ঢাকঢাক গুড়গুড় সর্বত্রই। সব সময়ই ফিসফিস। ভাবখানা এমন যেন কোনও নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যিনি ওই অধ্যায়টার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তিনি তো বটেই, যাঁর জীবনে ওই অধ্যায় আসেনি, তিনিও চুপ! সময় যতই বদলাক, মেনোপজ নিয়ে এমন অকারণ গোপনীয়তার ছবিটা এখনও খুব বেশি বদলায়নি।
আর তাই অ্যাঞ্জেলিনা জোলি যখন স্তন ক্যানসার থেকে বাঁচতে তাঁর দু’টি স্তন ও তার কয়েক বছর পরে ডিম্বাশয়ের ক্যানসার ঠেকাতে ডিম্বাশয় বাদ দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন, তখন সাড়া পড়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্বে! কিন্তু সেই অ্যাঞ্জেলিনাই যখন ডিম্বাশয় বাদ দেওয়ার পর ঘোষণা করলেন, তাঁর মেনোপজ হয়েছে, তখনই শুরু হল ফিসফিস। যেন এটা এমন একটা বিষয়, যা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করাই চলে না!
কেন চলে না? কোনও জবাব নেই কারও কাছেই। শারীরবৃত্তীয় কারণে ঠিক যে ভাবে মেয়েদের জীবনে ঋতুচক্র শুরু হয়, তেমনই তা একদিন বন্ধও হয়। তা হলে সেটা স্বীকার করতে বাধা কোথায়? মনোবিদেরা বলেন, মহিলাদের একটা বড় অংশই এর সঙ্গে তাঁদের নারীত্বকে গুলিয়ে ফেলেন। তাঁরা মনে করেন, মেনোপজ হওয়ার অর্থ নারী হিসেবে তাঁর অস্তিত্বটাই বিপন্ন হয়ে পড়া। কারণ, মেনোপজের পর তাঁদের সন্তানধারণ ক্ষমতা চলে যায়। হাস্যকর মনে হলেও বহু শিক্ষিত মহিলার ধারণাটাও এমনই। বাস্তব হল, বহু ক্ষেত্রেই মেয়েরা সত্যিটাকে অস্বীকার করতে চান। বহু মেয়েই মেনোপজের কথা উঠলে বলেন, ওটা তো বুড়ো বয়সের ব্যাপার। আমার এখনও ও সব ভাবার সময় আসেনি। অথচ মেডিক্যাল সায়েন্স বলছে, তিরিশ পেরোনোর পরেই এ নিয়ে সচেতন থাকা জরুরি। ৪০-এর পর তো বেশি করে জানা-বোঝা দরকার।
মনোবিদদের মতে, পুরুষদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টা বোঝার মতো সূক্ষ্মতা তৈরির চেষ্টাই হয়নি। তাই মেনোপজের পর একজন মহিলা মানসিক ও শারীরিক ভাবে ঠিক কী অবস্থায় থাকেন, তা অধিকাংশ পুরুষই কল্পনা করতে পারেন না। ফলে বাড়িতে হোক বা কর্মক্ষেত্রে, মেয়েদের সমস্যাটা বুঝে বিষয়টার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার মতো পুরুষ এখনও কমই আছেন।
তা হলে বিষয়টা দাঁড়াল এই যে, মেয়েদের নিজেদের ভূমিকাটাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ‘জীবনের এই অধ্যায় যখন আসবে, তখনই সেটা বুঝে নেওয়া যাবে’ এই ধারণা নিয়ে বসে না থেকে আগাম প্রস্তুতি জরুরি। ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, মেনোপজের সময়ে শুধু হট ফ্লাশ (কানের পাশ থেকে গরম ভাপ বেরোনো) বা অস্বাভাবিক ঘামই নয়, ওজনও বেড়ে যায়। ক্লান্তি আসে। হাড় ভঙ্গুর হওয়ার ভয় থাকে। উদ্বেগ বাড়ে। ছোটখাটো বিষয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়। এ জন্য শরীর ও মন— দুইয়েরই পুষ্টি দরকার।
শৈশব থেকেই ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়া মেয়েদের জন্য জরুরি। যাঁরা ইতিমধ্যেই অনেকটা সময় এ ব্যাপারে উদাসীন থেকেছেন, তাঁরা এ বার মন দিন। দুধ, ডিম, আনাজপাতি বেশি খেতে হবে। তবে মন-মেজাজ খারাপ বলে অনেক সময়ে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। সেটা এড়িয়ে চলতে হবে। ডাক্তারদের পরামর্শ হল, নিয়মিত ব্যায়াম। এই সময়ে ওজন বাড়ার প্রবণতা থাকে। তাই শারীরচর্চাটা জরুরি। জিমে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল। না হলে বাড়িতেই যোগাসন, নিয়মিত হাঁটা। ইদানীং ডাক্তাররা অনেকেই জিমের পরামর্শই বেশি দিচ্ছেন। কারণ নিয়মিত জিমে গেলে শুধু যে শরীর সু্স্থ থাকবে তাই নয়, নিজের শরীর যত ঝরঝরে হবে আত্মবিশ্বাসও ততটাই বাড়বে। তবে কোন ধরনের শারীরচর্চা কার জন্য প্রয়োজন, সেটা দক্ষ ট্রেনারের কাছ থেকে জেনে নেওয়াই ভাল।
কিছু দিন আগে জাতীয় স্তরের এক অভিনেত্রী তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘মেনোপজ নিয়ে অনেক কিছু শুনেছি! ভেবেছিলাম, যাঁদের মনের জোর থাকে না, তাঁদেরই ওই নিয়ে সমস্যা হয়। আমার ক্ষেত্রে হবে না। কিন্তু যখন ঘটনাটা ঘটল, বুঝলাম ধারণাটা কত বড় ভুল ছিল। আরও আগে আমার এ নিয়ে মানসিক প্রস্তুতি জরুরি ছিল।’’
কেমন প্রস্তুতি? ডাক্তারদের পরামর্শ, পরিবারে কার কখন হয়েছে সেটা জেনে নেওয়া দরকার। মা, মাসি, দিদিদের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া ভাল। তাঁরা কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন সেটা জেনে নিতে পারেন। যে মহিলারা সিগারেট খান, তাঁদের ৪০ পেরোলে সিগারেট ছেড়ে দেওয়া দরকার। কারণ, তামাক ডিম্বাণুর কাছে বিষের সমান। অতিরিক্ত ধূমপানের জেরে ডিম্বাশয় আরও দ্রুত কাজ করা বন্ধ করে দেয়। মেনোপজের পরে হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। হার্ট ভাল রাখাও জরুরি।
মনোবিদদের মতে, এই সময়টাই যত বেশি সম্ভব নিজেকে কাজের সঙ্গে যুক্ত রাখতে হবে। অবসর সময় বেশি হলেই হাজার রকমের চিন্তা মাথায় আসে। মনঃসংযোগের সমস্যা, তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া, অবসাদ ছেঁকে ধরতে পারে। এই জন্যই বাড়ি ও বাড়ির বাইরে নানা কাজে নিজেকে যুক্ত রাখুন। জীবনের অন্য সময়ের উদ্বেগ আর এই সময়ের উদ্বেগ— দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। তাই বাড়িতে ‘সাপোর্ট সিস্টেম’ থাকা জরুরি। মেনোপজ সম্পর্কে শুধু নিজে বুঝলেই হবে না, যাঁদের সঙ্গে আপনি থাকেন, তাঁদেরও এ ব্যাপারে কিছুটা সংবেদনশীল করার দায়িত্ব আপনারই।
মনে রাখবেন, মেনোপজ মানে একটা অধ্যায়ের যেমন শেষ, তেমনই অন্য একটা অধ্যায়ের শুরুও বটে। কিছু দিন আগে এক জনপ্রিয় লেখিকা তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মেনোপজ বড় সুখের সময়। কেন? কারণ, প্রতি মাসের ‘ঝুটঝামেলা’ থেকে মুক্তি। তা ছাড়া এর পরে শারীরিক সম্পর্ক নিয়েও বেশি সাবধান থাকার ভয় নেই। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। কিন্তু এমন মানসিকতা এখনও পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন উদাহরণ হয়েই থেকে যাচ্ছে। মেনোপজ নিয়ে ভাবার ক্ষেত্রে বহু মহিলারই অস্বস্তি রয়েছে।
কাটিয়ে ফেলতে হবে এই অস্বস্তিটাকেই। কেননা জীবনের অনিবার্য এই পরিবর্তনের সময়টায় কেউ আপনার সব মনখারাপ, নানা শারীরিক অস্বস্তি বুঝে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেবে, এতটা আশা না করাই ভাল। নিজের পাশে থাকতে হবে নিজেকেই। নিজের হাতটা নিজেকেই শক্ত করে ধরতে হবে!
মডেল: তৃণা
মেকআপ: সন্দীপ নিয়োগী
ছবি: অমিত দাস
লোকেশন: দ্য কনক্লেভ
ক্লাব ভর্দে ভিস্তা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy