Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বেঁচে থাক ‘বইপোকা’রা

সারা দিন মোবাইল, আইপ্যাডে চোখ ডুবিয়ে বসে থাকা বাচ্চাদের হাতে বই ধরানো সহজ কথা নয়। এর জন্য উঠেপড়ে লাগতে হবে বাবা-মা’কেই। তবেই তো তৈরি হবে পড়ার অভ্যেস সারা দিন মোবাইল, আইপ্যাডে চোখ ডুবিয়ে বসে থাকা বাচ্চাদের হাতে বই ধরানো সহজ কথা নয়। এর জন্য উঠেপড়ে লাগতে হবে বাবা-মা’কেই। তবেই তো তৈরি হবে পড়ার অভ্যেস

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৮ ০০:২৫
Share: Save:

‘গল্পের বই পড়া’ এই শব্দ ক’টার আয়ু বোধ হয় আর বেশি দিন নেই। বিশেষ করে এখন যারা দশের নীচে, তারা হয় পড়ার বইয়ের তলায় চাপা পড়ে থাকে, নয়তো টিভি, মোবাইল, আইপ্যাড, ল্যাপটপে চোখ আটকে রাখে। সেখানে রঙিন গল্প-ছড়ারা নড়ে চড়ে, কথা বলে। বইয়ের পাতার মতো এক জায়গায় আটকে থাকে না। তাই অডিয়ো-ভিস্যুয়ালের নেশা যেমন হু হু করে বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে কমছে বই পড়ার আগ্রহ। এই আগ্রহ ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ নয়।

কিন্তু বই কি তা হলে বাদ? তা নয়। বরং উল্টোটাই। বইয়ের উপর টান কমে যাচ্ছে দেখে বইকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে পৃথিবীজুড়ে। পৃথিবীর অন্যতম বড় এক অনলাইন বুক স্টোর নিজেই গত বছর একখানা বইয়ের দোকান খুলে ফেলেছে স্ট্র্যাটেজি বদলে। যাতে চোখে দেখে, হাতে ধরে, নেড়েচেড়ে পাঠকের মধ্যে বই কেনার উৎসাহ তৈরি হয়। আবার, বাচ্চারা যাতে একেবারে মুখ না ফেরায়, তার জন্য তাদের বই নিয়ে চলছে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা। তবে এই পড়ার অভ্যেসটা যাতে একেবারে ছোট থেকেই বাচ্চাদের মধ্যে তৈরি হয়, তার জন্য মা-বাবাকেও খেয়াল রাখতে হবে। কী কী করবেন? রইল কিছু পরামর্শ।

স্ক্রিনটাইম বেঁধে দিন

বাচ্চার বই পড়ার অভ্যেস অনেকটাই নির্ভর করে দিনের অন্য সময় সে কী করছে, তার উপর। যদি দিনের ছ’ঘণ্টা সে মোবাইল, টিভিতে ডুবে থাকে, আর ঘণ্টাখানেক রাখে বইয়ের জন্য, তা হলে পড়ার অভ্যেস তৈরি হবে না। বাচ্চাকে বই পড়াতে চাইলে আগে স্ক্রিনটাইম বেঁধে দিতে হবে। ওকে বোঝাতে হবে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়েই শুধু ও মোবাইল, আইপ্যাড পেতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, মা-বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পরও এই রুটিন মানছে কি না সে।

পড়তে হবে মা-কে

বাড়িতে বাচ্চা যদি ছোট থেকেই দেখে বাবা-মা, বিশেষ করে মা সময় পেলেই বই, ম্যাগাজ়িন, খবরের কাগজের পাতা উল্টোচ্ছেন, তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই ওর মধ্যেও পড়ার ঝোঁক বাড়বে। কারণ, বাচ্চাদের অভ্যেসগুলো তাদের কাছের মানুষদের নকল করেই তৈরি হয়। তাই আগে মাকে নিয়মিত পড়ার অভ্যেস তৈরি করতে হবে। তবেই বাচ্চার মধ্যে সেটা বুনে দেওয়া সহজ হবে।

শেষটা জানতে হলে...

বাচ্চাকে গল্প বলতে গিয়ে খানিকটা বলার পরে যখন বুঝবেন সন্তান গল্পটায় পুরো মজে গিয়েছে, তখন বলা বন্ধ করে দিন। আর বলুন, শেষটা আপনি বলবেন না। ওটা এই বইটায় রয়েছে। নিজেকে পড়ে নিতে হবে। অনেক সময় শেষটা জানার আগ্রহে ও নিজেই পড়তে শুরু করবে।

বইয়ের সঙ্গে মেশা

বাচ্চাকে নিয়মিত পাড়ার লাইব্রেরিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। ও যাতে নিজে হাতে ঘেঁটে পছন্দসই বই বেছে নিতে পারে। ধারেকাছে লাইব্রেরি না থাকলে কোনও বুকস্টোরেও নিয়ে যাওয়া যায়। এখন অনেক স্টোরেই বাচ্চাদের বসে বই পড়ার জন্য চমৎকার ব্যবস্থা থাকে। নিজে হাতে করে বই নেড়েচেড়ে দেখলে, সেখানেই বসে কিছুটা পড়তে পারলে তার সঙ্গে এক ধরনের ভালবাসা তৈরি হয়, পরেও যেটা কাজে লাগে।

কী বই কিনবেন

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ঠিক বয়সে ঠিক বই বেছে না দিলে পড়ার অভ্যেস তৈরি তো হবেই না, বরং বিরক্তি আসতে পারে। যেমন, যে বাচ্চার বয়স সবে দুই, তার হাতে নীতিকথার বই ধরালে সেটা বেমানান। তাকে দিতে হবে এমন কিছু বই, যার সঙ্গে সে নিজেকে জুড়তে পারে। যেমন, ছোটদের জন্য ‘টাচ অ্যান্ড ফিল’-বইগুলোয় সিংহের ঝামর কেশরে হাত বোলাতে পারবে ও। আর একটু বয়স বাড়লে পপ-আপ বই দেওয়া যায়। লেখাটুকু আপনি পড়ে দিলেন, ওরাও অজস্র ছবি আর পপ-আপ ফিগারগুলো দেখে-ছুঁয়ে খুশি হয়ে গেল। একটু আধটু পড়তে শিখলে কিছু ক্লাসিক্স, যেমন সিন্ডারেলা, প্রিন্সেস অ্যান্ড দ্য ফ্রগ-এর মতো বই ওকে দেওয়া যায়। এই ধরনের বইগুলোয় প্রচুর ছবির সঙ্গে সহজ করে অল্প কথায় গল্পটা বলা থাকে।

তবে ওকে শুধুই রূপকথার জগতে ঠেলে দেবেন না। বরং ছোট থেকেই বাস্তব দুনিয়ার সঙ্গে একটু একটু করে পরিচয় করান।

বাজারে প্রচুর ইন্টারঅ্যাকটিভ বই পাওয়া যায়। সেগুলোর মধ্য দিয়ে মূল্যবোধ, সুন্দর অভ্যেস, পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে সম্পর্ক, পরিবেশ— নানা বিষয় শেখানো হয়। এই ধরনের বই কিনে দিন। আড়াই-তিন বছর বয়স থেকেই সন্তানকে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, লীলা মজুমদারের লেখা বা পুণ্যলতা চক্রবর্তীর ‘ছোট্ট ছোট্ট গল্প’-র মতো বইগুলো থেকে গল্প পড়ে শোনান। সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’-এর ছড়া বা ‘হ য ব র ল’-ও নিজে পড়তে পারবে আরও একটু বড় হয়ে। ছ’-সাত বছর বয়সে বাচ্চাকে রাসকিন বন্ডের ছোটদের বইগুলো পড়তে দিন। এতে গল্পের মধ্য দিয়েই ও নিজের চারপাশটা তাকিয়ে দেখতে শিখবে। রোয়াল্ড ডাল-এর ‘চার্লি অ্যান্ড দ্য চকলেট ফ্যাক্টরি’ বা ‘মাটিল্ডা’ আট-দশ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য চমৎকার।

তবে, বাচ্চাকে শুধুই কিছু বই কিনে হাতে ধরিয়ে দেওয়া নয়। গোড়ার দিকে, নিজেকেও ওর সঙ্গে পড়তে হবে, ওর বয়সি হয়ে। যে বয়সটায় ও নিজে পড়তে পারবে না, তখন মা-বাবাকেই গল্পগুলো পড়ে শোনাতে হবে। রিডিং পড়া নয়, এতে থাকবে অনেকখানি অভিনয়। গলার আওয়াজ বাড়িয়ে কমিয়ে, চোখ-মুখের নানা ভঙ্গিতে গল্পের চরিত্রগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে হবে। তবেই তো ও গল্প শোনার, আর পরে নিজে পড়ার মধ্যে যে মজাটা থাকে, সেটার স্বাদ নিতে শিখবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE