‘মন্দ কপালে’ নন্দলালের কথা মনে পড়বে একভাবে।

নন্দের খুব প্রাইজ পাওয়ার শখ। সে এমনি মন্দ নয়, অঙ্কে কম পেলেও ইতিহাসে পঁচাশি পায়। অথচ প্রাইজ অঙ্কে। আর প্রাইজ সংস্কৃতে। তা নন্দ ইতিহাস ছেড়ে খুব সংস্কৃত পড়ল। সংস্কৃতে সেবার সে প্রথম। কিন্তু হেডমাস্টার সেবার প্রাইজ দিলেন ইতিহাসের প্রথম-দ্বিতীয়কে, সংস্কৃতকে নয়।

সংস্কৃতের কদর কমছে, নতুন বিদ্যে ইতিহাসের মর্যাদা বাড়ছে। রামমোহনও তো পুরনো বিদ্যের বদলে নতুন বিদ্যের পক্ষপাতী। রামমোহনের সেই চিঠি অনেক নেটিভেরই মনের কথা। তবে কতটা বিদেশি জ্ঞান শেখানো হবে, কীভাবে ও কী ভাষায় শেখানো হবে তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত ।

সেই মতানুসারে গড়েও উঠল নানা রকমের ইস্কুল। আর সেই নানা কিসিমের ইস্কুল নিয়ে গড়ে উঠল নানা মাত্রার গল্প।

বিদ্যাসাগরী বর্ণপরিচয়ে যে ‘সুবোধ’ বালকের কথা আছে সে তো আদর্শ— তারই উলটো দিকে আছে রাখালেরা।

কাজের সময় কাজ করে না, গুরুমশাইয়ের কথা শোনে না, খেলে বেড়ায়, না বলে পরের জিনিস নেয়। এই সব ইস্কুলের গল্প ‘নীতিমালা’।

পড়তে খারাপ লাগে না, কিন্তু ইস্কুলকাণ্ড নিয়ে নির্মল মজা এই সব বিদ্যাসাগরী বচনে নেই। সুকুমার তাঁর দাশুকাহিনি লেখার সময় বর্ণপরিচয়ের কথা নির্ঘাত মনে রেখেছিলেন।

পাগলা দাশু বইয়ের একটা গল্পের নাম ‘গোপালের পড়া’। সে গোপাল কিন্তু বিদ্যাসাগরের নীতিমালার সুবোধ বালক নয়।

গোপাল রোজ দুপুরে তিনতলার ছাদের ঘরে পড়তে যায়। মামা ভাবলেন ছেলের পড়াশোনায় মন হয়েছে।

ওমা! মন কোথায়!

জানা গেল ঘুড়ি লাটাই সুতো পাতলা কাগজ আঠা নিয়ে সে সংস্কৃত পড়ছে। মামা রেগে ‘সরঞ্জাম আঠারো দিনের জন্য’ নিজের ‘জিম্মায় বন্ধ’ রাখলেন।

তবে সবসময় যে শাস্তি দিয়ে ছেলেদের শুধরোতে হত তা নয় ।

সুকুমারের ‘যতীনের জুতো’ গল্পের যতীন চটি ছেঁড়ে, জুতো ছেঁড়ে, বই পেনসিল শ্লেট কোনও কিছুতে যত্ন নেই। পাগলা দাশুর স্রষ্টা সুকুমার যতীনকে শাস্তিও দেননি, জ্ঞানও দেননি, তাকে স্বপ্নে হাজির করেছেন মুচির দেশে।

সে-দেশে জুতো সেলাই করতে হয়, নিজের কাপড় নিজে মেরামত করতে হয়। না করলে খাবার জোটে না, ঘুমোতে দেওয়া হয় না।

যতীন সে-দেশে যাওয়ার পরই শুধরে গেল। এই স্বপ্নাদ্য শাস্তি বিদ্যাসাগরী নীতিমূলক কাহিনির থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। তবে দাশুর বইতে এই নীতি প্রসঙ্গ কম, থাকলেও আছে খুবই তলায়-তলায়। সে বইতে মজাটাই বেশি ।

সুকুমারের বাবা উপেন্দ্রকিশোরের বন্ধু রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’-তে ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলের ইংরেজি গান নিয়ে কৌতুককর গল্প আছে।

নর্মাল স্কুলের কর্তৃপক্ষ ছেলেদের আনন্দ দেওয়ার জন্য ইংরেজি গান গাইবার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই গানের একখানা লাইন ‘Full of glee, singing merrily, merrily, merrily’।

নেটিভ বাচ্চারা সেই লাইনটিকে গাইত ‘কলোকী পুলোকী সিংগিল মেলালিং মেলালিং মেলালিং’।

আহা ইংলিশ মিডিয়াম!

বাহা ইংলিশ মিডিয়াম !

কিশোর রবিকে এই ইস্কুলের ছেলেরা সম্ভবত ‘বুলি’ করত । সেই জ্বালাতন কিশোর রবির কাছে খুব আরামপ্রদ ছিল না। ফলে ‘মেলালিং’-এর মজার কথা লিখেছেন বটে কিন্তু সহপাঠীদের সম্বন্ধে মন্তব্যটি তীব্র, ‘অধিকাংশ ছেলেরই সংস্রব এমন অশুচি ও অপমানজনক ছিল যে, ছুটির সময় আমি চাকরকে লইয়া দোতলার রাস্তার দিকের এক জানালার কাছে একলা বসিয়া কাটাইয়া দিতাম।’

ইস্কুলে সহপাঠী-সঙ্গ উপভোগ করেননি, ফলে স্কুল পালানো রবীন্দ্রনাথের হাতে ইস্কুলের গল্প ‘অনর্গল’ হয়ে ওঠেনি। বাড়ির মাস্টারমশাইদের কথা অবশ্য মজা করেই লিখেছিলেন।

মেডিকেল কলেজের এক ‘ছাত্রমহাশয়’ বাড়িতে পড়াতে আসতেন। তাঁর স্বাস্থ্য ‘অন্যায়রূপে ভালো ছিল’। কামাই শব্দটি তাঁর অভিধানে ছিল না।

একদিন সন্ধে হয়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি। রাস্তায় একহাঁটু জল। পুকুর ভরে গেছে। বাগানের বেলগাছের ঝাঁকড়া মাথাগুলো জলের ওপর জেগে আছে।

পুলকে ছাত্র রবীন্দ্রনাথের ‘মনের ভিতরটা কদম্বফুলের মতো রোমাঞ্চিত’ হয়ে উঠছে। মাস্টারমশাইয়ের আসার সময় দু-চার মিনিট ডিঙিয়েছে। কিন্তু হা-হতোস্মি। ‘দৈবদুর্যোগে-অপরাহত সেই কালো ছাতাটি দেখা’ দিয়েছে । কলকাতার গলি দিয়ে সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আসা মাস্টারমশাইয়ের চমৎকার ছবি এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ।

ইংরেজিতে ইস্কুলের গল্পের রমরমা যথারীতি আগেই শুরু হয়ে গেছে। ১৭৪৯ থেকে ১৮৫৭-র মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে নানা রকম ইস্কুলের গল্প। সারা ফিল্ডিং-এর The Governess; or The Little Female Academy প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৪৯-এ।

সিপাহি বিদ্রোহের আগেই প্রকাশিত হয়েছিল শার্লোট ব্রন্টি, চার্লস ডিকেন্সের নানা মাপের ইস্কুল ছোঁয়া লেখাগুলি। সিপাহি বিদ্রোহের বছরে প্রকাশিত হল টমাস হিউয়ের Tom Brown’s School Days রাগবি স্কুলের গল্প, স্কুলের ছাত্রদের বাঁদরামি মারপিটের গল্প ।

পরে দেব সাহিত্য কুটীর থেকে অনূদিত হয়েছিল— বিশ শতকে বাংলা মিডিয়ামের ছেলেরা রুদ্ধশ্বাসে টম ব্রাউনের কাহিনি পড়ত।

১৮৫৭ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বছর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম থেকেই টিচিং ইউনিভার্সিটি ছিল না। পরীক্ষা নিয়ামক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। পাঠ্যসূচি ঠিক করে দিত, পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করত।

সিপাহি বিদ্রোহের বছরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠায় নেটিভদের মধ্যে পড়াশোনার বিস্তার ক্রমে দ্রুত হল ।

রবীন্দ্রনাথ জন্মালেন এর বছর চারেক পরে আর যাঁর হাতে বাংলায় আমরা প্রথম ইস্কুলের সেরা গল্প পেলাম সেই সুকুমার রায়ের জন্ম বিদ্রোহের প্রায় বছর কুড়ি পরে। ‘১৮৮৭ সালে, ১৩ নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে লাহাদের বিশাল বাড়ির দোতলার একটি ঘরে’।

এই বাড়ির নীচের তলায় ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ের ক্লাস চলত । সুকুমার, যার ডাকনাম ছিল তাতা, ‘কোঁকড়াচুল মিষ্টিমুখো শ্যামল ছেলে’, সে একটু বড় হতেই ঢিলে কুর্তা আর পাজামা পরে ডান্ডা হাতে ছাদে মেয়েদের তাড়িয়ে বেড়াত। লীলা মজুমদার লিখেছিলেন,

“ভালো অভিনেতা ছিল সে। অদ্ভুত মুখভঙ্গি করত, হাসিমুখ কান্নামুখ রাগমুখ ভয়মুখ ন্যাকামুখ বোকামুখ। যা বই পেত, তখুনি পড়ে ফেলত, প্রথমে ‘সখা’ আর ‘সাথী’, তারপরে দুই মিলে ‘সখাসাথী’, তারপর ‘মুকুল’।”

সখা, সাথী, সখাসাথী, মুকুল এসবই ছোটোদের পত্রিকা। ইংরেজি কায়দায় পড়াশোনা আর ইস্কুলই তৈরি হচ্ছে না ইংরেজি কায়দায় শিশু-কিশোরদের জন্য পড়ার বইয়ের বাইরের পড়ার পত্রিকাও প্রকাশিত হচ্ছে বাংলায়। এই শিশু-কিশোরদের পত্রিকায় ঠাকুরবাড়ির মানুষজনের ভূমিকা গভীর।

রবীন্দ্রনাথ কিশোরদের জন্য কলম ধরছেন। প্রমদাচরণ সেনের ‘সখা’র দেখাদেখি ঠাকুরবাড়ি থেকে ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত হচ্ছে ‘বালক’।

‘বালকদের পাঠ্য সচিত্র কাগজ’-এ রবীন্দ্রনাথ লিখতে শুরু করেছিলেন ‘রাজর্ষি’। এই ‘রাজর্ষি’-র তাতা নামটি থেকেই নিজের ছেলে সুকুমারের ডাকনাম দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু উপেন্দ্রকিশোর।

উপেন্দ্রকিশোরের ‘বেচারাম ও কেনারাম’ নাটিকা প্রকাশিত হয়েছিল ভুবনমোহন রায়ের ‘সাথী’তে।

উপেন্দ্রকিশোরের বন্ধুস্থানীয় যোগীন্দ্রনাথ সরকার। তিনি সিটি স্কুলের মাস্টারমশাই। সুকুমারও ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ের গণ্ডি পার হয়ে সিটি স্কুলের ছাত্র হল।

যোগীন্দ্রনাথও উপেন্দ্রকিশোরের আগেই ছোটদের জন্য বই লেখায় হাত দিয়েছিলেন। তিনি নিজের প্রকাশনী ও ছাপাখানা করলেন – নাম ‘সিটি বুক সোসাইটি’। সেখান থেকে উপেন্দ্রকিশোরের বই বেরোত —‘ছোটোদের রামায়ণ’ ‘ছেলেদের মহাভারত’।

এই জলহাওয়ায় সুকুমার বড় হয়েছিলেন। বুঝেছিলেন ছেলেদের জন্য লেখায় নানারকম মুখ থাকা চাই— হাসিমুখ, কান্নামুখ, ন্যাকামুখ।

দাশুর ইস্কুলে এই নানারকম মুখের ছড়াছড়ি। ডিটেকটিভ জলধর টিফিন চোর ধরার কত ফিকির করল। শেষে জানা গেল চোর হুলো বেড়াল।— ‘তখন যদি জলধরের মুখখানা দেখতে, সে এক বিঘৎ উঁচু হাঁ করে উঠোনের দিকে তাকিয়ে রইল।’

ব্যোমকেশ মাঞ্জা মনে করে ঘুড়ির সুতোয় দেশলাইয়ের মশলা লাগিয়েছিল। ডাক্তারের ছেলের ঘুড়ি তার আর কাটা হয়নি। ডাক্তার বাড়ির লাল রঙের ঘুড়ি তার মাথার উপর দিয়ে ফর্‌ফর্‌ করে উড়ছে। আর ব্যোমকেশ ‘ফ্যাল্‌ ফ্যাল্‌ করে তাকিয়ে রইল।’ সবজান্তা দুলিরাম গুল মারতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল । তখন ‘মুখখানা লাল করিয়া হঠাৎ এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া গেল।’

পঞ্চাশ বছরের পুরনো কালচে রং ধরা খেরোর খাতায় ১৯১৮-র মে মাসে লিখেছিলেন সুকুমার ‘রসের মাঝে মজবি যদি মন, / বাস্তবের এই বস্তুলীলার তত্ত্ব কথা শোন্‌ ।/ জড়জগতের বাস্তুভিটায় বস্তু করেন বাসা,/ নিংড়ে দেখ রসের মধু মৌচাকে তাঁর ঠাসা!’ একবার পড়লে ধাঁধা ধাঁধা মনে হবে । বারকয়েক পড়লে পরিষ্কার । বাস্তবে যা ঘটে, যাকে বিরক্তিকর, অশুচি বলে মনে হয় তা যদি ঠিকঠাক বাজিয়ে নেওয়া যায় তাহলে হাজার মজা পাওয়া যেতে পারে । সেই হাজার মজাই তো তাঁর লেখার বিষয়।

যোগীন সরকারের সিটি স্কুলের ছাত্র সুকুমার সেই রসের মধু নিয়ে লিখলেন ‘পাগলা দাশু’। বাংলা ভাষায় এখনও অবধি সবচেয়ে রংদার ইস্কুলের গল্প।

ইস্কুল নামক ‘আধুনিক’ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ বাঙালির বোঝাপড়ার কাহিনি। রবীন্দ্রনাথের মতো সুকুমার ‘অন্যরকম’ ইস্কুল বানানোর কথা ভাবেননি। এই সিস্টেমে নতুন পণ্ডিতের মতো ‘টেবিলে প্রকাণ্ড ঘুঁষি মারা’ ‘হরিপ্রসন্নর গালে ঠাস্‌ ঠাস্‌ করিয়া চড়’ মারা মানুষ যেমন আছেন তেমন ‘হঠাৎ নরম’ হয়ে যাওয়া পণ্ডিতমশাইও আছেন। ‘তাঁর নিজের ছেলেবেলার কোন দুষ্টুমির কথা মনে’ পড়ে গেল।

এই সিস্টেমকে নিয়ে তাই একটু আবোল-তাবোল কাহিনি ফাঁদাই উদ্দেশ্য। সিস্টেমের সমালোচনা আছে, তাকে নিয়ে মজা করা আছে কিন্তু চণ্ডীপুরের স্কুলটি ভেঙে ফেলা উদ্দেশ্য নয়। পাগলা দাশু অচলায়তনের নিয়মভাঙা পঞ্চক নয়।

এই গপ্পগুলো প্রকাশিত হয়েছিল ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় । ঠাকুরবাড়ি যদি ‘বালক’ প্রকাশ করতে পারে রায়বাড়িই বা পিছিয়ে থাকবে কেন!

আর সত্যি কথা বলতে কী ‘বালক’ তো একবছর চলেই বন্ধ— ‘সন্দেশ’ তুলনায় দীর্ঘজীবী । উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, সত্যজিৎ আরও অনেকে — চলার পথ বৈচিত্রে ভরা।

এই সন্দেশেই দাশুর আত্মপ্রকাশ। ১৩২৩-এর (ইং ১৯১৬) মাঘের সন্দেশে ‘পাগলা দাশু’ ছাপা হল। তার আগেই জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল ‘আশ্চর্য কবিতা’ ‘নূতন পণ্ডিত’ ‘জগ্যিদাসের মামা’।

আশ্চর্য কবিতায় সন্দেশের পাঠকেরা জানতে পেরেছিলেন এ ‘চণ্ডীপুরের ইংরাজী ইস্কুলের’ গল্প। টম ব্রাউনের মতো এ রাগবি স্কুল নয়। বাঙালির ইংলিশ মিডিয়াম। কাজেই কাণ্ডকারখানা যা হয় তা সবই বাঙালি রকমের।

টম ব্রাউনের স্কুলের মতো প্রাণঘাতী কাণ্ড এই ইস্কুলের ছেলেরা করে না। তবে তাদের চালাকি-বোকামি-ন্যাকামি-চালিয়াতি দেখে রবীন্দ্রনাথের মতো সুকুমার বিরক্ত হন না ।

সেই বাস্তবের ভেতর থেকে রসের মৌচাক নিংড়ে নেন। রবীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার আগের বছর সুকুমারের বই পাগলা দাশু পড়ে লিখেছিলেন, সুকুমারের ‘সমশ্রেণীর রচনা’ বাংলা ভাষায় ‘দেখা যায় না’। লেখক সুকুমারের তখন অকালমৃত্যু হয়েছে ।

পাগলা দাশুর হাতে অবশ্য জীবনের চাবিকাঠি। ‘পাগলা দাশু’ বইয়ের সব গল্পে চরিত্র হিসেবে সে আসে না বটে। তবে চণ্ডীপুরের ইংরেজি স্কুলের তাকেই মনে থেকে যায় সবচেয়ে বেশি। তার চোখ দুটি গোল গোল, কান দুটি অনাবশ্যক রকমের বড়, মাথায় একবস্তা ঝাঁকড়া চুল।

চেহারা দেখে সহপাঠীরা ছড়া কাটে, ‘ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুণ্ড তাহে ভারী / যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারী’।

তখনও দেশ ভাগ হয়নি। তবে পূর্ববঙ্গের ছেলেপুলেদের নিয়ে রঙ্গ করার স্বভাব বাঙালির অনেক দিনের।

চৈতন্যদেব পূর্ব বাংলায় গিয়েছিলেন, সেখানকার বাঙালিদের মুখের ভাষা নিয়ে ঠাট্টা করতে ছাড়তেন না।

চণ্ডীপুরের ছেলেরাই বা যশুরে কইকে ছাড়বে কেন! তবে কি’না যশুরে কই তো আর জীবনস্মৃতির রবি নয় যে একলা বসে কাটিয়ে দেবে!

সেও চমৎকার পালটা দিতে জানে । তার ডাকনাম দাশু, পুরো নাম যে দাশরথি ।

দাশুর কাণ্ডের নানা ডালপালা। তার হাত পা ছোড়ার ভঙ্গি দেখে চিংড়ি মাছের কথা মনে পড়ে। তার কাণ্ডকারখানাও ওই তিড়িং-বিড়িং রকমের। কোনও নির্দিষ্ট গতি প্রকৃতি নেই। যখন যেমন করে আমোদ করা যায় তখন তেমন করে আমোদ করা চাই।

ক্লাসের ছেলেদের কৌতূহল উসকে দিয়ে ঠকানোর জন্য সে অদ্ভুত বাক্স নিয়ে স্কুলে আসত। সে বাক্সে আসলে কিছুই নেই— ‘ক্লাসফ্রেন্ড’রা ভাবত, আছে।

খুব সাবধানে সে বাক্স চাবি দিয়ে রাখত। তাতে সহপাঠীদের উৎসাহ কৌতূহল দ্বিগুণ হত।

একদিন সে বাক্স টিফিনের সময় অন্যদের জিম্মায় রেখে গেল। তারা চুপি চুপি বাক্স খুলে শেষ অবধি নানা প্যাঁচ খুলে একটি কার্ড পেল। তার এক পিঠে লেখা ‘কাঁচকলা খাও’ অন্য পিঠে লেখা ‘অতি কৌতূহল ভালো নয়’।

দাশু সহপাঠীদের শুধু ব্যঙ্গ করেনি অপরের বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহলী বড় বাঙালিদেরও ব্যঙ্গ করেছে। ভাল ইংরেজি শিখবে বলে সে একবার পেন্টেলুন পরে স্কুলে এসেছিল। সঙ্গে ছিল তাকিয়ার খোলের মতো কোট।

নাটকে দাশুকে না নেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছিল নিজের মতো করে। ফোর্থ ক্লাসের গণশাকে দেওয়া হয়েছিল দেবদূতের পার্ট। গণশাকে রোজ খাইয়ে দাইয়ে, রঙিন পেনসিল আর ছবির বই দিয়ে দাশু হাত করে ফেলল। ফলে নাটকের দিন গণেশচন্দ্র চম্পট।

তার বদলে পার্ট মুখস্ত আছে বলে অগত্যা দাশুই দেবদূত।

প্রথম দিকে গণ্ডগোল করেনি। মজা জমল শেষে। শেষ দৃশ্যে মন্ত্রী রাজাকে জানিয়ে দিয়েছে ‘দেবদূত গেল চলি স্বর্গ অভিমুখে’।

জানিয়ে দিলে কী হয় দাশু আবার হাজির। দেবদূতের এই নাটক বহির্ভূত ফিরে আসার সংলাপ নিজেই বানিয়ে নিল ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’।

সুকুমার ফেরেন না। গল্পে দাশু বারবার ফেরে। ফেরে পণ্ডিতদের ঘুম ভাঙাতে। সংস্কৃতের পণ্ডিত মন্দ নন। তবে ঘুমোন এবং চটে যান। রামপদর মিহিদানার হাঁড়ি নিয়ে দাশু সেই পণ্ডিতের জন্য চিনেপটকার আয়োজন করেছিল। পণ্ডিত তো হাঁড়ি যার কাজ তার ভেবে রামপদকে ধরলেন।

দাশু রামপদকে খুবই অপছন্দ করত। তবে রামপদ যখন মার খায়-খায় তখন অন্যান্য মাস্টারমশাইদের সামনে আসল হাঁড়ি ফাটাতে কসুর করেনি।

পণ্ডিতমশাইকে বলল, ‘আপনি যখন ঘুমোচ্ছিলেন, তখন ওরা শ্লেট নিয়ে খেলা করছিল’।

এমন সত্য কে সইতে পারে!

পণ্ডিত, ‘কে বলেছে আমি ঘুমোচ্ছিলাম?’ দাশু, ‘তবে যে আপনার নাক ডাকছিল?’ পণ্ডিত কথা ঘোরানোর জন্য বললেন, ‘তুমি কি কচ্ছিলে?’ দাশুর অম্লানবদল স্বীকারোক্তি, ‘আমি পটকায় আগুন দিচ্ছিলাম।’

পটকা কাণ্ড যেন দাশুর লঙ্কাকাণ্ড। কিন্তু দাশু কি এই বইয়ের প্রকৃত নায়ক? সুকুমারের জিজ্ঞাসা, ‘দাশু কি সত্যি সত্যি পাগল, না কেবল মিচকেমি করে?’

পাঠক বোঝেন দাশু ইস্কুলের দমবন্ধ ভাব কাটিয়ে দেয়। সেই ইস্কুলে সবজান্তা, চালিয়াৎ, কবি, সর্দার, গুলবাজ নানা কিসিমের ছাত্র। ইস্কুল যেন বাঙালি সমাজেরই ছোট সংস্করণ। সেখানে সব গল্পে দাশু থাকে না, তবে দাশুর লেখক সুকুমারের অন্য চরিত্ররা থাকে। তারাও কম রংদার নয়।

প্রথম সবচেয়ে রংদার বাংলায় লেখা ইস্কুলের গল্প পড়তে পড়তে মনে হয় আবার কেন সে নবরূপে আসে না ফিরিয়া! ইস্কুল আর ইস্কুলের মজা তো কিছু কম পড়েনি।

কত বাংলা মিডিয়াম স্কুল অক্কা পেল, কত নতুন কিসিমের ন্যাশানাল ইন্টারন্যাশানাল স্কুল হল – বাংলায় আর একটা দাশুর সমতুল ইস্কুলের গল্পের বই হল না ।

পুনশ্চ : দাশুর গল্প এখন লিখতে গেলে তাকে কি চণ্ডীপুরের ছেলেদের ইস্কুলে আর আটকে রাখা যাবে! এখনকার দাশু কোএডুকেশন স্কুলের ছাত্র— তার তো বন্ধুনিও হবে। মজাগুলোর মধ্যে যে খেলনা পাতির উপাদান আছে তাও বদলে যাবে— ঘুড়ি লাটাই মাঞ্জা ক্রমহ্রাসমান। দাশু আর তার বন্ধুদের সূত্রে যে বাঙালি অভিভাবকদের চেহারা-চরিত্র এসেছে তাদেরও রকম গেছে বদলে। তবে দাশুর গল্পের যে মূল সুর, মজা করে সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেমের সঙ্গে পাঞ্জা লড়া তা কিন্তু এখনও বজায় আছে । তা না হলে হিন্দিতে পড়াশোনার নানা প্রতিষ্ঠান নিয়ে হিট ছবি বাজার মাত করত না। ইস্কুল-কলেজের গল্পের মার নেই, তবে পরিবেশন করতে জানা চাই ।

অলংকরণ: দেবাশীষ দেব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE