Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Fertilizer

সার তৈরির সারাংশ

আনাজপাতির খোসা থেকে গাছের পাতা, গোবর, কচুরিপানা দিয়েও কম্পোস্ট করা যায়।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

নবনীতা দত্ত
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২০ ০২:২৪
Share: Save:

জঞ্জাল ভেবে যা আমরা ফেলে দিই, তাতেই জন্মােত পারে আপনার রোজকার খাওয়ার আনাজপাতি। তার জন্য প্রয়োজন একটু সময় ও যত্ন। প্রত্যেক দিন আনাজপাতির খোসা, ডিমের খোলা ডাস্টবিনে ফেলে না দিয়ে তা জমাতে শুরু করুন একটি পাত্রে। তা দিয়েই শুরু করতে পারেন কম্পোস্টিং। গোড়ায় বলে নেওয়া দরকার, কম্পোস্টিংয়ের জন্য মূল উপাদান হল যে কোনও রকমের জৈব বর্জ্য। আনাজপাতির খোসা থেকে গাছের পাতা, গোবর, কচুরিপানা দিয়েও কম্পোস্ট করা যায়।

কম্পোস্টিং কী?

একে জৈব পদ্ধতি বলা যায়। এর মাধ্যমে আনাজপাতির খোসা, গাছের পাতা, জীবজন্তুর বিষ্ঠা ইত্যাদি জৈব বর্জ্য ডিকম্পোজ় করা হয়। ‘হিউমাস’-এর মতো একটি উপাদান তৈরি হয়, যা মাটিতে পুষ্টি জোগায়। গাছের জন্য ভাল সারও বলা যায়। একই মাটিতে একাধিক বার চাষের পরে সেই মাটির পুষ্টি অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। তখন এই কম্পোস্ট কিন্তু মাটিতে পুষ্টির জোগান দিতে সক্ষম। খোয়াবগাঁয়ের রূপকার শিল্পী মৃণাল মণ্ডল বললেন, ‘‘এই গ্রামের মানুষদের দেখেছি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কম্পোস্ট করতে। এঁরা মাটির মধ্যে একটা বড় চৌবাচ্চা কেটে ফেলে। তার মধ্যে আনাজপাতি ও ডিমের খোসা, পাতা-লতা এনে জড়ো করে। আর দেয় গোবর। তার পর কেঁচো ছেড়ে দিয়ে উপরে মাটি চাপা দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখে। ক’মাস বাদে ভাল সার তৈরি হয়ে যায়। এই জৈব সারের দারুণ গুণ। এতে রাসায়নিকও মেশানো হয় না, ফলে ক্ষতি নেই।’’ অনেক ভাবে কমপোস্ট করা যায়— অ্যারোবিক, অ্যানঅ্যারোবিক ও ভার্মি-কমপোস্ট।

শুরু করার আগে

আনাজপাতির খোসা থেকে শুরু করে চায়ের পাতা, কাঠের গুঁড়ো ইত্যাদি জমাতে থাকুন। নিজের বাড়ির বাগানের ঝরে যাওয়া পাতাও ব্যবহার করা যায়। দুধ, চিনি দেওয়া চায়ের পাতা জমানো যাবে না। রোগাক্রান্ত গাছের পাতা কখনও ব্যবহার করবেন না। বাড়িতে বাগান বা আলাদা কম্পোস্টিংয়ের জায়গা না থাকলে ঢাকা দেওয়া পাত্র ব্যবহার করুন।

অ্যারোবিক কম্পোস্টিং

এই পদ্ধতিতে বাতাসের অক্সিজেন ও মাটির মাইক্রোবস উচ্চ তাপমাত্রায় জৈব পদার্থ ভেঙে ডিকম্পোজ় করতে সাহায্য করে। তাই এই ধরনের কম্পোস্টে বায়ুসঞ্চালনের ব্যবস্থা রাখা জরুরি। টাম্বল স্টাইলের কম্পোস্টার ব্যবহার করতে পারেন। এতে প্রত্যেক দিন ঘুরিয়েফিরিয়ে কম্পোস্টারের ভিতরে বায়ু প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আর্দ্রতা বজায় রাখতে জলও দিতে হবে বইকি। মাঝেমাঝে ঢাকনা খুলে উল্টেপাল্টে দিন। এতে বেশি দুর্গন্ধ হবে না। এই ধরনের কম্পোস্টিংয়ে গাছের পাতাও ব্যবহার করা হয়। তবে অ্যারোবিক কম্পোস্টিংও অনেক ভাবে করা যায়। যেমন, উইন্ডরো, স্ট্যাটিক পাইল, ইন-ভেসেল কম্পোস্টিং।

অ্যানঅ্যারোবিক কম্পোস্টিং

এই পদ্ধতিতে অক্সিজেনের সাহায্য ছাড়াই বর্জ্যের পচন সম্ভব হয়। এ ক্ষেত্রে বর্জ্যের পচন ত্বরান্বিত করে বিভিন্ন মাইক্রোঅর্গ্যানিজ়ম বা অ্যানঅ্যারোবিক ব্যাকটিরিয়া। তবে এতে সময় লাগে অনেক। প্রায় এক বছর তো লাগেই। এতে পরিশ্রম কম। একটি পাত্রে বর্জ্য জমা করে ঢেকে এক বছর কোথাও রেখে দিন। এক বছর পরে যখন তা খুলবেন, দেখবেন কম্পোস্ট তৈরি হয়ে গিয়েছে। এই পদ্ধতিতে যেহেতু কম্পোস্টারে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকে না, তাই ভীষণ গন্ধ হয়। এমনকি মিথেন গ্যাসও তৈরি হতে পারে।

ভার্মি-কম্পোস্টিং

এই ধরনের কম্পোস্টিংয়ে গুণগত মান ভাল ও সবচেয়ে কার্যকর। এই কম্পোস্টিংয়ে মূলত ব্যবহার হয় কেঁচোর। আইআইটি খড়গপুরের কৃষি ও খাদ্য বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক বিজয়চন্দ্র ঘোষ বললেন, ‘‘এই কম্পোস্টে সাধারণত এসিনিয়া ফোটিডা প্রজাতির কেঁচো ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও অনেক প্রজাতির কেঁচো ব্যবহার হয়। এই ধরনের কেঁচো জৈব বর্জ্য খায়। তার পরে এরা যে বিষ্ঠা ত্যাগ করে তা হরমোনস, এনজ়াইমস ও অন্যান্য পুষ্টিগুণে ভরপুর। ফলে তা যদি মাটিতে দেওয়া হয়, মাটির উর্বরতা অনেক বেড়ে যায়। এই বর্জ্যের সঙ্গে একটু গোবর মিশিয়ে দিলে আরও ভাল হয়।’’

বাড়িতে কী ভাবে করবেন

অ্যাপার্টমেন্টে বা বাড়িতেও ভার্মি-কমপোস্ট করতে পারেন। কী ভাবে করবেন, জানালেন অধ্যাপক ঘোষ—

• রোজ পরিবারপিছু প্রায় ১ কিলোগ্রাম জৈব বর্জ্য পাওয়া যায়। তা একটা জায়গায় জমাতে হবে প্রায় পনেরো দিন। এতেই খানিকটা পচে-গলে যাবে বর্জ্য।

• এ বার কনটেনার বেড তৈরি করতে হবে। এই বেড হয় ১৫ ফুট লম্বা, ৪ ফুট চওড়া ও ১ ফুট গভীর। এই বেডের মধ্যে জমিয়ে রাখা বর্জ্য ট্রান্সফার করতে হবে।

• তার পর এর মধ্যে ১০ কিলোগ্রাম কেঁচো ছেড়ে দিতে হবে। কেঁচো মাটির উপরে ছাড়লেই মাটির ভিতরে ঢুকে যাবে। এই কেঁচোই বর্জ্য খেয়ে বিষ্ঠা ত্যাগ করবে। আর মনে রাখতে হবে, ওরা কিন্তু নিজের ওজনের দু’তিন গুণ বর্জ্য রোজ খেয়ে ফেলতে পারে। আর এক মাসেই ওরা মাল্টিপ্লাই করে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে এই কম্পোস্টের প্রক্রিয়া দ্রুত হবে।

• কেঁচোকে বাঁচিয়ে রাখতে ওই পাত্রে বায়ু চলাচল ভাল হতে হবে। তবে রোদের আড়ালে রাখতে উপরে ঢাকাও দিতে হবে। মাস দেড়েকের মধ্যে কম্পোস্ট তৈরি হয়ে গেলে সেপারেটর যন্ত্রের মাধ্যমে কেঁচো আলাদা করে নিতে হবে। এ বার সেই সার ব্যবহার করতে পারেন মাটিতে।

• ভার্মি-কম্পোস্ট বেডে জল দিতে হয় মাঝেমাঝে। সেই অতিরিক্ত জল সংগ্রহ করতে হবে। একে বলে ভার্মি বেডওয়াশ। এটিকে ১:৫ অনুপাতে জলের সঙ্গে মিশিয়ে গাছে দিলে ওষুধের মতো কাজ করে।

• ঠান্ডা জলে কেঁচো ধুয়ে ভার্মি-ওয়াশ পাওয়া যায়। এই জলও গাছের জন্য খুব ভাল।

এই পদ্ধতিতে জৈব সার পাবেন যা গাছের জন্য খুব ভাল। নিজে নিজে কম্পোস্ট শুরু করা একটু আয়াসসাধ্য মনে হলেও তার ফল সুদূরপ্রসারী। একে তো বর্জ্য রিসাইকল করা যাবে, উপরন্তু এই পদ্ধতিতে কোনও রাসায়নিক ব্যবহার না করায় ভাল ফসল পাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Fertilizer Home-Made Composting
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE