Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দয়াবান বৃক্ষ তুমি একটি কবিতা দিতে পারো?

শামসুর রহমান লিখেছিলেন ‘একটি কবিতার জন্য’ শীর্ষক পদ্যে। চিত্রকূট গ্যালারিতে নিয়ো বেঙ্গল স্কুলের স্মরণীয় শিল্পীদের সঙ্গে ভারতের আধুনিক চিত্রকরদের বৃক্ষকেন্দ্রিক নিসর্গচিত্রের মন মাতানো ছবির প্রদর্শনী ‘ট্রিজ় অব হেভেন’ শেষ হল।

স্বতন্ত্রচিহ্নিত: ‘ট্রিজ় অব হেভেন’ প্রদর্শনীর একটি কাজ

স্বতন্ত্রচিহ্নিত: ‘ট্রিজ় অব হেভেন’ প্রদর্শনীর একটি কাজ

অতনু বসু
শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:১৪
Share: Save:

শামসুর রহমান লিখেছিলেন ‘একটি কবিতার জন্য’ শীর্ষক পদ্যে। চিত্রকূট গ্যালারিতে নিয়ো বেঙ্গল স্কুলের স্মরণীয় শিল্পীদের সঙ্গে ভারতের আধুনিক চিত্রকরদের বৃক্ষকেন্দ্রিক নিসর্গচিত্রের মন মাতানো ছবির প্রদর্শনী ‘ট্রিজ় অব হেভেন’ শেষ হল। ৪৫টি ছবিতে বৃক্ষের গহনে তরঙ্গায়িত সঙ্গীতের অনুরণন ক্রমশ নিয়ে গেল আরও অভ্যন্তরের নিবিড় নিসর্গের নিঃসীম নির্জনতায়। একটির পর একটি ছবির দর্শনে শামসুরের পঙ্‌ক্তি যেন বেজে ওঠে— ‘বৃক্ষ বলে আমার বাকল ফুঁড়ে আমার মজ্জায় যদি মিশে যেতে পারো, তবে হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।’ শিল্পীরা সত্যিই বৃক্ষ-নিসর্গের মজ্জায় মিশে গিয়ে এঁকেছিলেন অমন মন কেমন করা সব ছবি। কবিতা নয়, ছবির জন্য তাঁদের এই অনুসন্ধান অবশ্যই স্বতন্ত্রচিহ্নিত শুধু বৃক্ষকে কেন্দ্র করেই!

প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সীমারেখা পেরিয়ে ইউরোপীয় রেনেসাঁ এবং আধুনিক পর্বকে অতিক্রম করে এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিসর্গচিত্রের পরম্পরাকে ভারতীয় শিল্পীরা আত্মস্থ করেছিলেন গভীরতার সঙ্গেই। না হলে শিল্পীদের নিজস্ব প্রকরণে নিসর্গের সারল্যময় রূপটির রহস্য রোমাঞ্চের এক অতি রোম্যান্টিক পর্ব হয়তো অজানাই থেকে যেত।

চিত্রকূটের নিজস্ব সংগ্রহের এই বৃক্ষ-নিসর্গের স্বপ্নের রূপকথার শরীরে রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, বিনোদবিহারী, রামকিঙ্কর, নন্দলাল, রাধাচরণ বাগচী, যামিনী রায়, যামিনী প্রকাশ, গোপাল ঘোষ, নিখিল বিশ্বাস, গণেশ পাইন প্রমুখ শিল্পী রং-রেখার যে জড়োয়া গহনা পরিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে একাকী অথবা সমবেত বৃক্ষশ্রেণির সঙ্গে ওতপ্রোত নিসর্গও যেন ঝলমল করে ওঠে!

শ্রেণিবদ্ধ লাল চালার ছোট কুঁড়ে, সারিবদ্ধ সবুজ গাছের জলরঙে এক আশ্চর্য নৈঃশব্দ্যে টেনে নিয়ে যায় অবনীন্দ্রনাথের ছবি। যেমন বহু গাছের মাঝে বিচরণ করা একাকী হরিণ, নিঃসীম ধূসর সবুজ ও লালচে আঁধারের মাঝখান থেকে উঠে যাওয়া শুকনো লম্বা শাখাপ্রশাখা-সহ এক পল্লবহীন গাছের ডাল বৃক্ষের উপস্থিতিকে তীব্র প্রাধান্য দিয়ে দূরের নিসর্গকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ওয়াশ ছবির মতো রবীন্দ্রনিসর্গে প্রায়ান্ধকা বা রাঙা অন্তরীক্ষে ভৌতিক বৃক্ষ বা টিলা, জমির উচ্চাবচ অংশে রঙের আঁধার— সব মিলে অন্য রকম ছবি। ‘অমৃতবাণী’ কবিতার পাণ্ডুলিপির নীচে ঘটের উপরে পাতার গুচ্ছ। এও কি তাঁর এক রকম ইচ্ছে প্রকাশের নিসর্গ ছবি? হয়তো বা!

অল্প আলো, আকাশ আঁধারাচ্ছন্ন, পাহাড়ি অঞ্চলে নির্জন দুই কালো গাছ। অসাধারণ নৈঃশব্দ্যের ভাষায় প্রকাশিত গগনেন্দ্রনাথের এই ওয়াশ।

১৯৪২ সালে লেখা এক পোস্টকার্ডের পিছনে খয়েরি কলমে আঁকা ধাঁধার মতো নিসর্গ। এক মহিলা যেন পিছন ফিরে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। এমনই বিভ্রম তৈরি করেছেন নন্দলাল বসু এই পেন-ইঙ্কের ড্রয়িংয়ে!

গোপাল ঘোষের ঝোড়ো ব্রাশিংয়ে ইলেকট্রিক তারে বেশ কিছু ফিঙে, আকাশে মিশ্র রঙের দ্রুত তুলিচালনা। এক মনোমুগ্ধকর নিসর্গদৃশ্য। নীল-সবুজের হাল্কা উষ্ণ রঙের সমাহারে পট জুড়ে পাতা, গাছপালার ছড়ানো ড্রয়িং। সরু তুলির লাইনে এক অনবদ্য জলরং করেছিলেন গোপাল ঘোষ। অন্যতম সেরা পেন্টিং। দু’টি মানুষ-সহ যৎসামান্য তুলির টানে দ্রুততার রেশ রেখে যাওয়া এই ছবি বহু কাল মনে রয়ে যাবে।

জলরঙে কালি-তুলির অত্যন্ত দ্রুত টানে, কখনও বা পেন-ইঙ্কের ড্রয়িংয়ে মন মাতানো এক নিজস্ব টেকনিকে নিসর্গ এঁকেছেন রামকিঙ্কর। গ্রাম্য পথ, মহিলা বিক্রেতা, গাছের ও মেঘের দ্রুত রেখার টানটোন আলোর ভারসাম্য রক্ষায় অসামান্য। এ তাঁর একেবারেই নিজস্ব স্টাইল।

যামিনী রায় টেম্পারায় দুরন্ত দু’টি কাজ করেছেন পোস্ট ইমপ্রেশনিস্ট টেকনিকে। এক টুকরো রঙের পোঁচ, ব্রাশের ডগায় রং নিয়ে সাদা ও অন্য বর্ণের সমাবেশ এবং দুরন্ত ভারসাম্য-সহ দৃষ্টিনন্দন নিসর্গ। আর্লি বেঙ্গল আর্টের একটি তৈলচিত্রে নারীর শরীরী সৌন্দর্যে ইউরোপীয় চিত্রের লাবণ্য লক্ষিত হয়। পিছনে নিসর্গ ও হরিণের ছুটে যাওয়া নিয়ে খুব অন্য ধরনের কাজ নিঃসন্দেহে! গাছের আড়ালে কে? কোনও রাজা?

রাধাচরণ বাগচীর একটি অসাধারণ নিসর্গের ছবি প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ। একই ভাবে বিনোদবিহারী, নিখিল বিশ্বাস এবং যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের পাহাড়, নুড়িপাথর, নদী, ঝাউ নিয়ে নিসর্গ, কিংবা গণেশ পাইনের মোহময় নিসর্গকথা ইত্যাদি প্রদর্শনীকে আদ্যন্ত সমৃদ্ধ করেছে।

মণিপুরী নৃত্যসন্ধ্যা

প্রয়াত নৃত্যগুরু বিপিন সিংহের জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে শিশির মঞ্চে নৃত্যসন্ধ্যার আয়োজন করেছিল ভবানীপুর বৈকালিক। অনুষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রখ্যাত মণিপুরী নৃত্যশিল্পী পূর্বিতা মুখোপাধ্যায়।
দর্শকাসনের ভিতর দিয়ে নৃত্যশিল্পীরা সকলেই প্রথমে পুংবাদনের মধ্য দিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করে নৃত্যগুরুকে শ্রদ্ধা জানান। এর পরে নিবেদিত হয় ভক্তিমূলক পরিবেশনা ‘গৌরচন্দ্রিকা’। ভক্তরা রাসমণ্ডপে এটি উপস্থাপনা করেন। অংশগ্রহণে ছিলেন অরুন্ধতী শ্রেষ্ঠা। এর পর ছিল ‘মাধুরা নর্তন’। পূর্বিতা মণিপুরী নৃত্যের লীলায়িত ভঙ্গিমায় ও শ্রীকৃষ্ণের রূপবর্ণনায় উৎকৃষ্ট নৃত্য পরিবেশনা দর্শককে মোহিত করে। এর নৃত্য পরিকল্পনায় বিম্বাবতী দেবী, আবহসঙ্গীতে গুরু কলাবতী দেবী, পুংবাদনে টি ব্রজেনকুমার সিংহ এবং সঙ্গীতে এন রোমিলা দেবী— সকলেই ছিলেন উজ্জ্বল।
পরবর্তী ‘কৃষ্ণনর্তন’ পর্বে ব্রহ্মা তাল, তানচোপ, দুই তাল ও মেনকূপ তালে মণিপুরী নৃত্যের তাণ্ডব আঙ্গিকে শ্রেষ্ঠা তাঁর পদক্ষেপ ও ভঙ্গিমায় অনুষ্ঠানটি মনোগ্রাহী করে তোলেন। পরের নিবেদন ‘মানভঞ্জন’ পর্বে ‘গীতগোবিন্দ’ অবলম্বনে ‘বসন্তরাস’ যুগল নৃত্যটি দুই শিল্পী পূর্বিতা ও রিন্টু দক্ষতার সঙ্গে পরিবেশন করেন। ‘দশাবতার’-এর নৃত্য ও সঙ্গীত পরিকল্পনা গুরু কলাবতী দেবীর। এর পর ছিল ‘পুংচলোম’। মণিপুরী নৃত্যে এটি অত্যন্ত মনোগ্রাহী পরিবেশনা, যা দর্শকমন ভরিয়ে দেয়। অংশ নেন প্রেমকুমার সিংহ, টি ব্রজেনকুমার সিংহ ও কুলাচন্দ্র সিংহ।
অনুষ্ঠানের সর্বশেষ নিবেদন ছিল ‘রাসলীলা’। এই নৃত্যটি রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলায় আধারিত এবং মণিপুরী নৃত্যের লীলায়িত ভঙ্গিমার সঙ্গেই পদবিন্যাসের মাধুর্যমণ্ডিত এক উৎকৃষ্ট পরিবেশনা।
বৈকালিকের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জহর সরকার, গুরু কলাবতী দেবী, গুরু দর্শনা জাভেরি ও গৌতম দে সংবর্ধিত হন।
পলি গুহ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Exhibition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE