Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ইতিহাসের গন্ধ মেখে

মুর্শিদাবাদ গল্প বলে ঐতিহ্যের, আভিজাত্যের, ব্যবসার আর ফেলে আসা দিনের। রাজবাড়ি, মন্দির, মসজিদ, গির্জা, কবরখানা জুড়ে উঠে আসে সে সব গল্পগাথাইহণ্টন শেষে পৌঁছলাম কাটরা মসজিদে। সূর্য তখন ঢলে পড়ছে। আর তার লালচে ছোঁয়ায় মোহময়ী উঠেছে মসজিদ। মুর্শিদকুলি খাঁ চেয়েছিলেন, তাঁর সমাধি মসজিদ সংলগ্ন অঞ্চলে তৈরি করতে।

কাটরা মসজিদের গায়ে তখন অস্তরাগের আলো

কাটরা মসজিদের গায়ে তখন অস্তরাগের আলো

রূম্পা দাস
মুর্শিদাবাদ শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

সে কবেকার কথা। ঢাকা থেকে রাজপাট উঠিয়ে ভাগীরথীর তীরে মুকসুদাবাদে এসেছিলেন আওরঙ্গজ়েবের দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ। সঙ্গে জগৎ শেঠ-সহ বিশ্বস্ত কয়েক জন। জাঁকিয়ে বসলেন মুর্শিদকুলি। তাঁরই নাম অনুসারে মুকসুদাবাদ বদলে গেল মুর্শিদাবাদে। আর বাকিটা ইতিহাস। মুর্শিদাবাদেরই বাঁকে বাঁকে, অলি-গলি-পাকস্থলী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুরনো গন্ধ। কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের হার না মানা গল্প, কোথাও মাটিতে মিশে ঔপনিবেশিক কলোনির স্থাপত্য। আর সমস্ত কিছুর সাক্ষ্য নিয়ে আজও বয়ে চলেছে ভাগীরথী। তার জলে জমাট বেঁধেছে কত না অসহায় প্রাণের রক্ত, কালের স্মৃতিতে মিলিয়ে যাওয়া ইতিহাস! সম্প্রতি মুর্শিদাবাদ হেরিটেজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির উদ্যোগে মুর্শিদাবাদ হেরিটেজ ফেস্টিভ্যালে আবারও খুলল স্মৃতির অলিন্দ। হাতড়ে টেনে আনল সেই সব ইতিহাস। মুর্শিদাবাদের প্রাণকেন্দ্র হাজারদুয়ারি তো প্রায় সকলেরই জানা। এ সফরে রইল কিছু স্বল্পচেনা জায়গার গল্প।

মন্দির, মসজিদ, রাজবাড়ি...

বহরমপুর স্টেশন থেকে টোটো করে পৌঁছে যাওয়া যাবে কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়িতে। প্রায় ৩০-৩৫ বিঘা জোড়া এই রাজবাড়ির সিংহদুয়ার দিয়ে ঢুকলে গা শিউরে ওঠে বইকি। রাজবাড়ির দালান, চাতাল, মন্দির, মালখানা, পঙ্‌ক্তি ভোজনের উঠোন, দুর্গামণ্ডপের দেওয়াল যদিও আর নোনাধরা নেই। তাতে লেগেছে সংস্কারের ছোঁয়া। তবে কালচে আসবাব, মার্বেলের দালানকোঠা, বাহির মহলের বসার ঘরে ভারী আরামকেদারা, পালকি, গোবিন্দের মূর্তি দেখলে ইতিহাস স্পষ্ট হয়। রাজবাড়ির বর্তমান বংশধর পল্লব রায়ের মুখে শোনা গেল চট্টোপাধ্যায় পরিবারের গল্প। অযোধ্যারাম রায় ভৈরব নদীর পিরোজপুর গ্রাম ছেড়ে কাশিমবাজারে বাস শুরু করে আঠেরো শতকের গোড়ায়। ব্যবসায় সফল এই পরিবার সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মুঘল শাসনকর্তার কাছ থেকে ‘রায়’ উপাধি পেয়েছিল। এর পর থেকে পরিবারের সদস্যরা নামের শেষে ‘রায়’ ব্যবহার করাই পছন্দ করেন। নানা সামাজিক কাজকর্মে এই রায় পরিবারের অবদান ছিল বিপুল। কিন্তু তাদের অর্থ ছিল স্বোপার্জিত। ১৯৫০ সাল নাগাদ জমিদারি প্রথার অবসান ঘটলে রায় পরিবার কলকাতায় এসে ব্যবসা ও বসবাস শুরু করে। তবে সংস্কারের পরে এখনও প্রত্যেক বছর ধুমধাম করে দুর্গা, সরস্বতী, গোবিন্দের নিত্যসেবা হয়। এই রাজবাড়ি কাশিমবাজারের ছোট রাজবাড়ি নামেই পরিচিত। তা হলে নিশ্চয়ই রয়েছে বড় রাজবাড়িও। জানা গেল সেই গল্পও।

বহু কাল ধরেই ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজ বণিকদের নজর ছিল কাশিমবাজারের উপরে। একে সেটি বন্দর, তার উপরে সেই অঞ্চলের রেশম শিল্পের খ্যাতি দেশ জুড়ে। ফলে কাশিমবাজার ছিল ব্যবসার ঘাঁটি। শোনা যায়, কাশিমবাজারের কান্ত বাবু ওরফে কৃষ্ণচন্দ্র নন্দী অসহায় ওয়ারেন হেস্টিংসকে এক রাতে আশ্রয় ও খাবার দিয়ে সাহায্য করেন। পরদিন হেস্টিংস পালিয়ে গেলেও পরে ফিরে আসেন সাহায্যদাতার খোঁজে। কান্তর খোঁজ মেলে। সে হয়ে ওঠে হেস্টিংসের ডান হাত। সেই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট কান্তর কাশিমবাজারের রাজা হওয়ার গল্প।

কাশিমবাজারের ছোট রাজবাড়ি যাওয়ার পথেই চোখ আটকে গেল সাদা মর্মর স্থাপত্যে, তার থামজোড়া কারুকাজে। এগোতেই জানা গেল সেটি আসলে ডাচ সেমেটারি। আশপাশে ছড়িয়ে বেশ কিছু লালচে কবর। চলছে সংস্কার। কাছেই কল্কাপুরে ছিল ওলন্দাজদের ফ্যাক্টরি। হেস্টিংসের বন্ধু জর্জ লুই ভার্নেতের সেই ফ্যাক্টরিতে এক সময়ে কাজ করতেন প্রায় ৭০০-৮০০ জন। কালের নিয়মে ফ্যাক্টরি হারিয়ে গেলেও রয়ে গিয়েছে ওলন্দাজদের কবরখানা। যেখানে মাটির নীচে আজও শুয়ে ৪৩জন ওলন্দাজ! সেই পথেই পড়ে করুণাময়ী কালীমন্দির। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পুণ্যার্থীরা। আছে পাতালেশ্বর শিবমন্দির, আর্মেনিয়ান চার্চ। মন্দির, কবরখানা, রাজবাড়ি... একই পথে সারি সারি দাঁড়িয়ে!

হণ্টন শেষে পৌঁছলাম কাটরা মসজিদে। সূর্য তখন ঢলে পড়ছে। আর তার লালচে ছোঁয়ায় মোহময়ী উঠেছে মসজিদ। মুর্শিদকুলি খাঁ চেয়েছিলেন, তাঁর সমাধি মসজিদ সংলগ্ন অঞ্চলে তৈরি করতে। বাজার বা কাটরার কাছে সেই মসজিদ। তা থেকেই কাটরা মসজিদ। ঢোকার মুখে চোদ্দোটি সিঁড়ি। তার তলায় আছে নবাবের সমাধি। বা হারিয়ে গিয়েছে ভূমিকম্পের অতলে। যেমন হারিয়ে গিয়েছে মসজিদের গম্বুজ। কিন্তু কোন প্রযুক্তিতে আর্চের উপরে দাঁড়িয়ে গোটা স্থাপত্য, ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়!

দুই পাড়ে তার কীর্তি অমলিন

ভাগীরথী নদীর দু’পাড়ে দুই শহর— জিয়াগঞ্জ ও আজিমগঞ্জ। এক সময়ে তা ছিল ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র। এখন সেই রাজকীয় ব্যবসা আর নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে নানা কোঠি, মন্দির... জিয়াগঞ্জ সদরঘাট থেকে নৌকায় আজিমগঞ্জে পৌঁছনো যায়। নদী পার করার সময়ে দু’পাড়ের ঘাট জুড়ে গাছের তলায় নিত্যকর্মে মগ্ন বউ-বাচ্চাদের দেখে মনে হয়, এ কোন গ্রাম! যার গায়ে শুধুই মাটির গন্ধ, যার ছায়ার মায়ায় জুড়িয়ে যায় প্রাণ। শহুরে ব্যস্ততা ছেড়ে থেকে যেতে ইচ্ছে করে এখানেই। মগ্নতার মাঝেই ঘোর কাটে নৌকা থেমে যাওয়ায়। মেঠো ঘাট পেরিয়ে এগোতেই নোনাধরা মন্দির। তার দেওয়াল জুড়ে নেমে এসেছে গাছের ঝুরি। চাতালে ছড়িয়ে কচি সবুজ পাতা। ‘‘কালই শিলাবৃষ্টি হয়েছে। আজ একেবারে জঙ্গল হয়ে গেল,’’ জানালেন মন্দিরের সেবায়েত। ভবানীশ্বর মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নাটোরের রানি ভবানীর নাম। জীবনের শেষ কাল তিনি এখানেই কাটিয়েছিলেন, তৈরি করেছিলেন বেশ ক’টি মন্দির। ভবানীশ্বর মন্দিরের সুবিশাল শিবলিঙ্গ অষ্টধাতুর ও আটকোনা। মন্দিরে ঢোকার মুখে দেওয়ালে মকরপৃষ্ঠে আসীন বিষ্ণুমূর্তি। চুন-বালি দিয়ে তৈরি পাখি-ফুল-লতা-পাতার নকশা আজও রয়ে গিয়েছে একই ভাবে। ভবানীশ্বর মন্দির থেকে বেরিয়ে এগোতেই মিলল চার বাংলা মন্দির। শিবপুজোর জন্য নির্মিত এই

মন্দির চার ভাগে বিভক্ত। প্রত্যেক মন্দিরের মধ্যে তিনটি করে শিবলিঙ্গ।

একই সঙ্গে বারোটি শিবলিঙ্গে পুজো হয়। মন্দিরের দেওয়ালজোড়া টেরাকোটার সূক্ষ্ম কাজে ধরা

আছে মহাভারত ও রামায়ণের

নানা কাহিনি।

মাটির কথা, তাঁতের কাজ...

কাঠগোলা প্যালেসের সামনে ছোট পুকুর। তার প্রত্যেক সিঁড়িতে সাজানো অজস্র প্রদীপ। তার আলো জলে পড়লে হার মানে সোনার জৌলুসও। তাকে ঘিরেই বসেছিল মেলা। সাবাই ঘাস, মাদুর, বেত, গামছার তৈরি হরেক জিনিস। আশপাশের গ্রাম থেকে মহিলারা এসে নিজের হাতে সামগ্রী বানিয়েই সাজিয়েছেন পশরা। আর মঞ্চ দখল করেছেন ওড়িশি, ছৌ ও রায়বেঁশে শিল্পীর দল। প্যালেসের দালানে পড়েছে সন্ধেজোড়া আতশবাজির আলো। তার মাঝেই প্যালেসের চিড়িয়াখানায় হরেক বিদেশি পাখির কলকাকলি। এ সন্ধের মাদকতা ভুলিয়ে দেয় ফেলে আসা যন্ত্রণা, হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। আর ছিল তাঁত। জিয়াগঞ্জের সদরঘাট থেকে এগোতেই পড়ে তাঁতিপাড়া। ছোট ছোট ঘরে মাটি কেটে বসানো রয়েছে পিট লুম। সেই তাঁতেই হাতে সিল্ক, গরদ বুনছেন মুর্শিদাবাদের শিল্পীরা। নরম সুতোয় বোনা নকশিকাঁথা জুড়ে তৈরি হচ্ছে কতশত গল্প। আর তাতে মিশে যাচ্ছে শিল্পীর স্নেহ, শ্রম।

মুর্শিদাবাদ এখানেই শেষ নয়। আর উদ্‌যাপনও দু’দিনে শেষ হওয়ার নয়। যেখানে সারা জেলার পথে পথে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস, চলতে গেলে বারবার থেমে যেতে হয় চোখজুড়ানো হাজারদুয়ারি, ইমামবড়া, ডিস্ট্রিক্ট মিউজ়িয়াম, ওয়াসিফ মনজ়িল, জগৎ শেঠের বাড়ি বা জৈন মন্দিরে— সেখানে তো উদ্‌যাপন সারা বছর। আসলে এখানে উৎসব চলে বারো মাসই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

History Murshidabad Historical place Baharampur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE