Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ওহ বংশী, ফিল্মের ফাঁকি শেখো

আঁকিয়ে হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কাশ্মীর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত। পেট চালাতে আঁকছিলেন সিনেমার সিন। একদিন দেখা মানিক নামে এক ঢ্যাঙা তরুণের সঙ্গে। শুরু হল জয়যাত্রা। লিখছেন সোমেশ ভট্টাচার্য।আঁকিয়ে হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কাশ্মীর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত। পেট চালাতে আঁকছিলেন সিনেমার সিন। একদিন দেখা মানিক নামে এক ঢ্যাঙা তরুণের সঙ্গে। শুরু হল জয়যাত্রা। লিখছেন সোমেশ ভট্টাচার্য।

বংশী চন্দ্রগুপ্ত।

বংশী চন্দ্রগুপ্ত।

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৭ ০০:২৭
Share: Save:

গাঁয়ের পথ জুড়ে ঢিমে তালে চলেছে শোভাযাত্রা। এ দিকে ট্রেনের সময় হয়ে গিয়েছে। এক মার্কিন দম্পতির গাড়িতে বসে উসখুস করছেন ওঁরা।

কোনও মতে ভিড় কাটিয়ে, গাড়ি যখন স্টেশনে পৌঁছল, ঝমঝমিয়ে ট্রেন ঢুকছে। দৌড়, দৌড়। পড়িমরি ট্রেনের পাদানিতে লাফিয়ে উঠে পিছনে ফিরলেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত— বংশী কোথায়? বংশী?

বংশী উপুড় হয়ে প্ল্যাটফর্মে পড়ে! চিদানন্দ লাফিয়ে নামলেন। কানে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছেন বংশী। অ্যাম্বুল্যান্স ছুটল ব্রুকহাভেন মেমোরিয়াল হাসপাতালে। একটু ক্ষণের লড়াই। ডাক্তারেরা জানিয়ে দিলেন, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, বংশী চন্দ্রগুপ্ত আর নেই!

২৭ জুন, ১৯৮১। আমেরিকা জুড়ে সত্যজিৎ রায়ের ছবির প্রদর্শনী সবে শুরু হয়েছে। তাঁর জোরাজুরিতেই সঙ্গে গিয়েছিলেন বংশী। সত্যজিতের কালজয়ী সব ছবির শিল্প নির্দেশনা যাঁর, তিনি যাবেন না, তা কি হয়?

সেই প্রথম বংশীর বিদেশে যাওয়া। ঠাসা শেডিউলের ফাঁকে লং আইল্যান্ডের সমুদ্রতীরে বেড়াতে গিয়েছিলেন দু’বন্ধু। সস্ত্রীক সত্যজিৎ তখন নিউইয়র্কে। সেখানেই ফোনে খবরটা দিলেন চিদানন্দ। ফোনের ও পারে স্তব্ধ ব্যারিটোন। স্তম্ভিত।

‘এর চেয়ে শকিং আর কী হতে পারে?’ সব সূচি বাতিল করে দেশে ফিরে গেলেন সত্যজিৎ।

নায়ক

যাওয়ারই তো কথা! আজীবন বন্ধুত্ব। একের পর এক আশ্চর্য সব কাজ। গোটা ইউনিটে এক মাত্র তিনিই সত্যজিৎকে ডাকতেন ‘মানিক’ বলে। বংশী বুঁদ হয়ে সেট গড়ছেন বলে, তৈরি হয়েও দু’-চার দিন শ্যুটিং পিছিয়ে দিতেন এমনিতে ভীষণ মেপে চলা সত্যজিৎ।

শুরুটা চল্লিশের দশকে। ইউএসআইএস-এ (এখনকার আমেরিকান লাইব্রেরি) সিনেমার বইপত্র পড়তে যেতেন বংশী। সত্যজিৎ তখন ডি জে কিমারে কাজ করেন, বংশী কাঠ বেকার। যদিও ছবিতে সেট করার হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছে। ‘‘ওর কাঁধ-লুটোনো চুল দেখে প্রথমে আমার সন্দেহ হয়েছিল যে ও নাচিয়ে। পরে জানা গেল, ও পেন্টার’’— এই স্মৃতি সত্যজিতের। এর কিছু দিন পরেই ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি তৈরি হবে, দু’জনেই যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

তখনও কিন্তু বংশীর ‘পেন্টার’ পরিচয়টাই বড় ছিল। আঁকিয়ে হতেই তাঁর শ্রীনগর থেকে বাংলায় চলে আসা। জন্ম শিয়ালকোটে (এখন পাকিস্তানে)। বিচারপতি বাবার পালিত পুত্র। দেশভাগের বেশ কিছু আগেই কাশ্মীরে চলে আসে চন্দ্রগুপ্ত পরিবার। স্কুল শেষে বংশী ভর্তি হন শ্রীনগর কলেজে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ে কলেজ ছাড়েন। হৃদয়ে তখন কারুবাসনা।

চারুলতা

রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন ঠাকুরের পৌত্র সুভো তখন শ্রীনগরে মেয়েদের স্কুলে পেন্টিং শেখান। বংশী লেগে পড়লেন তাঁর সঙ্গে। পরে সুভো যখন কলকাতায় ফিরে এলেন, বংশীও এলেন পিছু-পিছু। ১৯৪৪। কলাভবনে ভর্তি হতে চান, শান্তিনিকেতনে গিয়ে নন্দলাল বসুর সঙ্গে দেখা করলেন বংশী। কিন্তু ভগ্নমনোরথ হয়ে ফিরতে হল।

কোথায় যাবেন? কী করবেন?

কলকাতার যে সব তরুণ চিত্রকর তখন তাঁদের কাজে সরাসরি জীবনের আঁচ তুলে আনতে চাইছিলেন, তাঁদের নেতা সুভো। ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’ গড়ে ছবিতে আধুনিকতা আমদানি করছিলেন তাঁরা। ৩ নম্বর এস আর দাস রোডে গ্রুপের একটা আস্তানা করেছিলেন সুভো। সেখানেই ঠাঁই হল বংশীর। পরে এসে জুটলেন তাপস সেন, তখনও তিনি থিয়েটারে আলো করে হইচই ফেলেননি।

এটা-সেটা করে চলছিল। সুভো ঠাকুরের দৌলতেই ‘অভিযাত্রী’ নামে একটা ছবিতে সেট সাজানোর কাজ পেলেন বংশী। তখন সেট আঁকা কথাটাই বেশি চলত, ইট কাঠ বোর্ড দিয়ে বাস্তবানুগ সেট গড়ার চল হয়নি। গাছপালা, রাস্তা, বাড়িঘর এঁকে দেওয়া হত। তার সামনেই অভিনেতারা চলে-ফিরে বেড়াতেন। বংশী সেট তো আঁকলেনই, শ্রমিক নেতার ছোট ভূমিকায় অভিনয়ও করে ফেললেন। তখনও দু’জনের পরিচয় ছিল না, কিন্তু ছোট্ট সে অভিনয় দেখে মুগ্ধ খোদ মানিক।

এর পর ফের বেকার। বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের হিন্দি সংলাপ শিখিয়ে কোনও রকমে দিন চলছে। লাহৌর থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতায় এসে ন্যাশনাল স্টু়ডিয়ো খুললেন এস ডি নারাং, বংশীকে করলেন আর্ট ডিরেক্টর। কিন্তু কানন দেবীর সামনে সিগারেট টানার অপরাধে সেই চাকরিও গেল!

এই রকমই একটা সময়ে সত্যজিতের সঙ্গে বংশীর পরিচয়। গুটিকয় তরুণ তখন দিশি সিনেমার নাটুকে ধরনধারণ নিয়ে বিরক্ত। ছবি কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে রাতদিন চর্চা করছেন তাঁরা। বিদেশি পত্রপত্রিকা যতটুকু যা হাতে আসে, গোগ্রাসে গিলছেন। রাস্তা খুঁজছেন।

শতরঞ্জ কে খিলাড়ী

বড় ঘটনাটা ঘটে গেল যখন ১৯৫০ সালে ফরাসি চলচ্চিত্রকার জঁ রেনোয়া কলকাতায় এলেন তাঁর ইংরেজি ছবি ‘দ্য রিভার’ শ্যুট করতে। আগে অভিজ্ঞতা থাকার সুবাদে বংশীর জুটে গেল আর্ট ডিরেক্টরের কাজ। তাঁর মাথার উপর প্রোডাকশন ডিজাইনার ইউজিন ল্যুরিয়ে। ফরাসি দেশে তো বটেই, তত দিনে হলিউডেও কিছু বড় মাপের কাজ করে ফেলেছেন তিনি, চ্যাপলিনের ‘লাইমলাইট’ তার অন্যতম। তাঁর কাছেই বংশী প্রথম দেখলেন সেটের বাস্তবতা কাকে বলে! রাস্তা, ঘরদোর, বাজার হুবহু আসলের মতো দেখতে। জ্যান্ত!

তৃতীয় নয়ন খুলে গেল বংশীর!

সত্যজিৎ আর অন্য বন্ধুরাও শিখতে লাগলেন ছবি করা। স্টিল ক্যামেরা হাতে সেই শ্যুটিং আদ্যোপান্ত দেখেছিলেন সুব্রত মিত্র নামে এক তরুণ, বাকিদের চেয়ে বয়সে অনেকটাই ছোট। বছর তিনেক বাদে বর্ধমানের পালসিটে এক কাশবনে তাঁর হাতেই প্রথম বার মুভি ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়ে সত্যজিৎ বলবেন, ‘অ্যাকশন!’ আর শুরু হয়ে যাবে এই ত্রয়ীর জয়যাত্রা— সত্যজিৎ, বংশী, সুব্রত।

‘পথের পাঁচালী’ তৈরির সময়ে কিন্তু বংশীই ছিলেন দলের একমাত্র লোক, যাঁর হাতে-কলমে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল। সত্যজিৎ তখনও শ্যুটিংয়ে সড়গড় নন, শটের শেষে ‘কাট’ বলতেও ভুলে যেতেন। ক্যামেরা চলছে তো চলছেই। কাশবনের আড়াল থেকে বংশীই চেঁচিয়ে উঠতেন, ‘মানিক, কাট বলো, কাট বলো!’

গড়িয়ার কাছে বোড়ালে একটা ভাঙা কুঁড়ের চেহারা পাল্টে তৈরি হয়েছিল হরিহরের বাড়ি। কিন্তু সেটা প্রথম নয়। তার আগেই ‘ভোর হয়ে এলো’ ছবিতে গোটা একটা বস্তি তৈরি করে ফেলেছেন বংশী। লোকে দেখে চমকে গিয়েছে, এত নিখুঁত, লোকে আগে দেখেনি।

সত্যজিতের দ্বিতীয় ছবি ‘অপরাজিত’, আরও এক পা এগিয়ে গেলেন বংশী-সুব্রত জুটি। কাশীতে অপুদের বাড়ির অন্দরটা যে কলকাতার স্টুডিয়োয় গড়া সেট, বহু দিন পর্যন্ত লোকে তা জানত না। ঘিঞ্জি গলিতে বাড়ির উঠোনের উপর থেকে চুঁইয়ে আসা মরা আলোর আভাস আনতে সুব্রত বলেছিলেন সেটের উপরটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে। বংশী তা-ই করলেন। নীচ থেকে আলো ছুড়ে প্রতিফলিত করে নামিয়ে আনা হল, তৈরি হল চুঁইয়ে আসা আলোর আভাস। বিখ্যাত বাউন্স লাইটের সেই সূচনা, হয়তো গোটা বিশ্ব চলচ্চিত্রেই। যদিও ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জানান দেওয়াটা ওঁদের স্বভাবে ছিল না।

উমরাও জান

এর পর তো ‘জলসাঘর’ ছবির সেই নাচঘর। বাইরেটা মুর্শিদাবাদে, পদ্মাপাড়ে নিমতিতার রাজবাড়ি। আর ভিতরটা? হেমন্তের বিকেলে বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে বসে হাসতে-হাসতে সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ বলেন, ‘‘কত লোক যে ওই রাজবাড়িতে নাচঘর খুঁজতে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরেছে! সে ঘর তো অরোরা স্টুডিয়োয় গড়া সেট! যেমন ‘অপুর সংসার’-এ অপুর ঘরটা, বাইরের ছাদ টালার এক বাড়িতে। এই যে ভিতর-বাইরে, সেট আর আসল নিখুঁত ভাবে মিলিয়ে দেওয়া, এখানেই বংশীকাকু অনন্য!’’

‘নায়ক’ ছবির গোটা ট্রেনটাই সেট। জানালা দিয়ে যে ঘরবাড়ি গাছপালা সাঁ-সাঁ করে সরে যেতে দেখা যায়, সেটা পিছনে পর্দায় ফেলা ছবি। ব্যাক প্রোজেকশন। সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘বংশী, সেটটা এমন ভাবে কোরো, যাতে আমরা ওটাকে হালকা কাঁপাতে পারি। ট্রেনটা চলছে তো।’ লিলুয়া ওয়র্কশপে গিয়ে ডিল্যুক্স এয়ারকন্ডিশনড ভেস্টিবিউলসের নকশা হুবহু তুলে আনলেন বংশী। সেট বানালেন একেবারে আসল লোহা-কাঠ-ফ্রেম দিয়ে। ফলে দেখতে হল নিখুঁত, কিন্তু সাতমণি ভারী। কাঁপানো অসম্ভব!

‘‘বংশীকাকুর তো মনখারাপ। তখন বাবা বললেন, ‘ও নিয়ে তুমি একদম ভেবো না। সাউন্ড-টাউন্ড পড়বে, তার পর সামনে যত কিছু ঘটবে, মনে হয় না দর্শক খেয়াল করবে যে ট্রেনটা দুলছে না।’ তবু কিছু কিছু ব্যাপার যেমন, শর্মিলাদি (শর্মিলা ঠাকুর) যে চেয়ার কারে বসেছিলেন, সেখানে পিছনে একটা ফ্লাস্কের মতো ঝোলানো ছিল। সেটা একজন অল্প-অল্প নাড়াচ্ছিল লুকিয়ে বসে, দুলুনির আভাসটা আনতে। তাতেই কাজ হয়ে যায়,’’ রহস্য ফাঁস করেন সন্দীপ, ‘‘বিদেশেও সকলে চমকে গেছিল শুনে যে, এটা সেট!’’

‘অপুর সংসার’ ছবিতে অভিনয়ের আগেই ‘পরশপাথর’ ছবির সেট দেখতে গিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নামে এক তরুণ। তাঁর কথায়, ‘‘ফিনিশিংয়ের খুঁটিনাটির প্রতি তীক্ষ্ণ নজর ওঁর সেটগুলোকে এত জীবন্ত করে তুলছিল, সেটা আমার তখনই খুব স্ট্রাইক করেছিল।’’ মজার কথা, বংশী কিন্তু ‘পরশপাথর’ নিয়ে একেবারেই খুশি ছিলেন না। তাঁর মতে, ‘‘আর্ট ডিরেকশন খারাপ, তাড়াহুড়োয় অযত্নে তৈরি পরিবেশ, স্টাইল নেই।’’

গুপী গাইন বাঘা বাইন

ওই ছবিতে এমনকী সত্যজিতের কাজও বংশীর ভাল লাগেনি। বিশেষ করে ককটেল পার্টির দৃশ্যে। ‘‘মনে হয় ধনীদের বা মদ-জুয়ার প্রতি তাদের ঝোঁক সম্পর্কে সত্যজিতের কিছু বদ্ধমূল ধারণা ছিল। তাই সত্যিকারের মানুষের বদলে তাদের ক্যারিকেচার বা টাইপ বলে মনে হয়েছে,’’ এমন সপাটে বোধহয় একমাত্র বংশীই বলতে পারেন। এবং তাতে মানিকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এতটুকু টসকায় না। দু’জনের বন্ধুত্বটাই ছিল এই পর্যায়ে।

সত্যি বলতে, আশ্চর্য তালমিল ছিল দু’জনের। দু’জনেই প্রথমত আঁকিয়ে। সত্যজিৎ স্কেচ করে বুঝিয়ে দিতেন কেমনটা চান। বংশী সেই স্কেচ ধরে বিস্তারিত নকশা তৈরি করতেন। আপত্তি থাকলে বলতেন। এই ভাবেই কাজ হত।

‘‘বংশীকাকুর একটা খুব অদ্ভুত চোখ ছিল। বিশেষ করে ডিটেলের প্রতি। দুর্দান্ত ব্লু প্রিন্ট করতেন। আর সে রকমই ফিনিশ,’’ সম্ভ্রম ঝরে পড়ে সন্দীপের গলায়। বাস্তব থেকে যাবতীয় খুঁটিনাটি তুলে আনার জন্য বংশীর প্রধান অস্ত্র ছিল একটা লাইকা ক্যামেরা। যেখানেই যেতেন প্রচুর ছবি তুলতেন। তার পর শুরু হত ইঞ্চি মেপে বাস্তবের পুনর্নির্মাণ।

সেই ডিটেলেরই আশ্চর্য খেলা দেখা গেল ‘মহানগর’ ছবিতে এসে। ছাপোষা নিম্ন মধ্যবিত্তের একচিলতে সংসার পর্দায় দপদপ করে উঠল। আর তার পরের বছরই ‘চারুলতা’ ছবিতে করা হল ঠিক উল্টো, বনেদি বাড়ির ছড়ানো মহলে পিরিয়ড পিসের জাদু। সত্যজিতের মতে, ‘চারুলতা’ই বংশীর অন্যতম সেরা কাজ। বংশীও বলতেন, এই ছবিটা করেই সবচেয়ে তৃপ্তি পেয়েছেন।

সে ছবির সৌজন্যে আজীবনের জন্য যিনি ‘চারুলতা’ হয়ে গেলেন, সেই মাধবী মুখোপাধ্যায়ের মুখে ‘বংশী’ নামটা শুনেই ফুটে ওঠে চিলতে হাসি। সিরিয়াল শ্যুটিংয়ের এক ফাঁকে তিনি বলতে থাকেন, ‘‘আরে, ‘চারুলতা’ তো পরে! আমি বংশীদাকে প্রথম দেখি ‘বাইশে শ্রাবণ’ শ্যুটিংয়ের সময়ে। বর্ধমানের মানকরে একটা বাড়িতে আমরা অনেকে মিলে ছিলাম বেশ কিছু দিন। তখন কত আড্ডা, হাসিঠাট্টা। ভারী সুন্দর মানুষ ছিলেন।’’

সবাই জানত, লোকটা এমনিতে স্পষ্টবক্তা, কিন্তু মাটির মানুষ। খুব সহজে মিশতে পারেন, আপন করে নিতে পারেন সকলকে। শুধু কাজের সময়ে গোলমাল হলেই অগ্নিশর্মা!

কৃষ্ণনগরে নদীর ধারে ‘অপুর সংসার’-এর শেষ দৃশ্য তোলা হচ্ছে। বংশী নিজের লাইকা ক্যামেরায় ছবি তুলছেন। মোক্ষম মুহূর্তে সামনে দিয়ে একজন চলে গেলেন। বংশী এত খেপে গেলেন যে, পকেট থেকে কলম তুলে ছুড়ে ফেললেন।

তবে বংশীর একটা বড় দুর্বলতা সকলেই জানত। মানিকের নামে নিন্দেমন্দ সইতে পারেন না। ‘‘আমরা ইচ্ছে করে মানিকদার নামে এটা-সেটা বলে খেপাতাম। ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ কুঁড়েঘরে একটা কুলুঙ্গি ছিল। উনি ঠিক উচ্চারণ করতে পারতেন না, অবাঙালি টানে বলতেন ‘কুলুঙ্গা’। সেই নিয়েও খুব পিছনে লাগা হত,’’ বলেই ঝরঝর করে হেসে ফেলেন ‘চারুলতা’।

সে বছর সত্যজিৎ করছেন ‘দেবী’। অন্য দিকে, মৃণাল সেন হাত দিয়েছেন ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ। পরে তাঁর ‘পুনশ্চ’, ‘প্রতিনিধি’, ‘আকাশকুসুম’, ‘কলকাতা ’৭১’ ছবিতেও কাজ করেছেন বংশী। এই দু’জনেরও বন্ধুত্ব অনেক দিনের। আর তার কেন্দ্রে ছিল হাজরা মোড়ের কাছে ‘প্যারাডাইস কাফে’ নামে একটা চায়ের দোকান। ‘‘সেখানে আমি, ঋত্বিক, তাপস, হৃষীকেশ মুখার্জি, বংশী, নৃপেন গাঙ্গুলি আমরা সবাই দিনে আট ঘণ্টা-দশ ঘণ্টা আড্ডা দিতাম। ছবিতে ঢোকার নানান চেষ্টা করতাম,’’ স্মৃতি হাতড়েছেন মৃণাল সেন। কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন ছিলেন এঁদের বেশির ভাগই। এঁরাই একযোগে সিনে টেকনিশিয়ানস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন গড়ে তোলেন। বংশী প্রথম সহ-সভাপতি। শুধু এই একটা জায়গাতেই তিনি ছিলেন সত্যজিতের ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা।

আসলে শিল্পী সত্তার খোলস ছেড়ে সাধারণ ছাপোষা মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল বংশীর। ‘বাইশে শ্রাবণ’ করার বিশ বছর বাদে মৃণাল এক বার ফের গিয়েছিলেন মানকরের সেই গ্রামে। এক অশীতিপর বৃদ্ধা তাঁকে চিনতে পেরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বংশী কেমন আছে? ওর বাংলা ভাল হয়েছে তো?’ জানতে চাইলেন, ‘বংশী কি এখনও চালকুমড়োর তরকারি ভালবাসে?’

এ হেন একটা লোক কিন্তু কলকাতায় থাকতে পারলেন না। সত্যজিৎ-মৃণালেরা বছরে বড়জোর একটা করে ছবি করতেন। তার বাইরে তরুণ মজুমদার ডেকেছেন চারটে ছবিতে, ‘পলাতক’, ‘আলোর পিপাসা’, ‘একটুকু বাসা’, ‘বালিকা বধূ’। যখন ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বালিকা বধূ’ ধারাবাহিক বেরোচ্ছে, তরুণের মুখে গল্প শুনে বংশীই বলেছিলেন, ‘‘এই ছবিটা আপনাকে করতেই হবে। তা না হলে আমি আর আপনার সঙ্গে কাজ করব না।’’

এ ছাড়া রাজেন তরফদারের ‘অন্তরীক্ষ’, অজয় করের ‘খেলাঘর’, আরও কিছু টুকটাক। এতে কি আর পেট চলে? হলেনই বা ব্যাচেলর!

আসলে সেই সময়ে একটা প্রচার ছিল যে, বংশীকে দিয়ে কাজ করানো মানেই বড় খরচ। ফাঁকিজুকি চলে না। যতক্ষণ নিখুঁত না হচ্ছে, ক্ষান্ত দেবেন না। ফলে সময়ও লাগে অন্যদের চেয়ে বেশি। এই করতে গিয়ে বাজেট ছাড়িয়ে যাচ্ছে বুঝে নিজের দক্ষিণার টাকা কিছুটা ছেড়ে দিয়েছেন, এমনও ঘটেছে। কিন্তু এই পাগলপারা নিষ্ঠার কদর ইন্ডাস্ট্রিতে কম লোকই করতেন। ব্যতিক্রমী কয়েক জন ছাড়া সেট নিয়ে কারও তেমন মাথাব্যথাও ছিল না। টাকাটা বরং তাঁরা স্টারের পিছনে খরচ করবেন, এই ছিল মানসিকতা। বংশীর মতো উঁচু দরের শিল্পী তাঁদের দরকার ছিল না।

১৯৬৮ সালে রিলিজ করল ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। লোকের তাক লেগে গেল। শুন্ডির রাজবাড়ি, হাল্লার রাজবাড়ি— সম্পূর্ণ আলাদা দুই চেহারা, রং, মেজাজ। দেখলেই বোঝা যায়, কোথাকার রাজা কী রকম! লোকে ধন্য-ধন্য করল। কিন্তু তার পরও বংশী টানা প্রায় দু’বছর বসে। শুধু ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ আর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’— শুধুই সত্যজিৎ।

এরই মধ্যে বছর দুই আগে একটা তথ্যচিত্র করেছিলেন বংশী, ‘গ্লিম্পসেস অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’, সেটা জাতীয় পুরস্কার পায়। হরিসাধন দাশগুপ্তের সঙ্গে তথ্যচিত্র করার অভিজ্ঞতা তাঁর ‘পথের পাঁচালী’র আগেই ছিল। পরপর করলেন আরও দু’টো, ‘গঙ্গাসাগর’ আর ‘হ্যাপেনিং ইন কলকাতা’।

এক রকম বাধ্য হয়েই সত্তরের গোড়ায় কলকাতা ছেড়ে বম্বে চলে যেতে হল বংশীকে। কিন্তু সেখানেও মনের মতো কাজ পান না। একমাত্র বাসু চট্টোপাধ্যায় ডেকে কাজ দেন। কুমার সাহনির সঙ্গে করলেন ‘মায়াদর্পণ’। বাকি বেশির ভাগই হাবিজাবি। স্টারের ডেট পেলে হুড়মু়ড় করে সেট খাড়া করতে হয়।

মানিক-মৃণালেরা জানতেন, বম্বে গিয়ে বংশী ভাল নেই। অথচ ফিরতেও পারছেন না কলকাতায়। ছবির সাউন্ড মিক্সিংয়ের জন্য তখন প্রতি বছরই বম্বে যেতেন সত্যজিৎ। হাতে কাজ না থাকলে বংশী এসে পড়ে থাকতেন তাঁদের সঙ্গেই।

এই করেই কাটছিল। ’৭৮ সাল নাগাদ সত্যজিৎ হাত দিলেন ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ী’-তে। তাতে নানা মেজাজের সেট চাই। লেফটেন্যান্ট জেনারেল আউটরামের অফিস, অওধের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের দরবার, অভিজাত মির আর মির্জার ঘরদোর। সোয়াশো বছর আগের সময়টা হুবহু তুলে আনতে হবে। সত্যজিৎ বললেন, ‘বংশী, এটা তুমি ছাড়া হবে না।’

শুরু হল ছুটোছুটি। লখনউ চষে ফেলা হল। শুধু ঘরদোর বানালেই তো হবে না। সেই সঙ্গে সিংহাসন, সাজসজ্জা, কস্টিউম। সেই ছবিতেই প্রথম সহকারী পরিচালক হিসেবে বাবাকে অ্যাসিস্ট করছেন সন্দীপ। তাঁরা কলকাতা থেকে যাচ্ছেন, বংশী আসছেন বম্বে থেকে। চলছে ছবি তোলা, খুঁটিয়ে দেখা, নোট নেওয়া।

থার্টি সিক্স চৌরঙ্গি লেন

ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয় শতরঞ্জের সেট পড়ল। সে জিনিস আগে কেউ দেখেনি কলকাতায়। সাংবাদিক থেকে সিনেমা জগতের প্রচুর মানুষ সেট দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। বংশীর নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। কোথাও ফাঁক থেকে না যায়!

শ্যুটিং শুরু হতে তখন মোটে আর দিন দুই বাকি। দরবারের সেটে একেবারে টঙে উঠে বংশী একটা মোটিফ ফিনিশ করছেন। সত্যজিৎ এসে হাঁক পাড়লেন, ‘‘এই বংশী, তুমি ওখানে কী করছ? অত উঁচুতে ক্যামেরা টিল্ট আপ করলে তো সিলিংও দেখাতে হবে। তুমি তা হলে সিলিংটাও তৈরি করো, আমি আরও দশ দিন শ্যুটিং পিছোই!’’

হাসতে-হাসতে সন্দীপ বলেন, “ব্যস, ওই পর্যন্তই। ঠাট্টার মেজাজে বলা। তার বেশি কখনও নয়। বাবাকে অনেক বার বলতে শুনেছি, ‘ওহ বংশী, ফিল্মের ফাঁকি শেখো! এটা আসবে না ক্যামেরায়, তুমি এত খেটেখুটে তৈরি করছ কেন?’ কিন্তু পুরোটা ফিনিশ না করে বোধহয় ওঁর মন ভরত না!”

সত্যজিৎ-বংশী জুটির এটিই একমাত্র রঙিন ছবি। বছরখানেক পরে মুজফফর আলি যখন ‘উমরাও জান’ করার কথা ভাবছেন, সঙ্গত কারণেই বংশীর নামটা তাঁর মনে এসেছিল। সত্যি বলতে, বহু দিন বাদে সেই সময়টা, ১৯৭৯-৮০, ভাল যাচ্ছিল বংশীর। শ্যাম বেনেগলের সঙ্গে করলেন ‘কলযুগ’ আর ‘আরোহণ’। চিদানন্দ-কন্যা অপর্ণা সেন তাঁর প্রথম ছবি ‘থার্টিসিক্স চৌরঙ্গি লেন’-এর জন্য ডাকলেন বংশীকাকুকেই।

জীবনের সেরা কাজগুলোর জন্য বংশী কিন্তু কোনও বড় পুরস্কার পাননি। তিন বার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, ’৭২ সালে ‘সীমা’, ’৭৬-এ ‘দো ঝুট’ আর ‘চক্র’ ছবির জন্য মৃত্যুর পর ’৮২-তে। সে বছরই শিল্প নির্দেশনায় জাতীয় পুরস্কার পায় ‘উমরাও জান’, পুরস্কৃত হন বংশীর সহ-নির্দেশক মনজুর। পরের বছর মরণোত্তর ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড ব্রিটিশ ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় বংশীকে। মজা করেই সন্দীপ বলেন, “এত নিখুঁত হওয়াই কাল হয়েছিল। সেটকে সেট বলে চেনা যেত না। বিচারকেরাও হয়তো বুঝতে পারেননি সব সময়ে!’’

হাতে কিন্তু আর সময় বিশেষ ছিল না।

বংশীর যে ডায়াবেটিস আছে, সকলেই জানত। কিন্তু হৃদযন্ত্রেও যে গোল পেকেছে, তা বোধহয় কারও জানা ছিল না। নিউইয়র্কেই দাহ সাঙ্গ হয়। চিতাভস্ম পৌঁছে দেওয়া হয় জম্মুতে বংশীর ভাই প্রভাত চন্দ্রগুপ্তের কাছে। পরে তাঁরা এসে বাকি জিনিসপত্রও নিয়ে যান।

এবং এখানেই সন্দীপের বড় আক্ষেপ, ‘‘প্রচুর বই ছিল, প্রচুর ছবি আর নেগেটিভের কালেকশন, চিঠিপত্র, বিশেষত ‘রিভার’-এর সময়কার। রেনোয়া লিখছেন, ল্যুরিয়ে লিখছেন... ওগুলো আর পাওয়া যাবে না। ওঁর একটা ঠিকঠাক আর্কাইভ হতে পারত!’’

তার পরেই সন্দীপের মনে পড়ে যায়, “পথের পাঁচালী-র বেশির ভাগ স্টিল কিন্তু বংশীকাকুরই তোলা। ভাগ্য ভাল, ওগুলো উনি এই বাড়িতেই রেখে গিয়েছিলেন!’’

স্মরণসভায় সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘‘শিল্প নির্দেশনায় বংশীর সমকক্ষ ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আর কেউ হয়েছে বলে মনে হয় না। বংশী ছিল অদ্বিতীয়।’’ নিশ্চেতনের অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার আগে বংশীর শেষ কথা ছিল— ‘‘আয়্যাম সরি।’’

কাকে বললেন? মানিককে? প্ল্যাটফর্মে পড়ে গিয়ে যাঁদের বিরক্ত করলেন, তাঁদের? না কি ফিল্মের দুনিয়াকে? কে জানে!

ঋণ: চিত্রভাষ (নর্থ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির মুখপাত্র), প্রসঙ্গ চলচ্চিত্র (সিনে গিল্ড, বালি’র পত্রিকা), সত্যজিৎ রায়ের My Years With Apu, অরুণকুমার রায়ের ‘শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত’ এবং আনন্দবাজার আর্কাইভস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE