Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

যে জন রয়ে গিয়েছেন অন্তরালে

রক্ষণশীল সমাজের ভিতরে থেকেও উত্তরণের নিরন্তর চেষ্টা করে গিয়েছেন নিরুপমা দেবী। মিছিলে হেঁটেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে উৎসাহ জুগিয়েছেন। আর লিখে গিয়েছেন নিরলস ভাবে। তাঁরই জীবন ও সাহিত্যে আলোকপাত করলেন সুদেষ্ণা বসুতার দু’বছর পরে ৭ জানুয়ারি, ১৯৫১ সালে চলে যান নিরুপমা। বৃন্দাবনেই তাঁর শেষকৃত্য হয়। নিরুপমা দেবীর বিধিলিপিতে অটুট বিশ্বাস ছিল বরাবর! 

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

বাংলা সাহিত্যের সাধারণ পাঠক আশাপূর্ণা দেবীকে যতখানি জানেন, নিরুপমা দেবীকে তার সিকিভাগও জানেন কি না সন্দেহ! বইপাড়ায় তাঁর লেখা গল্প বা উপন্যাসের খোঁজ মেলে না। জীবদ্দশায় গ্রন্থিত বইয়ের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর পাঠকের মনে কতখানি ছড়িয়ে পড়েছিলেন, সে সম্পর্কেও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া দুষ্কর। পথ একটাই— তাঁর লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত নাটক বা চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে জনমানসে তিনি কতখানি প্রভাব ফেলেছিলেন তার একটা হদিশ পাওয়া।

১৯৫৩ সাল। নিরুপমা দেবীর ‘শ্যামলী’ উপন্যাস নিয়ে তৈরি হল ‘শ্যামলী’ নাটকটি। নায়ক উত্তমকুমার, নায়িকা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। দেখা গেল, শুধু জনপ্রিয়তা নয়, এই নাটক বাংলা থিয়েটারেই এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। অন্য দিকে ১৯৫৬ সালে এই নাটককেই পর্দায় নিয়ে এলেন পরিচালক অজয় কর। উত্তমকুমার ও কাবেরী বসু অভিনীত এই চলচ্চিত্রটি দর্শকদের কাছে হয়ে গেল আর এক বিস্ময়। একে একে নিরুপমা দেবীর লেখা উপন্যাস থেকে তৈরি হতে থাকল ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘দেবত্র’, ‘বিধিলিপি’র মতো চলচ্চিত্র। আশাপূর্ণা দেবীর কাহিনি যেমন বাংলার চলচ্চিত্রকারদের কাছে ছিল নিশ্চিত সাফল্যের আশ্বাস, একই কথা বলা হত নিরুপমা দেবীর ক্ষেত্রেও। দুঃখের বিষয়, এই জনপ্রিয়তা তিনি দেখে যেতে পারেননি।

হিন্দু রক্ষণশীল বাঙালি পরিবারের যে সাংসারিক পরিবেশ আশাপূর্ণা দেবীকে লেখা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল, নিরুপমা দেবী সেই পরিবেশ পাননি। তাই তাঁর জীবনকাহিনি এক দিক থেকে যেমন মর্মান্তিক, তেমনই উত্তরণের আলোকে ভাস্বর। নিরুপমা দেবীর জন্ম ১২৯০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে। ইংরেজি ১৮৮৩ সালে। প্রামাণ্য তথ্যের অভাবে তাঁর জন্ম তারিখটি নিয়ে সংশয় থাকলেও পারিবারিক সূত্রে তাঁর ভাই পঞ্চানন ভট্টর ছোট ছেলে অভিজিৎ ভট্ট জানিয়েছেন, “নিরুপমার জন্মদিনটি হল ৭ মে।”

তারিখ যা-ই হোক না কেন, নিরুপমা জন্মেছিলেন এমন এক সময়ে, যখন বাংলা সাহিত্যে নারীর উপস্থিতি ক্রমশ চোখে পড়তে শুরু করেছে। যার সলতে পাকানোর কাজটি আরম্ভ হয়েছিল তারও একত্রিশ বছর আগে। কোনও এক নারী বাংলা ভাষায় প্রথম একখানি উপন্যাস লিখে ফেললেন ১৮৫২ সালে। সেই নারী এক খ্রিস্টান মিশনারি। নাম হ্যানা ক্যাথারিন মুল্যান্স। উপন্যাসের নাম ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’। কিন্তু প্রথম যে বাঙালি নারী বাংলায় উপন্যাস লিখে সাড়া ফেলেছিলেন, তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ও রবীন্দ্রনাথের বড় দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘দীপনির্বাণ’ হল কোনও বাঙালি লেখিকার লেখা প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস।

স্বর্ণকুমারী দেবীর উৎসাহে অনেক বাঙালি মেয়েই সেই সময়ে বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় পা ফেলতে শুরু করেন। তৎকালীন ‘ভারতী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘প্রবাসী’র মতো সাহিত্য পত্রিকায় এঁদের সাহিত্যকর্মের নিদর্শন রয়ে গিয়েছে। প্রসন্নকুমারী দেবী, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, মানকুমারী, কামিনী রায়, সরলা দেবীরা সাহিত্যসাধিকা হিসেবেই আজও স্বীকৃত। এঁদেরই উত্তরসূরি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ ঘটেছিল নিরুপমার।

যোগমায়া ও নফরচন্দ্র ভট্টর কন্যা নিরুপমা ছেলেবেলায় ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত। তার সুন্দর কচি মুখে পাকা পাকা কথা শুনে সকলে তাকে ডাকত ‘বুড়ি’ বলে। বহরমপুরের গোরাবাজার অঞ্চলে ভট্ট পরিবারের বিশাল বাড়ির অংশবিশেষ আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন নফরচন্দ্র। ইংরেজি শিক্ষিত নফরচন্দ্র ছিলেন গোঁড়া রক্ষণশীল হিন্দু। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। নিজে তিন বার বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। দ্বিতীয় স্ত্রীর তিন সন্তান শশীভূষণ, ইন্দুভূষণ ও বিনোদভূষণ। তৃতীয় স্ত্রী যোগমায়া। তাঁর ছ’সন্তান— বিভূতিভূষণ, নিরুপমা, সুরেশ্বরী, পঞ্চানন, ক্ষণপ্রভা ও রানি।

সে কালের রীতি অনুযায়ী ১৮৯৩ সালে মাত্র দশ বছর বয়সে নিরুপমার বিয়ে হয় নদিয়া জেলার সাহারবাড়ির নবগোপাল ভট্টর সঙ্গে। বিয়ের চার বছরের মাথায় যক্ষ্মা রোগে নবগোপাল মারা যান ১৮৯৭ সালে। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে বালবিধবা হয়ে নিরুপমা ফিরে আসেন ভাগলপুরে তাঁর পিতৃগৃহে। নফরচন্দ্র তখন কর্মসূত্রে ভাগলপুরবাসী। বিধবা নিরুপমা যখন ভাগলপুরে এলেন, তিনি তখন একেবারে অন্য মানুষ। কারও সঙ্গে কথা বলেন না। আগের সেই ছটফটে ভাবটাও উধাও। এই বদলে যাওয়া বাল্যসখীকে দেখে সাহিত্যিক অনুরূপাদেবী অবাক হয়ে যান। একটা চিঠি লেখেন নিরুপমাকে। তাঁকে নতুন করে জীবনবৃত্তে ফিরিয়ে আনতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা একটি কবিতাও পাঠান। নিরুপমা দেবীর জীবনীকার চিত্ররেখা গুপ্ত পারিবারিক সূত্র ঘেঁটে জানিয়েছেন, ওই চিঠির হদিশ পাওয়া যায়নি বটে, কিন্তু এর পরেই নাকি নিরুপমা তাঁর নীরবতা ভাঙেন। তিনিও কবিতাতেই সেই চিঠির উত্তর দিয়ে লেখেন, “জন্ম যে দেয় মৃত্যু দেবে/ কাজ কি তবে এত ভেবে/ সুখের সাথে মাথায় তোল দুখ।”

যেন এক আধুনিক মননের জন্ম হল। রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের বালবিধবাদের দুর্দশার কথা নিরুপমা জানতেন না, এমন নয়। সেই অন্ধকার জীবনের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে তিনি এ-ও বুঝেছিলেন, তাঁর বাবা নফরচন্দ্র বিধবাদের জীবনে মুক্তির আলো আনার ঘোর বিরোধী। ফলে হয় তাঁকে বাবার ইচ্ছা অনুসারে বিধবার অন্ধকার জীবনকে মেনে নিতে হবে, নয়তো ‘মাথায় তোল দুখ’!

তিনি অবশ্য বেছে নিয়েছিলেন মধ্যপন্থাকে। হিন্দু বিধবার আচারসর্বস্ব জীবনকে তিনি বর্জন করেননি কোনও দিন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যকে আঁকড়ে ধরে মনের জানালাগুলো খুলে দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন অনন্য এক সাহিত্যসাধিকা। তাঁর এই ‘হয়ে ওঠা’ সম্ভব হয়েছিল এক দিকে নিজের শিক্ষাদীক্ষার হাত ধরে, অন্য দিকে দাদা বিভূতিভূষণ ও অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রেরণায়।

শরৎচন্দ্রের সঙ্গে নিরুপমার পরিচয় ঘটেছিল এক আবেগবিহ্বল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। নিরুপমা তখন ভাগলপুরে। ‘এখনকার খঞ্জরপুরের বাঙালিটোলায়’। দাদা বিভূতিভূষণ ও তাঁর বন্ধুরা তখন সেখানে উদীয়মান সাহিত্যিক যুবক শরৎচন্দ্রের সান্নিধ্যে মুগ্ধ। রাতের অন্ধকারে ‘যামুনিয়া নদীর তীর থেকে ভেসে আসে বেপরোয়া, স্বেচ্ছাচারী অমৃত গরলে মেশা রোমান্টিক যুবক ‘ন্যাড়া’ ওরফে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গান, কখনো বা বাঁশির সুর’।

শরৎচন্দ্রের সঙ্গে নিরুপমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল এক আকস্মিক ও নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে। নিজেই তা লিখে গিয়েছেন তিনি, “শ্রাদ্ধান্তে যখন... ভ্রাতৃজায়ার সঙ্গে বাড়ী ফিরিতেছি, দেখি শরৎ দাদা আমাদের বাড়ীর দিক হইতে পুঁটুলির মত কি লইয়া আসিয়া ছোট্‌দার হাতে দিলেন। ছোট্‌দা তাহা ভ্রাতৃজায়ার হাতে দিলে দেখি একখান পাড়ওয়ালা কাপড় ও হাতের গহনা – ৺ শ্রাদ্ধের পূর্বে যাহা বাড়ীতে খুলিয়া রাখা হইয়াছে। মনের উত্তেজনায় বোধহয় সে সময় আবার সেগুলা লইতে অনিচ্ছা প্রকাশই হইয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু সে জিদ সেদিন জয়ী হইতে পারে নাই। মাতৃসমা ভ্রাতৃজায়া তো কাঁদিতেই ছিলেন— ছোট্‌দা মুখ ফিরাইয়া চোখ মুছিতেছে এবং একজন বাহিরের লোক— তিনিও তাহাদের সঙ্গে কাঁদিতেছেন।”

নিরুপমার বৈধব্যকে শরৎচন্দ্র মেনে নিতে পারেননি। তিনি লিখেছেন, “আমার সত্যকার শিষ্যা, এবং সহোদরার অধিক একজন আছে, তাহার নাম নিরুপমা। ...এই মেয়েটি যখন তাহার ষোল বৎসর বয়সে অকস্মাৎ বিধবা হইয়া একেবারে কাঠ হইয়া গেল, তখন আমি তাহাকে বার বার এই কথাটিই বুঝাইয়াছিলাম, ‘বুড়ি, বিধবা হওয়াটাই যে নারী জন্মের চরম দুর্গতি এবং সধবা থাকাটাই সর্বোত্তম সার্থকতা ইহার কোনটাই সত্য নয়’। তখন হইতে সমস্ত চিত্ত তাহার সাহিত্যে নিযুক্ত করিয়া দিই।”

নিরুপমাকে চিরকাল ভালবেসেছেন শরৎচন্দ্র। তাঁর সাহিত্য সাধনায় প্রেরণা জুগিয়েছেন নানা ভাবে। বিভূতিভূষণ ও তাঁর বন্ধুদের শরৎচন্দ্র বলতেন, ‘কুঁড়ি সাহিত্যিক’-এর দল। কারণ তখন তাঁরা নাকি ‘ফুটি’ ‘ফুটি’ করছেন। এই দলের ‘গুরু’ ছিলেন শরৎচন্দ্র। তাঁরই পরামর্শে একটি হাতে লেখা কাগজ প্রকাশ করা হত। সেই কাগজে বিভূতিভূষণ ও তাঁর সাহিত্যিক বন্ধুদের লেখা ছাপা হত। লেখা নিয়ে হত আলোচনাও। কাগজটির নাম ছিল ‘ছায়া’। এই আলোচনায় সভ্যদের লেখা পাঠ করা হত। সঙ্গে এক জন অন্তঃপুরচারিণীর লেখাও তাঁর ‘ছোট্‌দা’র মারফত এসে পড়ত সভ্যদের হাতে। বিভূতিভূষণ লিখেছেন, ‘ইনি আমাদের বন্ধুদের দৃষ্টিপথের অন্তরালে থাকিয়াও আমাদের বন্ধুবর্গের একান্ত আপনার ছোট বোনটিই হইয়াছিলেন।”

এই ছোট বোন নিরুপমা তখন অজস্র কবিতা আর গল্প লিখে চলেছেন। যার কিছু কিছু ছাপাও হয়েছিল ‘ছায়া’ পত্রিকায়। শরৎচন্দ্রের ‘পরামর্শ’ দাদা বিভূতিভূষণের হাত ঘুরে আসত নিরুপমার কাছে, “আরো যাও— আরো যাও— দূরে— থামিও না আপনার সুরে।” আর এই ভাবেই কবিতা লিখতে লিখতে এক দিন নিরুপমা লিখে ফেলেছিলেন ‘উচ্ছৃঙ্খল’ গল্পটি।

দুর্গাদাস ভট্টর লেখা থেকে জানা যায়, শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের সম্পর্কে নিজের মতামত নিরুপমা দেবী লিখে রাখতেন তাঁর ডায়েরিতে। নায়িকারা সকলেই বিধবা। তাদের যে ছবি শরৎচন্দ্র তুলে ধরছেন তাঁর লেখায়, তার সঙ্গে নিরুপমা কি মিলিয়ে নিতে চাইতেন নিজের জীবন এবং ভাবনাকে? আজ তা জানা অসম্ভব। তবে চিত্ররেখা গুপ্তর মতে, “‘বড়দিদি’র মাধবী, ‘পথ-নির্দেশ’-এর হেম, ‘মন্দির’-এর অপর্ণা, ‘পল্লীসমাজ’-এর রমা, ‘চরিত্রহীন’-এর কিরণময়ী সবাই বিধবা। এই সব বিধবা চরিত্র চিত্রণের নেপথ্যে শরৎচন্দ্রের বিশেষ কোনও মানসিকতা কাজ করেছিল কি না এ প্রশ্ন মনে জেগে থাকতে পারে। নিরুপমাও বিব্রত হয়ে থাকতে পারেন।”

কিন্তু যখন দেখা যায় নিরুপমা নিজে কলম ধরছেন এবং নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার উপরে ভিত্তি করে আঁকছেন হিন্দু বাঙালি বাড়ির বিধবাদের দুর্দশা, হতাশা, যন্ত্রণার কথা। আর শরৎবাবু তার প্রশংসা করছেন, সোনার কলম উপহার দিচ্ছেন, পত্রিকার সম্পাদকদের অনুরোধ করছেন নিরুপমার লেখা ছাপাতে, তখন মনে হয় শরৎচন্দ্র ও নিরুপমার মধ্যে নিশ্চয়ই এক আশ্চর্য সুন্দর ‘সাহিত্য-বন্ধন’ গড়ে উঠেছিল। যার স্বীকৃতি সে যুগে সম্ভব ছিল না। বরং জুটেছিল নিন্দা ও কুৎসা। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিরুপমার মধ্যে জন্ম হয়েছিল এক মরমী সাহিত্যিকের। যিনি নিজে বাংলার সকল বিধবার হয়ে কথা বলছেন। কাটাছেঁড়া করে বুঝিয়ে দিতে চাইছেন তাঁদের মনন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, যন্ত্রণা ও সীমাবদ্ধতা। আর ‘সাহিত্যদূত’ হয়ে তা পৌঁছে যাচ্ছে ‘প্রিয়তম’র কাছে। বর্মায় বসেও একাকী শরৎচন্দ্র নিরুপমার লেখার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতেন। তিনি লিখেছেন, ‘সে যাহা লেখে, একটুখানি অংশ আমি মনে মনে আদায় করিয়া নদীর ধারে জেটির উপর বসিয়া পরিপাক করি এবং কামনা করি যেন বাঁচিয়া থাকিয়া বিশেষ একটু ভাল জিনিষের স্বাদগ্রহণ করিতে পারি।’

তৎকালীন বাংলার সাহিত্য মহলে এই দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। নিরুপমার ব্যক্তিজীবন এতই বিষিয়ে উঠেছিল যে, শেষে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন শরৎচন্দ্রকে চিঠি লিখে জানাতে, “আর এখানে আসিবেন না। আমাকে এ’ভাবে নষ্ট করিবেন না।” নবনীতা দেবসেনের মা সাহিত্যিক রাধারাণীদেবী উল্লিখিত নিরুপমার এই চিঠি নাকি আজীবন তাড়িয়ে বেরিয়েছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। এরই প্রকাশ ঘটেছে দু’জনের সাহিত্যে। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত নিরুপমার ‘দিদি’ উপন্যাসের উমা বলে ওঠে, “যাও, তুমি যাও, কেন এসব বল্লে, কেন এসেছিলে? আমি শুনব না, তুমি যাও।” আর পরের বছর ১৯১৬ সালে প্রকাশিত শরৎচন্দ্রের ‘পল্লীসমাজ’-এর রমার উক্তি, ‘আমি মিনতি করছি রমেশদা, আমাকে সব দিকে নষ্ট করো না। তুমি যাও।’ শরৎ ও নিরুপমার সাহিত্য নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা হলে

হয়তো সম্পর্কের এক সুপ্ত দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

১৯০৪ সালে ‘অনুপমাদেবী’ ছদ্মনামে নিরুপমা দেবী ‘প্রত্যাখান’ গল্পটি লিখে কুন্তলীন পুরস্কার পান। তার পরে ১৯৪১ পর্যন্ত একে একে তিনি লিখে গিয়েছেন ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ (১৯১৩), ‘দিদি’ (১৯১৫), ‘আলেয়া’ (১৯১৭), ‘বিধিলিপি’ (১৯১৯), ‘শ্যামলী’ (১৯১৯), ‘বন্ধু’ (১৯২১), ‘আমার ডায়েরী’ (১৯২৭), ‘যুগান্তরের কথা’ (১৯৪০), ‘অনুকর্ষ’র (১৯৪১) মতো গ্রন্থিত উপন্যাস ও ছোটগল্প। ক্রমশ তিনি হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে এমনই এক লেখিকা, যাঁর জুড়ি নেই।

নিরুপমার সাহিত্যসঙ্গী বলতে ছিলেন অনুরূপা দেবী (গঙ্গাজল সই), ইন্দিরা দেবী (ওপোদিদি), হেমনলিনী দেবী, সুষমা সিংহ। নিরুপমার সাহিত্যের মূল্যায়ন করতে গিয়ে জ্যোতির্ময়ী দেবী লিখেছিলেন, “বিধবাদের জগতে সব সময়েই দ্বিধাদ্বন্দ্ব, পরমুখাপেক্ষা, অসাধারণ সঙ্কোচ। চারিদিকেই একটি স্বর্গীয় ব্যক্তি অভিভাবকত্বের স্থান নিতেন। রক্ষণাবেক্ষণ করতেন স্বয়ং নিযুক্ত সমাজপতি ও কর্তৃপক্ষের দল। এ একটি প্রতিদিনের কঠিন দৃষ্টির বিচারশালার জগৎ। তবু সেই জগৎ থেকেই নিরুপমা দেবী নিয়ে এলেন তাঁর সাহিত্যের পসরা। ...যেখানে কোনও কিছুরই চমক নেই। ...স্নিগ্ধ ভাষায় ঘরোয়া সমাজের ছোট বড় সুখ দুঃখের কাহিনী ও ঘটনা নিয়ে লেখা উপন্যাস ও গল্প।”

১৯০৭ সালে নফরচন্দ্রর মৃত্যুর পর ভাগলপুরের পাট চুকিয়ে নিরুপমা চলে আসেন বহরমপুরে। তখন তিনি ২৪ বছরের তরুণী। ভাগলপুরে থাকতেই তিনি বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। বহরমপুরে এসে হাল ধরেছিলেন বিরাট পরিবারের। এই পর্বের নিরুপমা দেবীকে দেখে দুর্গাদাস ভট্টর মনে হয়েছিল, যেন তিনি জীবনের রূপ-রস-গন্ধ, আশা-আকাঙ্ক্ষা উপভোগ করতে চাওয়া সম্পূর্ণ এক নারী। দুর্গাদাসের কথায়, “তাঁকে সংসারে সন্ন্যাসী তো বলা চলে না। ...নিরুপমার দাপট তখন ভিন্নমাত্রায়, তাঁকে যে আমার বাবা-কাকারা একেবারে মাথায় তুলে রেখেছেন

সে কথা শুধু আমার মা কাকীমারা কেন, পুরো বহরমপুর শহরেরই আলোচ্য বস্তু।”

চিত্ররেখা গুপ্ত জানিয়েছেন, “বাড়ির পিছনের বাগানে বাতাবি লেবু, নারকেল, কাঁঠাল গাছ। বাগান রক্ষার জন্য নিরুপমা বিখ্যাত শিয়ালা ডাকাতকে ডেকে পাঠালেন চোরেদের সতর্ক করে দেবার জন্য। এই ডাকাতও নাকি যমের মতো ভয় পেত নিরুপমাকে।” এক সময়ে বিভূতিভূষণের পুত্র বিষ্ণুযশাকে দত্তক নিয়েছিলেন নিরুপমা। সন্তান সুখ মেটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই শিশুটি বেশি দিন বাঁচেনি। এই ঘটনা তাঁর ‘পরের ছেলে’ উপন্যাসের উৎসভূমি বলে জানিয়েছেন চিত্ররেখা। এ সবেরই পাশাপাশি তিনি লিখে গিয়েছেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলি।

১৯২৭ সালের পরে নিরুপমার কোনও উপন্যাস প্রকাশিত হয়নি। তখন তিনি দেশব্রতী হয়ে যোগ দিয়েছেন স্বাধীনতা আন্দোলন ও সমাজ উন্নয়নের কাজে। আইন অমান্য আন্দোলনে পতাকা কাঁধে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। অন্য দিকে সে কালের বিপ্লবীদের পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন। সুভাষচন্দ্র বসু তাঁকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। নারীশিক্ষার জন্য বন্ধু সুষমা সিংহকে নিয়ে রক্ষণশীলতার বেড়া ভেঙে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ ভিক্ষা করে বহরমপুরে মেয়েদের জন্য চালু করেছিলেন ‘কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়’। তাঁর কর্মকাণ্ড শুধু মাত্র বহরমপুরে আটকে ছিল না। তিনি মহিলা কংগ্রেসে যোগ দিতে কলকাতার টাউন হলে গিয়েছেন। সেখানে বিধবা-বিবাহের প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের হয়ে গলা তুলেছেন।

১৯২৭ সালের পরে ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় নিরুপমার ‘যুগান্তরের কথা’ ও ১৯৪১ সালে ‘অনুকর্ষ’। দীর্ঘ ১৩ বছর পার করে। সাহিত্যজগৎ থেকে তাঁর এই দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণ কেবল মাত্র দেশ ও সমাজ-সংস্কারের কাজে যুক্ত হওয়াই হয়তো নয়। সাহিত্য-পরিমণ্ডল থেকে সরে আসার অন্য কারণও থাকতে পারে। ১৯৩২ সালে ‘জয়শ্রী’ পত্রিকায় নিরুপমা নিজের জীবনকথা লিখতে গিয়ে শরৎচন্দ্রের অনুরাগীদের কাছে যে লাঞ্ছিত হচ্ছিলেন বিভিন্ন সভা-সমিতিতে, তা নিজেই জানিয়েছিলেন। “এ লাঞ্ছনা ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’কে ঘিরে হলেও শরৎচন্দ্রের দ্বারা সাহিত্য-রচনায় তিনি কী ভাবে ঋণী এসব প্রশ্ন করেও অসম্মানজনক ভাবে তাঁকে বিব্রত করা হচ্ছিল।” তাই নিরুপমা সাহিত্য-জগৎ থেকেই সরে এসেছিলেন। মন দিয়েছিলেন নারীদের জন্য শিক্ষা ও স্বাধীনতার পথ খুলে দেওয়ার দিকে। তবে শরৎচন্দ্রের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা চিরকালই থেকেছে। শরৎচন্দ্রের ৩৫তম জন্মদিনে কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে গাইবার জন্য তিনি লিখে দেন,

“তুমি যে মধুকর কমল বনে/

আহরি আন মধু আপন মনে।”

১৯৩৬ সালে বর্ধমান সাহিত্য পরিষদ নিরুপমা দেবীকে সংবর্ধনা দেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৮ সালে তাঁকে ‘ভুবনমোহিনী’ স্বর্ণপদক ও ১৯৪৩ সালে ‘জগত্তারিণী’ স্বর্ণপদক দেয়। ইতিমধ্যে ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মারা যান। ১৯৪০ সালে আমরা দেখি, নিরুপমা দেবী ফিরে এসেছেন বাংলা সাহিত্যজগতে তাঁর নতুন উপন্যাস ‘যুগান্তরের কথা’ ও পরের বছর ‘অনুকর্ষ’ নিয়ে। ওই সময়ে তিনি খুঁজে পেয়েছেন এক জন গুরুকে। যাঁর নাম গৌরগোবিন্দ ভগবৎ স্বামী। ‘এই বৈষ্ণব সাধু তাঁকে চিদানন্দস্বরূপ কৃষ্ণের খোঁজে নিয়োজিত’ করেছেন। নিরুপমার উপন্যাসে নারীর বৈধব্য, যন্ত্রণা, সমাজজীবনকে ছাপিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর গুরু এবং সেই গুরুর তত্ত্বকথা।

নিরুপমা কখনও সঙ্কুচিত জীবন যাপন করেননি। তিনি সহায় সম্পদহীনও ছিলেন না। সংসারে তাঁর প্রতাপের কথা বলেছেন তাঁর পরিবারের লোকেরা। তাঁর অর্থ সামর্থ্যের অভাব হয়নি। লেখার রয়্যালটির টাকা পেতেন নিয়মিত। শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির ভাগও পেয়েছিলেন। কিন্তু তবু তাঁর জীবনের যাত্রাপথে লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁর মনের গভীরতম সত্তাটিকে। যার পরিচয় রয়েছে তাঁর লেখা ডায়েরির পাতায়। যা পড়লে মনে হয়, সংসারে তিনি নিজের একটি বাহ্যিক চেহারা তৈরি করে নিয়েছিলেন। প্রকৃত সত্তায় তিনি আচারনিষ্ঠ বিধবা নন। তিনি ‘রূপ পিপাসু’ এক নারী। ডায়েরির এক জায়গায় লিখেছেন, “মনে হল আমি বোধহয় একটু বেশি রকম রূপ পিপাসু! যেখানে সৌন্দর্য, সত্যই আমি সেখানে অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। চুপ করে সে আকাশের সৌন্দর্য্য দেখাই যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখ বলে মনে হয়।”

এই রূপপিপাসু অসামান্য সাহিত্যিক চিরকাল নিজের অন্তরকে চুপ করিয়েই রেখেছেন। বাসনাকে কখনও প্রশ্রয় দেননি। ডায়েরিতে রয়েছে তার পরিচয়, “প্রকাণ্ড একটা বন্যা! ভেতরে যেন অশ্রুর প্রচণ্ড একটা বেগ টল্‌মল্‌ করে উঠছে— কূল ছাপাচ্ছে— সমস্ত পৃথিবীটাকে সুদ্ধ তার রুদ্ধ আবেগে... উৎক্ষিপ্ত বেগে কূল ছাপিয়ে হু-হু শব্দে সে কোথায় কোথায় ছুটবে?— হায় নাথ! এ প্রচণ্ড ধারা সমস্ত জগতটা ভাসিয়ে ছুটে গিয়ে পড়বে কোন বাসনার কোন অতল গহ্বরে? বাসনার কোন অতল কূপে? না প্রভু তা হতে দিও না। নাও তুমি আমায় টেনে নাও, আমার মহাসমুদ্র! আমার এ মনকে সবলে আকর্ষণ করে তোমার পানে নিয়ে চলো! তোমার আকর্ষণের উপরে সে তুচ্ছ বাসনাকে জয়ী হতে দিও না।”

নিরুপমা নিজের বাসনাকে জয়ী হতে দেননি। জীবনের শেষ দশ বছর তিনি কাটিয়েছিলেন বৃন্দাবনে মা যোগমায়ার সেবা শুশ্রূষায়। সংসার, সন্তান তাঁর ছিল না। তাই মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব বিধবা নিরুপমাকেই নিতে হয়েছিল। বহরমপুরে নিজের আপনজনদের থেকে দূরে, বাংলা সাহিত্যজগৎ থেকে দূরে, সুদূর বৃন্দাবনে আরও অনেক ভাগ্যহত বিধবার ভিড়ে নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের যশস্বী এই লেখিকা। মাঝে মাঝে যোগাযোগের অভাবে অর্থকষ্টেও ভুগেছেন। এমনকি জগত্তারিণী পদক বন্ধক রেখেছেন। মাকে সেবা করতে গিয়ে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে দেখার কেউ ছিল না। ১৯৪৭ সালে অসুস্থ নিরুপমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল রাধারাণী-নরেন দেবের। তাঁদের দেখে নিরুপমা ব্যাকুল ভাবে কেঁদে উঠেছিলেন। রাধারাণী লিখেছেন, “ওঁর অন্যমুখী নিভৃত শান্ত জীবনে আমরা যেন ঢিল ছুঁড়ে তরঙ্গ বিক্ষেপ সৃষ্টি করে এলাম।” রাধারাণীকে জড়িয়ে ধরে নিরুপমা কিছুক্ষণ কাঁদেন। তার পরে বলে উঠেছিলেন, “তোমরা দুজনে এসেচ? তোমরা আমার কাছে এসেচ? ...তোমরা আমার কত আদরের জিনিষ। তোমরা শরৎদার রাধু-নরেন।” ১৯৪৯ সালে বৃন্দাবনে যোগমায়া দেবী মারা যান। তার দু’বছর পরে ৭ জানুয়ারি, ১৯৫১ সালে চলে যান নিরুপমা। বৃন্দাবনেই তাঁর শেষকৃত্য হয়। নিরুপমা দেবীর বিধিলিপিতে অটুট বিশ্বাস ছিল বরাবর!

ঋণ: অভিজিৎ ভট্ট, আত্রেয় ভট্ট

চিত্ররেখা গুপ্ত, বরুণ দাস

ছবি: মৃণাল গুপ্ত,

গৌতম প্রামাণিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE