কেস স্টাডি ১: বছর আটেকের ঋতম দে-র জ্বর উঠেছিল ১০১ পর্যন্ত। কিন্তু চতুর্থ দিন থেকে জ্বর ছিল না। জ্বর না থাকলেও ঋতম যেন ঝিমিয়ে রয়েছে। তার মায়ের সন্দেহ হওয়ায় টেম্পারেচার দেখেন। জ্বর ওঠে ১০১! অথচ বাইরে তার প্রকাশ নেই! সঙ্গে সঙ্গে ব্লাড টেস্ট। ডেঙ্গি ধরা পড়ে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঋতমের আগে একবার ডেঙ্গি হয়ে গিয়েছে বলে চিন্তাটা ছিল বেশি।
কেস স্টাডি ২: ট্যাংরার বাসিন্দা ১২ বছরের মালা সাধুখাঁর প্রথম থেকেই ছিল হাই ফিভার। সারা শরীরে ব্যথা। ডেঙ্গি ধরা পড়ার পর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শরীর এতটাই দুর্বল যে, উঠে বসার ক্ষমতাটুকুও তার নেই। সারাক্ষণ ঘুমোতে ইচ্ছে করছে। খাওয়ার ইচ্ছে একেবারেই ছিল না। প্লেটলেট নেমে যায় তিরিশ হাজারে।
কেস স্টাডি ৩: দশ বছরের আয়ুষি দত্তের প্রথম থেকেই জ্বর ছিল ১০৪-১০৫। সঙ্গে ছিল সাংঘাতিক বমি। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ফুসফুসেও সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। তার পর শরীর ফুলতে থাকে, ইউরিন বন্ধ হয়ে যায়। প্লেটলেট নেমে যায় তিন হাজারে। এর সঙ্গে যোগ হয় প্যানক্রিয়াটাইটিস। তার প্লেটলেট ট্রান্সফিউশনও করা হয়।
উত্তর থেকে দক্ষিণ, পুব থেকে পশ্চিম... জ্বরে কাঁপছে এ শহর ও শহরতলি। ক্রমশ বাড়ছে মৃত্যুর তালিকা। সন্তানহারা অসহায় মুখগুলো বুকে কাঁপন ধরায়। একটা সার্বিক ভীতি চতুর্দিকে জাল বিছিয়েছে। বিশেষ করে আট-দশ-বারো বছরের খুদেগুলোর উপর এ রোগের প্রকোপ যেন বেশি। উপরের কেস স্টাডিগুলো এ কারণেই দেওয়া যে, জটিল অবস্থা পার করে ঋতম, মালা, আয়ুষি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আর এর পিছনে যেমন রয়েছে চিকিৎসকদের ভূমিকা, তেমনই অভিভাবকদের সচেতনতা। তাই এ বার আমাদের পালা, সার্বিক ভাবে সেই সতর্কতা বাড়ানো, যাতে কোনও কুঁড়ি অকালে না ঝরে। এ ব্যাপারে পরামর্শ দিলেন শিশু চিকিৎসক ডা. অপূর্ব ঘোষ।
এখন জ্বর হলে ডেঙ্গির কথাই প্রথমে মনে পড়ে। ডেঙ্গির জ্বরে সাধারণত নাক দিয়ে বেশি সর্দি পড়ছে বা কাশি হচ্ছে, এমনটা বিশেষ দেখা যায় না। কিন্তু সিজন চেঞ্জের জ্বরে সর্দি-কাশি একটু বেশি থাকে। গলাব্যথাও হতে পারে। উলটো দিকে ডেঙ্গিতে ঠোঁট, চোখ একটু লাল হয়ে যাওয়া, সাংঘাতিক গা-হাত-পা ব্যথা থাকে। কিন্তু ঠান্ডা লেগে যে এ ধরনের সমস্যা হবে না, তাও নয়। কিন্তু তার জ্বর কী কারণে হয়েছে, সেটা প্রথমেই বোঝা যায় না। তাই এ ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল এবং ওআরএস ছাড়া অন্য কোনও ওষুধ দেবেন না। গায়ে র্যাশ, ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখলে ব্লাড টেস্টের কথা ভাবা হয়। জ্বর হলে সাধারণত দু’-তিন দিনের মাথায় ব্লাড টেস্ট করা দরকার। খুব তাড়াতাড়ি ব্লাড টেস্ট করা হলে কিছু পাওয়া যায় না। পরে হয়তো দেখা গেল পজিটিভ। অনেক সময় দেখা যায়, এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন পজিটিভ হল না, আইজিএম ডেঙ্গি পজিটিভ হল। প্রাথমিক পর্যায়ে প্লেটলেট হয়তো নর্মাল রেঞ্জের মধ্যে থাকে। তার পর আবার যখন পরীক্ষা করা হল, তখন দেখা গেল আরও একটু কম। তার পর এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন করা হয়। মোটামুটি পাঁচ দিন হয়ে গেলে আইজিএম ডেঙ্গি টেস্ট করা হয়। আইজিএম অ্যান্টিবডি কী ভাবে বাড়ছে দেখার জন্য। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভয়ের কিছু থাকে না।
কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন সাত-আট দিন জ্বরের পর প্রাণহানি ঘটছে, সেটা খুবই আকস্মিক এবং চিন্তারও। যদিও ঠিক মতো মনিটরিং এবং চিকিৎসা হলে সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি। তবে কেউ যখন খুব দেরিতে বাচ্চাকে ভর্তি করতে আনছেন, সমস্যাটা হয় তখন। বাচ্চাটির হয়তো ক্যাপিলারি লিক শুরু হয়ে গিয়েছে। এতে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। পাল্স কমে যায়। ঘাম হয়। ডি-হাইড্রেটেড লাগে। চোখমুখও ফোলা থাকে। বাচ্চাটিও স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না। প্রথম দু’-চার দিনে এটা হয় না। এর পর ক্যাপিলারিগুলো লিক করে।
ডেঙ্গিতে টেম্পারেচার সাধারণত খুব হাই হয়। কিন্তু কখনও-কখনও লো টেম্পারেচারও হতে পারে। যতক্ষণ জ্বর আছে, ততক্ষণ ডেঙ্গি সমস্যা কম করে। জ্বর নেমে যাওয়ার পর তা শুরু হয়। জ্বরের ওঠানামা যেন অনেকটা ঘোড়ার জিনের শেপের মতো। প্রথম
ফেজে বেশি, দ্বিতীয় ফেজে কম। অপূর্ব ঘোষ বিশেষ জোর দিয়ে বললেন, ‘‘বাবা-মায়ের রিডিংটা এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তাতে যেন বুদ্ধিমত্তা থাকে। হয়তো বাচ্চাটির খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু সে মুখে কিছু বলছে না। এগুলো আপনাদের বুঝতে হবে। চিকিৎসার দেরির জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটে। কত তাড়াতাড়ি ব্লাড টেস্ট করে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়, সেগুলো একটু খেয়াল রাখা দরকার।’’
আসলে বাবা-মাকেই প্রথমে বুঝতে হবে, তাঁর সন্তান ঠিক আছে কি না। সেটা কী ভাবে বুঝবেন, তা অবশ্য বলে বোঝানো মুশকিল। ধরুন, কারও ভিতরে খুব তেষ্টা রয়েছে। তা হলে তার কথাবার্তায় কিন্তু সাবলীল ভাব থাকবে না। সেটা একটা ফিলিং, যা বুঝতে হবে। কোনও কোনও বাবা-মা প্রাথমিক অবস্থাতেই চলে আসেন, ডেঙ্গি বা অন্য কোনও রোগাক্রান্ত সন্তানকে নিয়ে। কেউ আবার সাত-আট দিন ধরে জ্বর ফেলে রাখার পরও চেষ্টা করেন, যদি হাসপাতালে ভর্তি না করে রোগ সারানো যায়। ডা. ঘোষের মতে, ‘‘নিয়ম হল, সাত দিনের উপরে জ্বর হলেই বাচ্চাটিকে ভর্তি করে চিকিৎসা করতে হবে। অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে বলুন ডাক্তারবাবু, কেন ভর্তি করতে হবে? আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, এই বাচ্চাটিকে অবজারভেশনে রাখা প্রয়োজন। তার পর পরীক্ষা করে বোঝা যাবে, তার কী হয়েছে। যদিও আমরা কাউকে নার্ভাস করতে চাই না, কিন্তু এটাও ডেঙ্গির একটা দিক যে, নার্ভাস বাবা-মায়েদের বাচ্চারা বোধ হয় একটু সেফ থাকে। এটিকে কখনও হালকা ভাবে নেবেন না।’’ এ বার উত্তর দেওয়া হল কয়েকটি প্রশ্নের, যা হয়তো আমাদের সকলের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে...
জ্বর হলে কী করা উচিত:
বাচ্চাকে প্রচুর পরিমাণে জল, ওআরএস খাওয়াবেন। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনও ওষুধ ব্যবহার করবেন না। পেটের গন্ডগোল হোক বা না হোক ওআরএসের জল খাওয়াবেন, শরীরটা যাতে ডিহাইড্রেটেড থাকে। এমনিতেও জ্বর হলে শরীরে জলের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেড়ে যায়। ওআরএস আর প্যারাসিটামল এই দুটোই হচ্ছে ডেঙ্গির মূল চিকিৎসা।
ডেঙ্গি ধরা পড়লে কী করবেন? ডাক্তারের পরামর্শের ভিত্তিতে, বাচ্চার ওজন ও বয়স অনুযায়ী তাকে জল খাওয়াতে থাকুন। যদি মনে হয় সন্তান একটু অন্য রকম আচরণ করছে, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। আর ডাক্তারের পক্ষেও কিন্তু একবার দেখে বোঝা সম্ভব নয়, বাচ্চাটি ঠিক আছে কি না। হয়তো যখন সে চেম্বারে এল, তখন ভালই। কিন্তু ক্রমশ অবস্থা খারাপ হতে লাগল। আমাদের হেলথ ইনফ্রাসস্ট্রাকচারের পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো এটা বলা ঠিক হবে না যে, ডেঙ্গি ধরা পড়লেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করুন। কিন্তু বেড থাকলে, আর্লি স্টেজে ভর্তি করাটা ডা. ঘোষের সাজেশন।
প্লেটলেটের সঙ্গে ডেঙ্গির সম্পর্ক: প্লেটলেট পড়ে যাওয়া মানেই কিন্তু ডেঙ্গি নয়। তবে ডেঙ্গিতে প্লেটলেট পড়ে যায়। কারও ক্ষেত্রে সেটা কমে কুড়ি বা তিরিশ হাজার হতে পারে বা তার চেয়েও কম। প্লেটলেট কাউন্ট দেখে ডেঙ্গি ডায়াগনসিস করা যায় না, কারণ আরও অনেক কারণেই প্লেটলেট কমতে পারে। ডেঙ্গি নির্ধারণের জন্য এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন পজিটিভ বা আইজিএম হল আসল পরীক্ষা।
ভ্যাকসিনেশন: এ নিয়ে গবেষণা চলছে। বিভিন্ন জায়গায় ভ্যাকসিন ট্রায়াল চলছে। কিন্তু এখনও পুরোপুরি সাফল্য আসেনি। ডেঙ্গিতে কিন্তু আংশিক প্রোটেকশন খুবই ক্ষতিকর। ডেঙ্গি যখন প্রথম বার হচ্ছে, তখন ততটা ঝামেলা করছে না। দ্বিতীয় বার, যখন পার্শিয়াল প্রোটেকশন হয়ে গিয়েছে, তখনই সমস্যাটা বেশি হয়। সে সব বিবেচনার পর এক-দু’ বছরের মধ্যে হয়তো ভ্যাকসিনটি বেরোবে।
বাচ্চাদের জন্য সতর্কতা: অবশ্যই মশারি টাঙান। এ ব্যাপারে ডা. অপূর্ব ঘোষের অনুরোধ, ‘‘স্কুলগুলোকে বলতে চাই, এ সময়টা বাচ্চাদের স্কুলড্রেসের নীচে পা-ঢাকা কিছু পরার অনুমতি দিন। ফুল কভার করে বাচ্চাকে স্কুলে পাঠান।’’ মসকুইটো রেপেল্যান্ট অবশ্যই ব্যবহার করুন। অনেকে নারকেল তেল লাগানোর কথা বলেন, তবে তা ভিত্তিহীন।
ডেঙ্গি চিন্তার কারণ ঠিকই। কিন্তু তা থেকে মৃত্যু ঠেকানো বোধ হয় সম্ভব, যদি আমরা একটু সচেতন হই। জল যেমন কোথাও জমতে দেওয়া যাবে না, তেমনই জ্বর হলে রোগী কেমন আচরণ করছে, সেটা বোঝাও ভীষণ জরুরি। তা হলেই বোধ হয় আমরা এই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy