ফেলুদাকে কথাটা বলতেই সে খ্যাক করে উঠল। ‘পাকামো করিসনে। কার কী করে বিপদ ঘটবে না ঘটবে সেটা কি মানুষকে দেখলে বোঝা যায়? (ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি)
ব্যস এইটুকুই। একটা গোয়েন্দা সিরিজ তার নায়কের আবির্ভাব মুহূর্তটিতে আর কোনও বাড়তি সাজসজ্জা, বাগাড়ম্বরের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনি। সে আজি হতে অর্ধশতবর্ষ আগের কথা। ১৯৬৫ থেকে ২০১৬, ফেলুদার বয়স ৫০ ছাড়িয়ে গেল। এই ৫০ বছর ধরে ইস্কুলের ব্যাগে, বালিশের পাশে, ট্রেনের কামরায়, পড়ার টেবিলে ফেলুদাকে সঙ্গে করে বেড়ে ওঠা সব প্রজন্মই এই সময়টায় স্মৃতিমেদুরতায় ভুগবেন, এ আর বেশি কথা কী!
এমনিতে গত বেশ কয়েক বছর ধরে শীতকালে কমলালেবুর মতোই একখানি করে ফেলুদার ছবি দেখতে পাওয়া বাঙালির অভ্যাসে ঢুকে গিয়েছে। ছোট পর্দা, বড় পর্দা মিলিয়ে সন্দীপ রায়ের ফেলু-চিত্রণের ধাঁচাটা সকলেরই জানা। সুতরাং দর্শক যখন হল-য়ে যাচ্ছেন, কী দেখবেন সেটা আঁচ করে নিয়েই যাচ্ছেন। বইয়ে পড়া চরিত্রকে পর্দায় দেখতে পাওয়াটাই তাঁদের কাছে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার। নিখাদ সিনেমার চেয়েও ভাললাগা গল্পের আমেজ নেওয়াটাই সেখানে মুখ্য।
এই ধারাবাহিকতার মধ্যে ‘ডবল ফেলুদা’ আলাদা করে স্পেশাল। কারণ ছবিটা ফেলুদার ৫০ বছরকে মনে রেখে তৈরি। এবং সেই সুবাদে এ ছবির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হল তার টাইটল কার্ড।
ফেলুদার যাবতীয় বইয়ের প্রচ্ছদ আর শীর্ষ অলঙ্করণকে অ্যানিমেশন-গ্রাফিক্সের মতো করে কাজে লাগিয়ে সাজানো টাইটল পর্ব।
যেমন সুন্দর, তেমনি নস্টালজিক। মন ভাল-মন খারাপ একেবারে মাখামাখি হয়ে আসে সেখানে। আর এন্ড টাইটলে টুকরো টুকরো কথা, ফেলু কাহিনির চরিত্রাভিনেতাদের সঙ্গে। ফেলু-প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্সের সঙ্গে। এই পর্বে অনেক চেনামুখের সঙ্গে পাওয়া গেল ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর রুকু আর ‘সোনার কেল্লা’-র দ্বিতীয় মুকুলকেও। পরিণত বয়সে তাদের কেমন দেখতে হয়েছে, সেটা জানার সুযোগ এর আগে বড় একটা মেলেনি! ‘ডবল ফেলুদা’ই সেই সুযোগ করে দিল!
ফিল্ম সমালোচনা
ডবল ফেলুদা
সব্যসাচী, সাহেব, গৌরব
ফেলুদা ৫০-এর এই ট্রিবিউট যদি হয়ে থাকে ‘ডবল ফেলুদা’-র সবচেয়ে বড় গুপ্তধন, তার পাশাপাশি এ ছবির জন্য চ্যালেঞ্জও কিছু কম ছিল না।
ফেলুদার অভিনেতা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যত চর্চা, যত তর্ক-বিতর্ক গত কয়েক মাসে হয়েছে, তেমন আগে আর কখনও হয়নি। ‘বাদশাহী আংটি’-তে নতুন ফেলুদা হিসেবে আবীর চট্টোপাধ্যায় এসেছিলেন। তার আগে বয়স হয়ে যাচ্ছে বলে নিজেই সরে দাঁড়িয়েছিলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। ‘ডবল ফেলুদা’-য় তাঁর পুনরাবির্ভাব। সুতরাং, আবীরের পরে সব্যসাচীকে নতুন করে কেমন লাগল, সেটাই ছিল এ বারে প্রধান আগ্রহের বিষয়। সব্যসাচী হতাশ তো করেনইনি, অনেকখানি চমকেই দিয়েছেন। তার সবচেয়ে বড় কারণ হল, ঈষৎ ভুঁড়ি ছাড়া এই কয়েক বছরের ব্যবধানে তাঁর চোখমুখে বয়সের যতটা ছাপ ধরা পড়বে বলে ভাবা গিয়েছিল, ততটা পড়েনি। বা পড়লেও পর্দায় বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর মতো প্রকট হয়নি।
ছটফটে যুবক না হয়ে তিনি একটু ভারিক্কি ফেলুদা, কিন্তু ফেলুদা বটে। আবীরের বেলায় নতুন ফেলুকে দেখার উদ্দীপনা যদি কাজ করে থাকে, এ বারে চেনা ফেলুদাকে ফিরে দেখার আরামটাও কাজ করা উচিত।
এ বাদে ‘ডবল ফেলুদা’-য় বিশেষ ভাবে নজর কাড়ছেন আর পাঁচ জন। ‘সমাদ্দারের চাবি’তে মণিমোহনের ভূমিকায় ব্রাত্য বসু আর সুরজিতের বেশে শাশ্বতকে মানিয়েছে দিব্য। ‘গোলকধাম রহস্য’-য়ে, রণজিতের চরিত্রে গৌরব চক্রবর্তী আর ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের নীহার দত্ত চমৎকার। এবং নতুন সিধু জ্যাঠা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। হারীন্দ্রনাথের সিধুতে ছিল দাপট। হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় এনেছিলেন একটা বৈঠকী মেজাজ। পরাণের সিধু আরও ঘরোয়া, অনেকটা যেন তারিণী খুড়োর দোসর।
এই বাজারে আর একটা কথা না বললে নয়। ‘ডবল ফেলুদা’ কিন্তু না চাইতেই অর্থনীতির ইতিহাসে ঢুকে গেল। মেলোকর্ডের মধ্যে থেকে বেরোল তাড়া তাড়া হাজারের নোট! দর্শকদের অনেকেই হেসে উঠলেন।
বিরতির আলো জ্বলতেই এক জন প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলে ফেললেন, বুড়ো তো মরে বাঁচল! টাকাগুলো নিয়ে নাতি এ বার বেজায় ফ্যাসাদে পড়বে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy