আলো-ছায়ায় সাংতি উপত্যকা। ছবি: লেখক ও সায়ন্তী পোদ্দার।
উপত্যকার বুক চিরে এঁকেবেঁকে বইছে পাহাড়ি নদী। পাশে দিগন্তজোড়া খেত। ইতিউতি ছড়িয়ে কিউয়ি-আপেল-এপ্রিকটের বাগান। ভেড়া প্রজনন কেন্দ্রে চরে বেড়াচ্ছে ভেড়ার পাল। রয়েছে বৌদ্ধ মংপা উপজাতিদের গ্রাম। অরুণাচলের এই অজানা সাংতি উপত্যকা ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতোই সুন্দর, অপাপবিদ্ধ। তবু সে পর্যটকদের কাছে প্রায় অপরিচিতই। তাই হয়তো নেই হোটেল-রিসর্টের বাড়াবাড়ি, নেই অকারণ কোলাহল। এ যেন হিমালয়ের কোলে লুকোনো এক টুকরো স্বর্গরাজ্য।
‘‘অরুণাচলের গোটা সফরটা আপনাদের ইচ্ছেমতোই ঘুরুন, শুধু একটা দিন আমাকে দিন। এমন জায়গার সন্ধান দেব, যেখানে গেলে আর ফিরতে চাইবেন না,’’ বলেছিলেন পরিচিত ট্রাভেল এজেন্ট। অরুণাচল যাওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই প্ল্যানিং শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেশের উত্তর-পূর্বের এই রাজ্য নিয়ে চলছিল পুরোদস্তুর পড়াশোনা। তাওয়াংয়ের পথে এবং আশপাশে কোথায় কোথায় যাওয়া যেতে পারে, কোথায় থাকা হবে, দু’জন মেয়ের পক্ষে এই সফর কতটা নিরাপদ, চলেছে বিস্তর গবেষণা-বাগ্বিতণ্ডা। সেই সময়ে সাংতি উপত্যকা নিয়ে এজেন্টের এহেন পরামর্শ প্রথমে বিশেষ গায়ে মাখিনি। পরে রীতিমতো চাপাচাপিতে ভেবে দেখা গেল, ক্ষতি কী! নতুন একটা জায়গাই তো দেখা হবে। ভাগ্যিস!
নির্দিষ্ট দিনে গুয়াহাটি থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম তাওয়াংয়ের উদ্দেশে। পথে দু’রাত থাকার কথা দিরাং উপত্যকায়। কারণ, সেখান থেকে সাংতি উপত্যকা মাত্র ১০-১২ কিলোমিটার। গাড়িতে অথবা ট্রেক করেই সহজেই পৌঁছনো যায় অনামী সেই স্বর্গরাজ্যে। প্রত্যন্ত অরুণাচলের আনাচেকানাচে এমন মণিমুক্ত যে কত আছে!
প্রতি বছর শীতে এই সাংতি উপত্যকাতে আসর জমায় ব্ল্যাক নেক্ড ক্রেন। সে সময়ে এখানে বাসা বাধে তারা। পরিযায়ী এই পাখিদের টানে অবশ্য এই উপত্যকায় পা পড়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের। তবে অন্য সময়ে বাইরের লোকের দেখা মেলা ভার। অক্টোবরের যে সময়ে আমরা এই উপত্যকায় পৌঁছলাম, তখন অবশ্য পাখিদের আসার সময় হয়নি। তবে পাহাড়ের ঢালে ভেড়ার পাল, কিউয়ির বাগান আর উপত্যকার সৌন্দর্য দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেল নিমেষে।
উপত্যকায় পৌঁছে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম নদীর পাড়ে। শান্ত উপত্যকায় উচ্ছল সাংতির তীরে বসেই দিনটা কাটিয়ে দেওয়া যায় স্বচ্ছন্দে। কখনও মেঘ, কখনও ঝকঝকে রোদ্দুর— ঘড়ির কাঁটা ঘুরে চলেছে অলক্ষ্যে। নদী পেরিয়ে পাহাড়ি ঢালে ট্রেক করার ভাবনাও মনের কোণে উঁকিঝুঁকি মারছিল। গ্রামের এক-দু’জনকে দেখা গেল ছিপ ফেলে নদীর বুকেই পাথরের উপরে বসে পড়লেন। প্রতীক্ষা...
আমাদের হাতে অবশ্য অনন্ত সময় নেই। তাই নদীর তীর ছেড়ে আস্তে আস্তে ঢুকে পড়লাম গ্রামের ভিতরে। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মংপা উপজাতির মানুষগুলোর রোজনামচা দেখার আগ্রহ ছিল প্রথম থেকেই। দেখা গেল, রাস্তার পাশে সার দিয়ে কাঠের ও পাথরের বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতেই রোদে শুকোতে দেওয়া হয়েছে ভুট্টা। এ যেন ভুট্টার দেশ। কোথাও পেষাই হচ্ছে ভুট্টার দানা, যা থেকে তৈরি হবে রুটি। কোথাও ভুট্টা থেকে তৈরি হচ্ছে স্থানীয় মদ। পুড়িয়ে ভুট্টা খাওয়ার চল আছে বলে মনে হল না। মহিলাদের দেখা গেল, বাচ্চা সামলে ভুট্টা ঝাড়াই-বাছাই-পেষাইয়ের কাজ করছেন। গ্রামে যে একটা-দুটো দোকান রয়েছে, তাও দক্ষ হাতে সামলাচ্ছেন মহিলারাই।
এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি, অলিগলি— এ ভাবেই ঘুরতে ঘুরতে এক সময়ে পৌঁছে গেলাম মনাস্ট্রি। এমন প্রত্যন্ত গ্রামে আস্ত একটা বৌদ্ধ গুম্ফা! খানিকটা অবাকই হলাম। ভিতরে ঢুকতেই মনে হল, আজ যেন কী ভীষণ ব্যাপার আছে এখানে, সকলেই খুব ব্যস্ত। কেউ প্রার্থনাঘরের বাইরে বসে সুজির পুতুল বানাচ্ছেন, কেউ আবার লাগোয়া কমিউনিটি কিচেনে চাউ জাতীয় কিছু তৈরি করছেন। পাশেই অকাতরে ঘুমোচ্ছে একরত্তি। হাসিঠাট্টা-গল্পগুজবের মধ্যেই হাত চলছে নিঃশব্দে। ক্যামেরা হাতে আগন্তুকদের খচাখচ ছবি তুলতে দেখে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসিও করছেন। তাঁদের ছবি উঠছে, এ যেন ভারী হাসির কথা! কথা বলে জানা গেল, গ্রামের এক জনের শ্রাদ্ধ রয়েছে, একটু পরেই শুরু হবে অনুষ্ঠান। তাই রান্নাঘরে এত ব্যস্ততা। বর্ষীয়ান এক মহিলা বললেন, ‘‘আর কিছুক্ষণ থাকো, সব দেখতে পাবে। গ্রামের সক্কলে একটু পরে এখানেই জমা হবে।’’
বাকিদের জন্য অপেক্ষার উপায় অবশ্য ছিল না। আবার কখনও ফিরব এই স্বর্গীয় উপত্যকায়, প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাওয়াংয়ের পথ ধরলাম এক সময়ে। কিঞ্চিৎ মনখারাপকে সঙ্গী করেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy