Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সাদা কালো থিয়েটার

‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্যদলের নতুন নাটক ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’র মহলা দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়হাঁসুলী বাঁকের কথা বলব কারে ভাই/ কোপাই নদীর জলে কথা ভেসে যায়…তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে কি এক সময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লীন হয়ে ছিলেন? ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’র কাহিনি ভাসলেই এ প্রশ্ন কেন যে বারবার ঘাই মারে! শুধু উপন্যাসটি পড়লেই নয়, কোপাই নদীর পারের এই গল্প নিয়ে তপন সিংহর ছবি দেখলেও যেমন এ কথা তাড়া করে, সৌমিত্র মিত্রর ‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্যদলের ‘হাঁসুলী বাঁকের …’ মহলা দেখতে বসেও আবার সেই একই ধন্ধ (প্রথম শো ২ অগস্ট, একাডেমি, সন্ধে সাড়ে ৬টা)!

মহলায় অন্যদের সঙ্গে কালো বেশে শান্তিলাল সাদা থানে সুরঞ্জনা। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

মহলায় অন্যদের সঙ্গে কালো বেশে শান্তিলাল সাদা থানে সুরঞ্জনা। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

হাঁসুলী বাঁকের কথা
বলব কারে ভাই/ কোপাই নদীর জলে কথা ভেসে যায়…

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে কি এক সময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লীন হয়ে ছিলেন?
‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’র কাহিনি ভাসলেই এ প্রশ্ন কেন যে বারবার ঘাই মারে!
শুধু উপন্যাসটি পড়লেই নয়, কোপাই নদীর পারের এই গল্প নিয়ে তপন সিংহর ছবি দেখলেও যেমন এ কথা তাড়া করে, সৌমিত্র মিত্রর ‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্যদলের ‘হাঁসুলী বাঁকের …’ মহলা দেখতে বসেও আবার সেই একই ধন্ধ (প্রথম শো ২ অগস্ট, একাডেমি, সন্ধে সাড়ে ৬টা)!
প্রেক্ষিত-কাহিনি না মিললেও তারাশঙ্করের হাঁসুলী বাঁকের উপকথা-র করালী আর মানিকের পদ্মা নদীর মাঝি-র হোসেন মিঞা কি কোথাও মিলেমিশে যান?
মজা হল, সাহিত্যই বলুন, কী সিনেমা বা নাটক, সব ক্ষেত্রেই বহুলাংশেই সময়কালের ‘রূপক’টি দাঁড়িয়ে এ-দুটি চরিত্রের ওপর।

•••••

করালী-হোসেন মিঞা মেলামেলি, এ তো তা’ও পুরনো ধাঁধা।

পালাটি অল্প খানিক গড়াতে আরও যে একটি ধন্ধ উস্কে দিয়ে গেল, তা বেশ নতুন এবং বড়সড়!— ২০১৫-তে দাঁড়িয়ে সিনেমার মতো থিয়েটারেও সাদা-কালো দৃশ্যায়ন তবে সম্ভব!

রং এল দু’টি কি তিনটি মাত্র দৃশ্যে। তা’ও প্রায় শেষ দিকে। বাকি প্রায় সওয়া দু’ঘণ্টার নাটকে পোশাক, প্রপস, সেট...— হাল্কা নীল আলো়টুকু ছাড়া সব ওই সাদা, নয়তো কালো।

মঞ্চ জুড়ে পাতা ঝরা সিড়িঙ্গি লম্বা লম্বা গাছ। এক পাশে কচি বাঁশের বেড়া। চৌকি। পিছন দিকে ব্রিজের মতো আড়া পাটাতন। ধোঁয়াশা জাল…— কালো-সাদা বই তো নয়! পোশাকও তাই। সাদা-কালো ছোপ ছোপ শাড়ি। চেক-চেক উড়নি। ফতুয়া, ধুতি সব সাদা।

•••••

‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্যদলের ক্লাসিকস্-এ ঝোঁক নতুন নয়। — ‘বিসর্জন’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’…।

নতুন নয় দলের বাইরে থেকে কাউকে ডেকে পরিচালনার ভার দেওয়াও।— বিভাস চক্রবর্তী, অরুণ মুখোপাধ্যায়, রমাপ্রসাদ বণিক কী ব্রাত্য বসু বা দেবেশ চট্টোপাধ্যায় — নির্দেশনা দিয়েছেন অনেকেই। কিন্তু প্রত্যেকেই তখন হয় প্রবীণ, নয় পোড়খাওয়া। সে দিক থেকে ঝুঁকিপ্রিয় এ দলটি এ বারে পরিচালনা থেকেই বড় মাপের চমক আনলেন।

‘হাঁসুলী বাঁকের…’ পরিচালনায় কৌশিক কর। নাট্যরূপ তাঁরই। ‘দেবী স্বর্পমস্তা’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘হয়বদন’, ‘জতুগৃহ’, ‘বোমা’-র মতো নাটকে অভিনেতা কৌশিক বা ‘মা এক নির্ভীক সৈনিক’, বা ‘নাটকফাটক’-এ অভিনেতা-নির্দেশক কৌশিক, এর মধ্যেই বাংলা রঙ্গমঞ্চের উঠতিদের মধ্যে থিয়েটারের বোদ্ধাদেরও নজরে। ‘পূর্ব পশ্চিম’-এর নতুন থিয়েটারের ব্যাটন এখন তাঁরই হাতে। এ নাটকের করালীও তিনি।

•••••

হাঁসুলী গয়নার মতো কোপাই-এর বাঁক যেখানে, সেখানেই নদীর বেড়ে বাঁশবাঁদি গ্রাম। তার উত্তরে জাঙল গ্রাম।

জাঙলে ভদ্রলোকের বাস। কুমার- সদগোপ। চাষি সদগোপ। গন্ধবণিক। নাপিত আছে ক’ঘর। তন্তুবায়ও। জাঙলের সীমানাও বড়। এখানে পড়ে নীল কুঠিদের পতিত জমি।

বাঁশবাঁদি ছোট গাঁ। তার দুই পুকুরের চার পাড়ে ঘর তিরিশেক কাহার উপজাতির বসতি।

দিন কয়েক ধরে কেউ যেন শিস দিচ্ছে পল্লি-বাদাড়ের আনাচে-কানাচে। কখনও দু-গাঁয়ের মাঝে। কখনও বেলগাছ-শ্যাওড়া ঝোপে ভর্তি ব্রহ্মদৈত্যতলায়। কখনও কুলকাঁটার জঙ্গলে, তো কখনও বাঁশবনে। এই শিস নিয়ে ত্রাস ছড়িয়েছে সবখানে। তবে কি গাঁয়ের দেবতা কর্তাবাবা রুষ্ট হলেন?

কর্তাবাবার গল্প শোনায় কাহার-জ্যেষ্ঠা সুচাঁদ (সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত)। পাটের শনের মতো তাঁর চুল। ন্যুব্জ শরীর। হাতে লাঠি।— সে বলে, বাবার দয়াতেই হাঁসুলী বাঁকের যা কিছু। ‘অধম্ম’ তাঁর সয় না। ‘অমান্যি’ করলে তিনি ছেড়ে চলে যাবেন। বুড়ি কাঁদে। এই বুঝি সে সময় এল।

তারাশঙ্করের উপন্যাসের এই মুখড়া ধরেই গল্প এগোয়।

রাতের অন্ধকারে শিকার ধরে কাহাররা। বাঘ ডাকে। সাপে কাটে। ভালুক তাড়ায়। বুনো শুয়োর মারে। প্রলয় নামে। হড়পাবান ভাসিয়ে দেয়। দিন যায়, দিন আসে। তার মধ্যেই সংসার বয়। সে সংসারে কত রং! পীড়িতের। ভাঙনের। শরীর দেওয়ায়, নেওয়ায়। ভেঙে যাওয়া, হারিয়ে ফেলা প্রেমের কান্নায়।

কাহারদের মুনিবে ঠকায়। জমিদারে ভাগায়। সুখা জমিনে চাষকাজে তাদের জীবন ফাটে। সেই নীলকরের তবিলদারিতে যেমন ছিল। তেমনই।

পৃথিবীতে যুদ্ধ লাগলে, সে যুদ্ধের আঁচেও পোড়ে কাহারের কপাল। অথচ যাদের গোছানোর তারা ঠিক গুছিয়ে নেয়।

এ জীবন করালীর পছন্দ নয়। গাঁয়ের আর ক’জনের মতো সে নয়। এ-পাড়ার ছেলে হয়েও চন্দনপুরে রেললাইনে মজুর খাটে করালী। স্যুট পরে। আতর মাখে। পড়শির কান ভাঙিয়ে নিয়ে যেতে চায় কুলিকামিনের কাজে। হোসেন মিঞার ময়নাদ্বীপের মতো।

করালীর সঙ্গে কখনও লাগে গাঁয়ের মাতব্বর বনওয়ারীর (শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়), কখনও জমিদার মাইতো ঘোষের (সৌমিত্র মিত্র) বা অন্য কারও।

এর মধ্যেই পরব আসে। পরব যায়। সাঙা (বিয়ে) হয়। সাঙার গান বাজে— ‘আলতা সিঁদুরে রাঙা/বিহা ছেড়ে করব সাঙা’। নাচ জমে।

এ সব দৃশ্যে হঠাৎ হঠাৎ ঝলক মারে ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’— লীলাবালি লীলাবালি/ ভর যুবতী সই মুর/ ভর যুবতী ঘরে/কী দিয়া সাজাইব তরে’। ‘কোমলগান্ধার’-এর ‘আমের তলায় ঝামরঝুমুর/ কলা তলায় বিয়া…’।

সাঙা ভাঙে। প্রেম ভাঙে। পীড়িতের মৃত্যু হয়। আবার গান ভাসে। করুণ, কান্না রসের— ‘ও হায়, চোখের জলে মুক্তছটা মাটির বুকে ঝরে না’।

কত যে গান! বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তন, ঝুমুর, সুফি…। ভৈরবীর তান…।

অপেরার মতো বাজনদার বসেন মঞ্চের ঠিক বাইরে (অভিজিৎ আচার্য, সুরকারও তিনি)। ধামসা, ঢোল, ঢাক, খোল, বেহালা, কাঁসর, ঘণ্টা… । মঞ্চ থেকে মঞ্চের খানিক বাইরে অবধি অনেকটা যেন এরিনার ধাঁচা পায়।

একেক সময় প্রায় জনা কুড়ি এক সঙ্গে অভিনয় করে যায়। তাঁদের অভিনয়ে একেক রকম জ্যামিতিক আকার গড়ে। আবার সরে সরে যায়।

লাঠি খেলা। লাঠালাঠির যুদ্ধ। দুমড়েমুচড়ে ওঠা শরীরের পাঞ্জা। শরীরে-শরীরে কোঠা বাড়ি দাঁড়িয়ে পড়া। সে-বাড়ি গুঁড়িয়ে যাওয়া…।

সব মিলিয়ে কখনও ‘নান্দীকার’-এর ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ মনে পড়ে। মনে পড়ে বাদল সরকারের থিয়েটার।

এ নাটক প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকা, মরে যেতে যেতে, মার খেতে খেতে, তলিয়ে যেতে যেতেও ভেসে ওঠার গল্প শোনায়। কখনও তার মৃত্যুঘণ্টার স্বরূপ চেনায়। তার জীবন, তার সংস্কৃতি গিলে ফেলার ছবি দেখায়। সে-ছবি যেমন সে দিনের কাহারদের, তেমন আজকেরও। বাণিজ্যের থাবার নীচে কখনও লাট খাওয়া, কখনও ‘ল্যা ল্যা’ করা সময়টার।

সবটাই কালোয় আর সাদায়।

রং লাগে শুধু সমর্পণে আর স্বপ্নে।

যে বাঁশিতে লাঠি হয় ভাই/ সেই বাঁশে হয় বাঁশি/ বাঁশবাদির বাঁশগুলিরে তাইতো ভালবাসি…

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE