ছবি: শ্রীমাল্য মৈত্র
পত্রিকা: সিনেমার আপনি যেন ইনস্ট্যান্ট কফি। আর থিয়েটারের জারক লেবুর শরবত!
সুমন: (ঈষৎ ভ্রু তুলে) ঠিক মানতে পারলাম না। আমার সিনেমাগুলো পরপর যদি দেখেন, ‘হারবার্ট’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘মহানগর@কলকাতা’, ‘শেষের কবিতা’...বিশাল সময়ের প্রেক্ষাপট ধরা আছে। কোনটা তাৎক্ষণিক? বরং বলব, ‘মেফিস্টো’, ‘যারা আগুন লাগায়’ নাটকে চটজলদি সময়কে ধরার চেষ্টা ছিল।
পত্রিকা: ‘অসমাপ্ত’ কোন গোত্রের?
সুমন: বিরাট সময়ের ‘স্প্যান’টা এখানে নেই। মূল উপন্যাস শীর্ষেন্দুবাবুর (মুখোপাধ্যায়) ‘আশ্চর্য ভ্রমণ’। তার থেকেই পাঁচ-ছ’টা দিনের গল্প দাঁড় করিয়েছি।
পত্রিকা: ‘আশ্চর্য ভ্রমণ’ হঠাৎ ‘অসমাপ্ত’ হয়ে গেল!
সুমন: যখন একটা ছবি করি, তখন আমার সঙ্গে আমার নিজের এক ধরনের সংলাপ চলে। কতগুলো খোঁজের জায়গা থাকে। এখানে সেই খোঁজ, সম্পর্কের অলিগলি। দেখুন, সব সম্পর্কেই ফাঁক আছে। কোনও সম্পর্কই সম্পূর্ণ নয়, উপন্যাসের যে অংশটা বেছেছি, সেখানে এমনই ঘটনার পরম্পরা থাকবে।
পত্রিকা: নিজেকে অসমাপ্ত ভাবেন!
সুমন: ভাবছি। বিশেষ করে আমার শৈল্পিক জীবনে। এখনও থিয়েটারকে যা দিতে পারি বা সিনেমা যে ভঙ্গিতে করতে চাই, পারছি না। একটা অভাববোধ সারাক্ষণ কাজ করে...
পত্রিকা: ছবিতে এই অভাববোধটা কী ভাবে আসছে?
সুমন: তা’হলে কাহিনির একটু ধরতাই দিই। (একটু থেমে) ... মূল চরিত্রটা করছে ঋত্বিক (চক্রবর্তী)। ছোটবেলায় সে বাবার সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল দার্জিলিং। দূর থেকে পাহাড় দেখেছিল। কোকিলের ডাক শুনেছিল। সেটা ওর মাথায় থেকে গিয়েছে। এ বার ও রি-ভিজিট করতে চায়। ঋত্বিক ওঠে তার পুরনো বন্ধুর (ব্রাত্য বসু) বাড়ি। বন্ধুর স্ত্রী (স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়) আছে, কিন্তু তাঁদের সম্পর্কের উষ্ণতা বলে কিছু নেই। এরই মাঝে বেড়াতে আসে ঋত্বিকের প্রাক্তন বান্ধবী (পাওলি)। সবাইকে নিয়ে সম্পর্কের তরঙ্গ তৈরি হয়... অসম্পূর্ণতার অভাববোধও।
পত্রিকা: এ তো মনে হচ্ছে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বা অঞ্জন দত্তর ফিল্ম!
সুমন: (থামিয়ে দিয়ে) শুনুন, থিয়েটার বা সিনেমায় আমি যখন বড় ক্যানভাস ধরেছি, তখন ইতিহাসের লেন্স হিসেবে এসেছে কখনও বাঘারু, কখনও হারবার্ট...। কিন্তু সব সময় যে ইতিহাস-সমাজ-রাজনীতিই একমাত্র বড় ক্যানভাস তৈরি করে তা নয়, মানুষের অন্তর যে কত গভীর ক্যানভাস! তাই...
‘অসমাপ্ত’য় স্বস্তিকা
পত্রিকা: সম্পর্কের কাটাছেঁড়া। ব্যাকগ্রাউন্ডে পাহাড়। আশিটা বাংলা ছবি হয়েছে এমন। দর্শক আবার কেন দেখবে আপনার ছবি?
সুমন: আমরা কেন বারবার ‘হ্যামলেট’ পড়ি? জীবনানন্দ পড়ি? বার্গম্যান দেখি? ঠিক সেই কারণেই। জীবনের কয়েকটি সত্য পুনরাবিষ্কারের দরকার আছে। আর নিজেকে বারবার না পাল্টালে নিজের ওপর বিশ্বস্ত থাকা যায় না। প্রেমের গল্প, সম্পর্কের গল্প তো কোটি কোটি লেখা হয়েছে। আজও লেখা হয়। লোকে যদি পছন্দ না করত, লেখাই হত না। দায়বদ্ধতা, একাকিত্ব, নিজের সঙ্গে টানাপড়েনের সব উত্তর এখনও কিন্তু অমীমাংসিত।
পত্রিকা: বড্ড বেশি ব্যক্তি-ব্যক্তি শোনাচ্ছে! সামাজিক অনাচার নিয়ে এক কালে মিছিলে হাঁটা সুমন মুখোপাধ্যায়কে এখন তবে নির্ভয়া কাণ্ড বা জমি বিতর্কর মতো ঘটনা ইত্যাদি বিচলিত করে না?
সুমন: করে। কাজও করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ভাবনাটা চিত্রমাধ্যমে প্রকাশ করতে কতকগুলো জরুরি চিহ্ন পাওয়া দরকার। নইলে সেটা প্রকাশের জন্য প্রকাশ হয়ে যাবে।
পত্রিকা: তাই? না কি অন্বেষণটাই বদলে যাচ্ছে আপনার?
সুমন: তা নয়। আমি আজও ভাবি কৃষক-হত্যা নিয়ে ছবি করব। সারা পৃথিবীতে ফ্যাসিজিম যে ভাবে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, আমায় ভাবায়। সারাক্ষণ ইতিহাস, দর্শন পড়ি। তা বলে কি প্রেমের কবিতা পড়ব না?
পত্রিকা: একটা কথা বলবেন?
সুমন: বলুন।
পত্রিকা: বাংলা ছবিতে ঋত্বিক ঘটক-মৃণাল সেন-বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। কোথায় যেন এই যুগটার পর একটা ফাঁক তৈরি হল!
সুমন: একদম। বড় একটা ফাঁক। বাংলা ছবি আজ দিশাহীন। আর সেই দিশাহীনতাটাকেই চ্যাম্পিয়ন করা হচ্ছে। তাই ভাবছি, কী ভাবে নিজের গতিটাকে অন্য দিকে বওয়ানো যায়... দরকারে শর্ট ফিল্ম বানাব। টাকা-টাকা করে না ভেবে অন্য উপায় দেখব। ইরানিয়ান, বেলজিয়ান ছবি দেখুন না! জাফর পানাহি আই ফোন-এ সিনেমা বানিয়ে পৃথিবী টলিয়ে দিলেন...
পত্রিকা: বাংলা থিয়েটারেও একটা কাণ্ড ঘটছে। এক দল বিস্তর বাজেটে থিয়েটার বানাচ্ছে। তাদের কারও সাফল্য উদ্যাপিত হচ্ছে ককটেল পার্টিতে! অন্য দিকে বহু থিয়েটার গ্রুপ বছর বছর সরকারি গ্রান্ট পাচ্ছে না!
সুমন: দেখছি। বিরক্তও লাগছে। কিন্তু অন্য একটা কথা, যে পদ্ধতিতে এখনও আমরা থিয়েটার করে ়়যাচ্ছি, সেটা আর্কাইভ হয়ে গেছে। সেই মাস গেলে ক’টা শো। সেই একাডেমি, রবীন্দ্রসদন নিয়ে ধাক্কাধাক্কি। ব্রাত্য (বসু) যে পাইকপাড়ায় নিয়মিত চর্চা করছে, সেটা খুবই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু ঠিক এই স্পেস বদলের কথা বলছি না। মূল যে কথাটা বলছি, সেটা আরও গভীর নাট্যভাষার খেলা। নতুন স্পেস তৈরি করতেই হবে। দরকারে ‘ব্ল্যাকবক্স থিয়েটার’-এর মতো। কালো একটা বক্স-টাইপ ঘরে থিয়েটার। অনেকটা যেমন বাদল সরকার করতেন। তার এক্সটেনশন...
পত্রিকা: কিন্তু বাংলায় তো এখন আপনি পরিযায়ী পাখির মতো!
সুমন: বিশ্বাস করুন, কলকাতায় থেকে আমি হেজিয়ে যাচ্ছিলাম। থিয়েটার নিয়ে আমার যে লার্নিং, সেটা পচে যাচ্ছিল। আর সত্যি কথা বলি? মুম্বইয়ে বসে বাংলা থিয়েটার যে খুব মিস করছি, তা’ও নয়।
পত্রিকা: মুম্বইতে কী করছেন?
সুমন: থিয়েটার ফিল্মিং করছি। স্টেজ থিয়েটারকে ফিল্মে ধরছি। দর্শক দেখছে শুধু ফিল্মটা। স্টেজেরটা নয়। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ করলাম রঘুবীর যাদবকে নিয়ে। ইবসেনের ‘ডলস্ হাউস’ করলাম। স্বস্তিকা করল। শেষে ‘চোখের বালি’। পার্নো মিত্র যেখানে বিনোদিনী। ‘বিসর্জন’ করব। দেখি যদি আশিস বিদ্যার্থীকে পাওয়া যায়! একটা প্রস্তাব পেয়েছি, বন্ধ জুট মিলগুলো, যেগুলো বিশাল ক্লাব বা বার হয়ে গেছে, সেখানে থিয়েটার করার। দিস ইজ রিয়্যালি এক্সাইটিং। নিজেকে বারবার কমফোর্ট জোনের বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলতেই হবে। অপ্রস্তুতির জায়গায় আনতে হবে। নইলে শেষ!
পত্রিকা: সেই অপ্রস্তুতির জায়গায় ফেলতেই বুঝি বান্ধবীকে নিরন্তর চুমু খাওয়ার ভিডিয়ো ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন?
সুমন: আমি কি কোনও ঐতিহাসিক দাদন গিলেছি যে, চুমু খেতে পারব না! মুখটা বাংলার পাঁচ করে থাকব। দেখুন, সামাজিক আচরণ নিয়ে আমাদের কতকগুলো ট্যাবু আছে। তার বাইরে গেলেই গেল-গেল। আগে মদ্যপান নিয়ে ছিল। পোস্টিংটাতে সিম্পলি মজা করে...
পত্রিকা: হারবার্টসুলভ ধ্বংসাত্মক মজা বলছেন! যেখানে প্রাইভেট লাইফকে পাবলিক করে ‘জেহাদ’ দেখানো যায়। তাই তো?
সুমন: না, তা নয়। তবে আমরা খুবই স্বচ্ছ থেকেছি। স্বচ্ছতাই কিন্তু দায়বদ্ধতার প্রমাণ। প্রেমেও যেমন, বিচ্ছেদেও তেমন। যখন অন্য সম্পর্কে গেছি, আমার স্ত্রীকে সেটা জানিয়েছি। এখন আমরা ‘সেপারেটেড’। আমাদের ছেলে আছে। তার দায়িত্ব আমাদের দু’জনেরই। ওর ওপর যাতে বেশি আঘাত না আসে, দু’জনেই সেটা খেয়াল রাখি। সেটাও সাকসেসফুলি করা যাচ্ছে। ছেলের সঙ্গে আজও আমি কোয়ালিটি টাইম কাটাই। ভেতরে ভেতরে এটাও জানি, আমি অসম্পূর্ণ একজন মানুষ। অসমাপ্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy