Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

গণনাট্য গাঁয়ের বধূ এবং

যাদবপুরে একটা কলেজের অনুষ্ঠানে বহু নামী শিল্পী এসেছেন। হাজির সলিলের গানের দলও। জলসায় শেষ শিল্পী হিসেবে গান গাওয়ার কথা ছিল পঙ্কজ মল্লিকের। তাঁর আগেই গাইবে সলিলের দল। তত দিনে গড়চা রোডে গায়িকা গীতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে ‘গণনাট্য সংঘ’-র শাখা তৈরি হয়েছে। সেখানে তখন নক্ষত্র সমাবেশ। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার, অনল চট্টোপাধ্যায়…। ওঁদের যেখানেই ডাক পড়ছে, গাইতে হচ্ছে, ‘মানব না বন্ধনে’, ‘ও মোদের দেশবাসী’…।

মৃণাল সেন ও বাসু চট্টোপাধ্যায়ের মাঝে সলিল চৌধুরী

মৃণাল সেন ও বাসু চট্টোপাধ্যায়ের মাঝে সলিল চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

যাদবপুরে একটা কলেজের অনুষ্ঠানে বহু নামী শিল্পী এসেছেন। হাজির সলিলের গানের দলও। জলসায় শেষ শিল্পী হিসেবে গান গাওয়ার কথা ছিল পঙ্কজ মল্লিকের। তাঁর আগেই গাইবে সলিলের দল।
তত দিনে গড়চা রোডে গায়িকা গীতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে ‘গণনাট্য সংঘ’-র শাখা তৈরি হয়েছে। সেখানে তখন নক্ষত্র সমাবেশ। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার, অনল চট্টোপাধ্যায়…।
ওঁদের যেখানেই ডাক পড়ছে, গাইতে হচ্ছে, ‘মানব না বন্ধনে’, ‘ও মোদের দেশবাসী’…। লোকজন হইহই করে সে-গান শুনছেন। যাদবপুরে তেমনই এক অনুষ্ঠান।
পঙ্কজদা ডেকে পাঠালেন সলিলকে। অনুরোধ করলেন, ‘‘সলিল, আমি আগে মঞ্চে উঠব, তার পর তোমরা যদি গাও তো ভাল হয়। তোমাদের ওই সব হইচই গানের আগেই আমি গাইতে চাই।’’ সলিল এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন।
কিন্তু তখনও সলিল খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁর সেই অধরা গান, যা তাঁকে রাতারাতি পৌঁছে দেবে শ্রোতাদের বসার ঘরে। এই খোঁজই ওঁকে এক দিন পৌঁছে দিল হেমন্তদার বাড়ি।
১৯৪৯ সালের পুজোয় এইচএমভি-র হয়ে ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’ রেকর্ড করলেন হেমন্তদা। রেকর্ডিংয়ের দিনে সলিল স্টুডিয়োয় হাজির হতে পারেননি। তিনি তখন আন্ডারগ্রাউন্ড।
এর পর থেকে পুজো মানেই সলিল-হেমন্ত জুটির একের পর এক কালজয়ী গান।
সলিলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কবি সুকান্ত। দু’জনে হরিহর আত্মা। আমাদের প্রথম সন্তানের নামও রেখেছিলেন প্রয়াত বন্ধুর নামে। সুকান্তের কবিতায় সুর করার আগে কবিতাগুলো যে কত বার পড়তেন! বলতেন, ‘‘কবিতাকে যদি সুরে ছাপিয়ে যেতে না পারি, তা হলে আমার কৃতিত্বটা কোথায়?’’
কলকাতা থেকে মুম্বই যাওয়ার পথে একবার আমাদের প্লেন ঝড়ের মুখে পড়েছিল। টালমাটাল অবস্থা। ভয়ে বুক কাঁপছে ‘কী হবে, কী হবে’ ভেবে। পরে ঝড়ের সেই ভয়ঙ্কর অভি়জ্ঞতা থেকেই লিখেছিলেন, ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পুজোর গানে সলিলই সুর করতেন। হেমন্তদার অ্যালবামের জন্য ও-সবই ছিল ‘ডিজাইনার’ গান। এইচএমভি-র নির্দেশে সলিলকে তাঁর সেরাটা সরিয়ে রাখতে হত হেমন্তদা বা লতাদির জন্য।

হেমন্তদার সঙ্গে ওঁর রসায়ন ছিল দেখবার মতো। যত গান তিনি হেমন্তদার জন্য তৈরি করেছেন—শ্যামলদা, দ্বিজেনদা বা মানবেন্দ্রর জন্য তাঁর অর্ধেকও নয়। কিন্তু ১৯৬৩ সালে সলিলের কথায়-সুরে বাঙালি শ্রোতারা পেয়েছিলেন দুটি অনবদ্য গান। একটি ‘দূর নয় বেশি দূর ওই সাজানো সাজানো বকুলবনের ধারে’। গেয়েছিলেন শ্যামলদা। আর দ্বিজেনদা গেয়েছিলেন ‘পল্লবিনী গো সঞ্চারিণী, মন না দিয়ে আর পারিনি’। দুটি গানই ফিরত শ্রোতাদের মুখে মুখে।

আর লতা মঙ্গেশকর? উনি বলতেন, ‘আমার সরস্বতী’। লতাদি একদিন বাংলা গান গাইতে চাইলেন। ১৯৫৯-এ লতাদির জন্য দুটি গান বাঁধলেন—‘না যেও না, রজনী এখনও বাকি’ আর ‘বাঁশি কেন গায়’। রেকর্ডের দু’পিঠে দুটি গান।

বাংলা আধুনিক গানে ওটাই ছিল লতাদির প্রথম রেকর্ড। এর পরে ২৪টি গান লতাদি গেয়েছেন ওঁর সুরে। গানে অসম্ভব সব কঠিন সুর বসালেও সে-গান তুলে নিতেন লতাদি। তবে যতক্ষণ না গানটি পুরোপুরি তুলে নিতে পারছেন, বাংলা উচ্চারণ প্রায় নির্ভুল ভাবে না করতে পারছেন, ততক্ষণ তিনি মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়াতেন না।

লতাদির মতোই খুঁতখুঁতে ছিলেন মান্নাদাও। গান নিয়ে তিনি কোনও কম্প্রোমাইজ করতেন না। বলতেন, ‘‘দাঁড়ান সলিলবাবু, আর একটু বাকি আছে। যাবেন না।’’ গান শেষ হলে সলিলকে নিয়ে মান্নাদা ঢুকে পড়তেন কোনও একটি ঘরে। সলিলের ‘জোকস’-এর ভাঁড়ার ছিল অফুরন্ত। শুনতেন সে সব। আর ফেটে পড়তেন হাসিতে।

‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’র মতো গান সলিল তুলে রেখেছিলেন সন্ধ্যাদির জন্যই। সুরের ওঠাপড়ায় এমন গান বাংলায় খুব কমই হয়েছে। সন্ধ্যাদি মনে করতেন, তাঁর বাড়িতে সলিলকে ডেকে যদি কোনও ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া যায়, তবেই সলিল পারবে সেরা কোনও সুর সৃষ্টি করতে। আমি বারবার বলতাম, ‘‘সন্ধ্যাদি, এমন করার কোনও কারণ নেই। সুর ওর মনে এসে গেলে দরজা খোলা বা বন্ধে কিছু এসে-যাবে না।’’ হয়েছিলও তাই।

‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’ সুপারডুপার হিট হয়ে যাওয়ার পরে দেখা হতেই বললাম, ‘‘কী, বলেছিলাম না, দরজা খোলা রাখলেও সলিল পারে।’’ সন্ধ্যাদি হেসে কুটিপাটি।

খুব হিট করেছিল বাংলায় আমার গাওয়া ‘হলুদ গাঁদার ফুল দে এনে দে’। মনে আছে, সে বার কলকাতায় পা দিয়েই সরাসরি চলে গিয়েছিলাম রেডিয়ো স্টেশনে। তখনও জানি না কার গান, কী গান। সলিল আমাকে চমকে দেবেন বলে আগে থেকে আমায় কিছু জানাননি।

রেডিয়োর ‘রম্যগীতি’ অনুষ্ঠানে গানটি গেয়েছিলাম। অনেক গান গেয়েছি রেডিয়োর জন্য। পরে সব রেকর্ড হয়। ‘সুরের এই ঝরঝর ঝরনা’—থ্রি পার্ট হারমনির ব্যবহারে দুরন্ত এই গানটিকে উনি এমন এক সুরে বাঁধলেন, যা আধুনিক বাংলা গানে এক কথায় অভূতপূর্ব। আর একটি কঠিন গান ছিল ‘কিনু গোয়ালার গলি’ ছবিতে। গোরখ কল্যাণ রাগে সুর আর তান। ‘দখিনা বাতাসে মন কেন কাঁদে’।

আজও জলসায় গেলে আমাকে সে-গান গাইতে হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE