জীবনমুখী: ‘লাইফ ইন প্রিন্টস’ প্রদর্শনীর কয়েকটি কাজ। সম্প্রতি গ্যালারি ৮৮-তে
সেই ১৯৭৭ থেকে ২০০৯। বত্রিশ বছরের নির্বাচিত ৭০টি গ্র্যাফিক্স (এচিং, অ্যাকোয়াটিন্ট, লিথো, প্লেট লিথো, ড্রাই পয়েন্ট, উডকাট, সিল্ক স্ক্রিন, সেরিগ্রাফ, পেন-ইঙ্ক-ব্রাশ)-এর কাজ নিয়ে এত বড় মাপের একক প্রদর্শনী পিনাকী বড়ুয়া আগে কখনও করেননি। গ্যালারি ৮৮-তে সম্প্রতি তাঁর ‘লাইফ ইন প্রিন্টস’ নামের এই পূর্বাপর প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন অধ্যাপক আর শিবকুমার। রিয়্যালিস্ট গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিল্পী পিনাকী বর্তমানে স্মৃতিবিস্মৃত ও বাকশক্তিহীন। দু’-একটি রঙিন কাজ বাদ দিলে প্রদর্শনীতে সবই ওঁর সাদা-কালো প্রিন্ট।
শান্তিনিকেতন কলাভবনে মেধাবী গ্র্যাফিক্সের ছাত্র হিসেবে অনেকটাই কেটেছে তাঁর সেখানকার বিস্তীর্ণ মাঠ, লাল বাঁধ, খোয়াই ইত্যাদি নিসর্গের গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্যে। রামকিঙ্কর এবং বিনোদবিহারীর ড্রয়িং তাঁকে প্রাণিত করেছিল। ১৯৭৭-৭৮ পর্বেই পেন-ইঙ্ক ও ব্রাশে করা কিছু নিসর্গের ড্রয়িং ও লিথোগ্রাফে দেখা যায় জ্যামিতিক আভাস ও আধুনিক টানটোনের অসাধারণত্ব। ঘনত্ব, ছায়াতপের ব্যবহার চিত্রকল্পের নির্জন অলঙ্কার, বিশেষত বৃক্ষের সরলীকরণ।
অনেকের কাজই তাঁকে বারবার অনুপ্রাণিত করেছে। গোইয়া কিংবা পিকাসোয় যেমন মেতেছেন, রেমব্রার এচিংয়েও তেমনই। তাঁর পূর্বাপর প্রদর্শনী খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, তাঁর অন্যতম প্রিয় শিক্ষক সোমনাথ হোড় কী ভাবে মিশে আছেন পিনাকীর অধিকাংশ কাজে। শুধু তা-ই নয়, জর্মান এক্সপ্রেশনিজ়ম, অটো-ডিক্সের কাজও প্রভাবিত করেছে ওঁকে। সে সবেরই সকল নির্যাস নিয়ে তাঁর নিজস্ব টেকনিক ও স্টাইলকে ধাতুপাত তক্ষণ ও অন্য মাধ্যমে যে ভাবে শুধু সাদা-কালো কম্পোজ়িশনে ব্যাখ্যা করেছেন— অভাবনীয়!
ট্রেকিং ও ক্যামেরা দু’টিই অন্যতম প্রিয় ছিল তাঁর। শান্তিনিকেতনের মগ্ন পরিবেশ ও শিল্পবিশ্বের আভ্যন্তরীণ পর্বটিকে শিক্ষানবিশ পর্যায়েই গভীর ভাবে বুঝে নেওয়ার আকুতি কাজ করেছিল। রবীন্দ্রনাথের নাটক ও পেন্টিংকে অতি নিবিড় পর্যবেক্ষণে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা ছিল। পিনাকীর সাদা-কালো এচিং ও অ্যাকোয়াটিন্টে রবীন্দ্র-নাটকের এক অনুরণন কোথায় যেন অন্ধকারের রাজাকে বারবার ফিরিয়ে আনে। প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে পরিচিত নানা দৃশ্যকল্প।
ছাপচিত্রে স্বল্প পরিসর স্পেসকে অবিশ্বাস্য ভাবে ব্যবহার করার এমন পরীক্ষামূলক দুঃসাহস তাঁর অধিকাংশ কম্পোজ়িশনকে বহু বারই সম্মোহিত করেছে। এচিং অ্যাকোয়াটিন্টের কাজে ধাতুপাতের পরিতলে আলোআঁধারির ঘনত্ব ও ছায়াতপের বিভিন্ন টোনকে যে টেকনিকে ব্যবহার করেছেন, প্রিন্ট মেকিংয়ের শিক্ষানবিশদের কাছে তা আদর্শ বইকী! কেউ কেউ তাঁকে হুবহু অনুকরণও করছেন। যদিও সোমনাথ হোড় থেকে সরে আসতে গিয়ে পিনাকীকে বদলাতে হয়েছে নিজের কাজকে, তবু কোথাও যেন সোমনাথ হোড়ের নিবিড় উপস্থিতি এড়াতে পারেননি।
অ্যাসিড বাইটের সময়সীমা এবং পরবর্তী এফেক্ট সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন। প্লেটে ক্ষত ও সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর লাইন, টোন, ঘষামাজা একটা আবহ তৈরিতে আলো-অন্ধকারের উৎস ও তা বিলীন করে দেওয়ার মধ্যে নানা চমক দেখিয়েছেন। এখানে নেগেটিভ স্পেস ও সমগ্র স্পেসকে ভাগ করে মানব-মানবীর নাটকীয় মুহূর্ত ও বিবিধ রূপবন্ধকে যে ভাবে সাজিয়েছেন, তাতে মাধ্যমটির যাবতীয় গুণ উপস্থিত হয়েও একটি গভীরতর প্যাশন তৈরি হচ্ছে। মনে পড়ে প্রত্ন-ভাস্কর্য ও আফ্রিকান মাস্ক।
তাঁর রচনা কখনও ভীষণ সোচ্চার, আবার একই সঙ্গে খুবই নির্বাক। বামপন্থী রাজনীতির প্রেক্ষাপট তাঁকে আচ্ছন্ন করেছিল। সত্তরের পরবর্তী পর্বে অতি বাম রাজনীতির খুনোখুনির দর্শন, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, রুশ বিপ্লব— কমবেশি সবই তাঁকে উদ্বেলিত উত্তেজিত করেছিল, সন্দেহ নেই। মানব-মানবীর নাটকীয় মুহূর্ত, বিবিধ রূপবন্ধের প্রতীকী ব্যবহার, কালোর মধ্যে সাদার সূক্ষ্ম টেক্সচার ও জ্যামিতি, হত্যাদৃশ্য, মৃত্যু, আর্তনাদ, প্রতিরোধ, ভয়, প্রতিবাদ, আশ্রয়, চিন্তা, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ানো আর এক রকম জীবনের কথাই বলতে চেয়েছেন পিনাকী।
এই প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য কাজ ‘আন্ডার ওয়াটার’, ‘শার্প এজেস’, ‘সেনস্যুয়ালিটি’, ‘মাই ফ্রেন্ড’, ‘শি’, ‘পেজ ফ্রম ইরাক ওয়ার’, ‘রোডসাইড ভেন্ডর’, ‘ইনোসেন্ট ভিক্টিম’, ‘অল বাই আওয়ারসেল্ভস’, ‘সেফগার্ডিং ডেমোক্র্যাসি’ ইত্যাদি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy