দৃশ্যসুখ: অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে সম্মিলিত প্রদর্শনী ‘ভিশন’
আয়োজনে ত্রুটি ছিল না তেমন, তবে ক্যাটালগে ছাপা দশজনের নাম থাকা সত্ত্বেও একজন শিল্পীর ছবি-সহ অনুপস্থিতিতে একটু খটকা তো লাগবেই। বিদেশে থাকেন, আসেননি, ছবিও পাঠাতে পারেননি। তা হলে তাঁর উপস্থিতিকে এ ভাবে প্রকাশ না করলে কীই বা ক্ষতি হত! ওঁদের সকলেই সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর উপাধিধারী। এই ন’জন শিল্পীই নানা মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন। ‘ভিশন’ নামে তাঁদের সম্মিলিত প্রদর্শনীটি সম্পন্ন হল সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে।
আশি উত্তীর্ণ অজয় ঘোষ ইন্ডিয়ান পেন্টিংয়ে অতি পরিচিত নাম। ভারতীয় অণুচিত্রের যে ধারাবাহিক অধ্যায় এ দেশের চিত্র পরম্পরাকে সমৃদ্ধ করেছে, অজয় সেই ধারারই এক যোগ্য বাহক। যদিও তা থেকে বেরিয়ে, তিনি তাঁর নিজস্ব স্টাইলকে বদলে কখনও অন্য ধরনের রচনাও করেছেন, তবুও মূল সুরটি কিন্তু তাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। অপেক্ষাকৃত স্তিমিত বর্ণের ব্যবহারে ও অণুচিত্রের কিছু রূপবন্ধ কাজে লাগিয়ে চমৎকারিত্ব এনেছেন। তাঁর টেম্পারায় করা পাকা ধানের আঁটির গুচ্ছ ও ন’জন চাষির ভিন্ন অভিব্যক্তি, তাঁদের হাতের লাঠি কিংবা কাঠের চাকাওয়ালা ঠেলা...সব মিলিয়ে এক জ্যামিতিক ভারসাম্যে এক গ্রাম্য জীবনের ছবিটি অসাধারণ সংবেদনশীল। স্বল্পবর্ণ ও ড্রয়িংকেন্দ্রিক কাজ।
বরাবরই নিষ্ঠাবান শিল্পী বিশ্বপতি মাইতি এক নির্দিষ্ট আয়তনে সীমাবদ্ধ রাখেন তাঁর ছবিকে। দৃষ্টিনন্দন এবং অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট পটে, নিজস্ব টেকনিক এবং স্টাইলাইজ়েশনে—শুধু সূক্ষ্মতা আর সংবেদনশীলতার গুণেই ওঁর ছবির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে বাধ্য করেন। মিশ্র মাধ্যমে ধরে ধরে কাজ করেছেন। লাল পটভূমিতে কালো অন্ধকারের মধ্যে মুণ্ডহীন মুক্তোর মালাখচিত পাগড়ি, মুখের আদলও কালো দিয়েই বার করেছেন। ডান হাতে উত্থিত তরবারি, নীলচে সাদা কারুকার্যময় বুকখোলা কোট—এ ছবি অনেক প্রাচীন কাহিনিকে মনে পড়ায়। যেমন বাঁশের ছাতার বাটের উপরে দু’হাতের ভর দিয়ে বসা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত বৃদ্ধ, পিছনে বাড়ির আদল, অসাধারণ দু’তিনটি রঙে বোর্ডে অ্যাক্রিলিক দিয়ে করেছেন। নিবিষ্ট হয়ে পাথরের উপরে বসা এই বৃদ্ধের রচনাটি অনন্যসাধারণ।
সামনে টেবিল, তাতে লম্বা ফুলদানিতে রাখা মানিপ্ল্যান্ট, পিছনে লালচে খয়েরি চুলের ও নীল ওড়নায় তরঙ্গায়িত এক সুন্দরীর টেম্পারাটিও কম আকর্ষক নয়।
এক সময়ে ঝড়ের বেগে ব্রাশিংয়ে অতি সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিলক মণ্ডল। তেলরঙের ক্যানভাস ছিল সোচ্চার। স্পেসকে প্রাধান্য দেওয়া সেই সব আধুনিকীকরণ থেকে বর্তমানে অন্য ধারার সংযমী মনোভাবে পৌঁছেছেন। এখনকার কাজে একটা ইউরোপীয় আধুনিক ঘরানা অনুভূত হয়। নারী নিয়ে করা অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাস ক’টিকে অসাধারণ দক্ষতায় রচনা করেছেন। অধ্যবসায় ও অভিজ্ঞতার দীর্ঘ বুনিয়াদ তাঁর এখনকার কাজকে আরও মহার্ঘ করেছে, সন্দেহ নেই। বিশেষত তাঁর স্টাইল, বর্ণ ব্যবহার ও রচনার গুণে এই বিশিষ্ট আধুনিকতা নিঃসন্দেহে বিশ্বশিল্পের রূপরেখার একটি দিককে প্রাঞ্জল করে।
মনোজ সরকার ভীষণ ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন গণেশ পাইনের কাজে। ফলে ওঁর স্টাইল-টেকনিকের প্রায় হুবহু প্রতিফলন ঘটেছে বিশেষত মনোজের একটি কাজে। অন্যগুলিতে সে সব কাটিয়ে ওঠার প্রবণতা কাজ করলেও সর্বত্র তা পরিহার করতে পারেননি। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক করেছেন—টেম্পারার অবিস্মরণীয়তা সেখানে উপস্থিত। এই সমস্ত নিজস্ব আঙ্গিকও তৈরি করেন মনোজ অনেক আগেই। ‘দ্য হিস্টোরিয়ান’ বা ‘দ্য বর্ডার’ কাজ দুটি অন্তত তেমনই দিকনির্দেশ করে।
রবীন্দ্রনাথ চৌধুরীর কাজে অদ্ভুত রহস্যময়তার ছোঁয়া আছে। বিস্ময়কর কম্পোজ়িশন, আশ্চর্য জ্যামিতিনির্ভর ওঁর এক-একটি সাহসী রচনাতেও খুঁজে পাওয়া যায় ছন্দ ও কাব্যিক চেতনার এক দ্বৈত অবস্থানকে। অবিশ্বাস্য বর্ণ ব্যবহার, স্পেস, আলো-অন্ধকার— সব কিছুর চূড়ান্ত পরীক্ষানিরীক্ষায় তবু কোথাও রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে। কাজগুলি সবই ক্যানভাসের উপরে তেলরঙে করা।
সরোজ বসুর কাজ দেখলে তাঁদের সে সময়কার শিক্ষক অশেষ মিত্রের ঘরানা মনে পড়ে। সরোজের কাজে যথেষ্ট মুনশিয়ানা আছে। জ্যামিতির মতো টুকরো ফর্মেশনের রচনাগুলিতে মানুষ, পশু ও সামগ্রিক আবহকে যেন রূপকথার বিন্যাসেই গেঁথেছেন। তেলরঙের কাজে আলোর ব্যবহারও চমৎকার।
এঁরা ছাড়াও প্রদর্শনীতে অংশ নেন জ্যোতিপ্রসাদ মল্লিক, তীর্থঙ্কর বিশ্বাস, গৌতম প্রামাণিক প্রমুখ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy