Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বাঙালির ছেলেবেলাটা ভরা আছে লীলাপিসির বর্মি বাক্সে

শিশু সাহিত্যিক লীলা মজুমদারকে ফিরে দেখলেন সুদেষ্ণা বসুশিশু সাহিত্যিক লীলা মজুমদারকে ফিরে দেখলেন সুদেষ্ণা বসু

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৮ ০০:১১
Share: Save:

যে বাঙালির জীবনে উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার নেই, দক্ষিণারঞ্জন, যোগীন্দ্রনাথ, পুণ্যলতা, সুখলতা, লীলারা কেউ নেই, সে বাঙালির কোনও ছেলেবেলাই নেই। লীলা মজুমদার নামটির সঙ্গে শিশু সাহিত্যের বিষয়টি এমন ভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে, তাঁর লেখা ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’, ‘টংলিং’, ‘হলদে পাখির পালক’, ‘গুপীর গুপ্তখাতা’, ‘মাকু’ বাঙালি আজও ভুলতে পারে না। বাঙালির ছেলেবেলাকে তিনি তাঁর সাহিত্য দিয়ে জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে গেঁথে দিয়েছেন। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিশু সাহিত্যিক যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে লীলা মজুমদারের নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত হওয়া উচিত।

তাঁর ‘বদ্যিনাথের বড়ি’ গল্পে আশ্চর্য এক বড়ির অলৌকিক ক্ষমতার কথা বড় হয়েও আমাদের মনে থেকে যায়। কালুর বন্ধু বদ্যিনাথ কতকগুলো সাদা বড়ি এনে যখন বলে, ‘ওগুলো নাকি ছানা বাঁদরের রস দিয়ে তৈরি’, যেহেতু মানুষদের পূর্বপুরুষ বাঁদর ছিল এবং বাঁদরের রক্ত মানুষের রক্তে এখনও মিশে ‘আছেই আছে’, তাই সেই আশ্চর্য বড়ি খেলে তাদের আবার বাঁদর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, ‘ওই একরকম ধাত কিনা’, অবিশ্বাস হয় না। অতএব রোজ পড়াতে আসা মাস্টারের হাত থেকে বাঁচতে এর প্রয়োগ কালুর কাছে বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছিল। সেই বড়ি দেওয়া পান খেয়ে অবশ্য মাস্টারের কিছু হয়েছিল কি না, কালু আর জানতে পারেনি। তিনি অন্য গ্রামের স্কুলে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কালু রাতের অন্ধকারে পাঁচিল থেকে দুটো ল্যাজ ঝুলে থাকতে দেখত।

লীলা মজুমদারের এই দুর্লভ ‘বাল্যদৃষ্টি’র কথা উল্লেখ করে গিয়েছেন রাজশেখর বসু থেকে আরও অনেকেই। এই দৃষ্টির জন্ম হয়েছিল তাঁর শৈশবে, খাসিয়া পাহাড়ের শিলং শহরে। সেখানকার পরিবেশ তাঁকে সহায়তা করেছিল। আরও একটি কারণ অবশ্যই ছিল, সেটি পারিবারিক। বাংলাদেশের শিল্প, সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে যে ক’টি পরিবারের অবদান উল্লেখযোগ্য, তাদের মধ্যে রায়চৌধুরী পরিবার অন্যতম। লীলা মজুমদারের সাহিত্যে যে বাল্যদৃষ্টি, তার সূচনা হয়েছিল উপেন্দ্রকিশোরের ‘সন্দেশ’-এর হাত ধরে। সদ্য ছাপা ‘সন্দেশ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি তিনি উপেন্দ্রকিশোরের হাতেই দেখেছিলেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। সেই স্মৃতি তিনি কোনও দিনও ভুলতে পারেননি। ১২ বছর বয়সে শিলং থেকে কলকাতায় আসার পর সুকুমার রায় তাঁকে দিয়ে জীবনের প্রথম গল্প ‘লক্ষ্মীছেলে’ লিখিয়ে নিয়েছিলেন ‘সন্দেশ’-এর জন্য। বড়দা সুকুমার, বড়দি সুখলতা, মেজদি পুণ্যলতা, মণিদা সুবিনয়ের মতো মানু্ষের প্রভাব ক্রমশ তাঁকে যথার্থ ‘সন্দেশী’ করে তুলেছিল। তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘জ্যাঠামশাইরা, জ্যাঠামশাইয়ের ছেলেমেয়েরা সবাই গল্প লিখতেন, চমৎকার ছবি আঁকতেন। সুখলতাদির পরিদের গল্প পড়ে মুগ্ধ হতাম। ছোটো জ্যাঠা কুলদারঞ্জনের রবিনহুড পড়ে তো প্রায় অজ্ঞান!’

খুব ছোট থেকেই তাঁর চার পাশে গল্পরা ঘুরে বেড়াত। স্কুলের ‘প্রসূন’ পত্রিকায় হাত পাকানোর পালা শুরু হয়েছিল। বাড়িতে বানিয়ে বানিয়ে এমন করে ঘটনার বর্ণনা দিতেন, শুনে মনে হত বুঝি সত্যিই ঘটেছে। তাই নিয়ে মায়ের বকুনিও খেয়েছেন কত বার। কিন্তু বানানো গল্প আর মিথ্যে কথার মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে চেষ্টা করতেন। লিখেছেন, ‘শিলং পাহাড়ে থাকতাম, সরল বনের মধ্যে হাওয়া দিলে সোঁ সোঁ শব্দ হত। ঠিক যেন লুকনো কথা বলে দিচ্ছে। দুটো পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বইলে গোঁ গোঁ শব্দ হত। মনে হত ওইখানে কোনও গোপন জায়গায় শেকল দিয়ে দৈত্য বাঁধা আছে, ছাড়াবার চেষ্টা করছে। পাহাড়ি আয়ারাও গল্প বলত। সে সব দুঃখের গল্প, হারানোর গল্প, না পাওয়ার গল্প, কষ্টের গল্প। শুনে কান্না পেত।’

লীলা মজুমদারের জন্ম ১৯০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তাঁর বাবা প্রমদারঞ্জন রায়ও শিশুদের জন্য লিখতেন। তাঁর লেখা ‘বনের কথা’ ধারাবাহিক ভাবে ‘সন্দেশ’-এ প্রকাশিত হত। মা সুরমা দেবী ছিলেন শান্ত ও বুদ্ধিমতী। লীলারা ছিলেন আট ভাইবোন। প্রভাতরঞ্জন, সুলেখা, লীলা, কল্যাণরঞ্জন, অমিয়রঞ্জন, সরোজরঞ্জন, যতিরঞ্জন ও লতিকা। ভাইবোনেদের প্রত্যেকের জন্ম কলকাতায়।

লীলার জীবনের প্রথম এগারো বছর কেটেছে শিলংয়ে। প্রথমে তাঁরা থাকতেন ‘লাবানপাড়ার ব্রাহ্ম মন্দিরের ওপরে ছোট্ট একটা বাড়িতে’। তার পর চলে যান যে বাড়িতে, ‘তার নিচ দিয়ে কুলকুল করে একটা নদী বয়ে যেত’। সেখান থেকে যে বাড়িতে যান, সেখানেই পাকাপাকি ভাবে থেকেছেন আট বছর। বাড়িটার নাম ছিল ‘হাই উইন্ডস’। ছোটবেলায় লীলা বেশ দুষ্টু ছিলেন। লিখেছেন, ‘মার হাতে চড় কানমলা খাবার গৌরব আমার একার ছিল। লোক আমি ভাল ছিলাম না। আমার কথামতো না চললে দাদাকে পেটাতাম, দিদিকে পেটাতাম... দাদা উলটে মারত আর দিদি ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদত।’

১০০ গড়পার রোডের বাড়িতে ইউ রায় অ্যান্ড কোং-এর ছাপাখানা ও অফিস ছিল। ওই বাড়িই ছিল উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারের আস্তানা। শিলং থেকে এসে লীলার পরিবার প্রথমে সেই বাড়িতে থাকতে শুরু করে। যদিও তার চার বছর আগে উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু জ্যাঠা, কাকা, দাদা, দিদিতে ভরা এই বাড়ির হাওয়ায় সাহিত্য সংস্কৃতির পরিবেশের সঙ্গে ইউ রায়ের ছাপাখানার শব্দ, গন্ধ, ‘সন্দেশ’ পত্রিকা দফতরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড এমন ভাবে মিশে থাকত যে, তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা সহজ ছিল না।

সুকুমার রায় ছিলেন লীলার জীবনে ঈশ্বরতুল্য। লীলাকে সারা জীবন বোধ হয় লালন করেছেন সুকুমারই। মৃত্যুর পরও। সুকুমারের অকালমৃত্যু লীলাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ‘আমার তখন ১৫ বছর বয়স। ম্যাট্রিক ক্লাসে পড়ি... বড়দার ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দেখি সরু একটা নিচু খাটে সাদা চাদরে গা ঢেকে, বুকের উপর হাত দু’খানি জড়ো করে চোখ বুজে তিনি শুয়ে আছেন। তাকের উপর তাঁর রঙের শিশি, গেলাসে দাঁড় করানো অনেকগুলি তুলি রং মাখা, একটা ছোট্ট ন্যাতার পুঁটলি অনাদরে পড়ে আছে। ছেলের পায়ের উপর মুখ গুঁজে জ্যাঠাইমা পড়ে আছেন। খাটের পাশে একটা টুলে বৌঠান দু’হাত জোড় করে চোখ বুজে বসে আছেন। চোখের পাতার তলা দিয়ে অবিরাম ধারায় জল গড়াচ্ছে। মুখখানি পাথর কুঁদে গড়া, ভাবলেশহীন। মনে হল আমারও বুকের মধ্যে কি একটা ভেঙে যাচ্ছে। আর সেখানে দাঁড়াইনি।’

লীলা আদতে সুকুমার রায়কে জেনেছিলেন, ‘সন্দেশ’-এর ভাবনা, আদর্শের মধ্য দিয়ে। কলকাতার পাঠভবন স্কুলের ‘সুকুমার মেলা’য় লীলা এসেছিলেন। এ কালের ‘সন্দেশী’ সুগত রায়ের মনে আছে, “সুকুমার রায় সম্বন্ধে উনি দশ-বারো মিনিটে এমন করে বললেন, যেন মনে হল আস্ত মানুষটিকে চোখের সামনে দেখতে পেলাম। এমনই ছিল তাঁর ভাষার দখল।’’

স্বামী সুধীরকুমার মজুমদার। ছবি: স্বপনকুমার ঘোষ

লীলার কর্মজীবনের শুরু হয় দার্জিলিংয়ে ‘মহারানী গার্লস স্কুল’-এ শিক্ষকতা দিয়ে। এর পর তিনি রবীন্দ্রনাথের ডাকে শান্তিনিকেতনে পড়াতে আসেন ন’মাসের জন্য। তার পর কলকাতার আশুতোষ কলেজের মহিলা বিভাগে শুরু করেন অধ্যাপনা। ১৯৩২ সালে তাঁর বিয়ে হয় হার্ভার্ড ফেরত দন্ত চিকিৎসক সুধীরকুমার মজুমদারের সঙ্গে। এই বিয়ে লীলা নিজের সিদ্ধান্তে করেছিলেন। ব্রাহ্ম-হিন্দুর এই বিয়েকে কেন্দ্র করে ঝড় উঠেছিল তাঁর পরিবারে। গোঁড়া ব্রাহ্ম পিতা প্রমদারঞ্জনের সঙ্গে চিরকালের জন্য বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল। যদিও মা ও ভাইবোনদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অটুট ছিল আজীবন। রবীন্দ্রনাথ নিজে হাজির থেকে এই বিয়ে দিয়েছিলেন।

বিয়ের পর সাংসারিক দায়িত্বের চাপে তাঁর সাহিত্যচর্চা কমে এসেছিল। যে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় মাঝেমাঝে লিখতেন, তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গল্পগুলো মনের মধ্যে ডানা ঝটপট করত, বেরোতে পারত না। তবে শ্বশুরবাড়িতে এসে মনে হয়েছিল ‘নিতান্ত আঘাটায়’ পড়েননি। সঙ্গীত, সাহিত্য, ক্রীড়া জগতের কুশীলবদের সঙ্গে আড্ডা ও আলাপ ক্রমে জমে উঠেছিল। স্বামীর চৌরঙ্গী ম্যানসনের চেম্বার তথা বাড়িতে প্রায়ই রাতে গানের আসর বসত। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গেও যোগাযোগ ঘটেছিল। কিন্তু ‘যে কামারশালায় নতুন দিনের বাংলা সাহিত্যের লোহা পিটিয়ে শক্ত’ করা হচ্ছিল, তার থেকে দূরে রয়েছেন বলে মনে হত। কেবল ‘স্ফুলিঙ্গ ছাড়া আর কিছুই দেখার’ সুযোগ পাচ্ছেন না যেন। সমবয়সি অচিন্ত্যকুমার, প্রেমেন্দ্র, বুদ্ধদেব, আশাপূর্ণা প্রমুখের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। বন্ধু বুদ্ধদেবের তাড়নায় এই বাড়িতে বসেই ‘বৈশাখী’ পত্রিকার জন্য প্রথম বড়দের গল্প ‘সোনালি রুপালি’ লিখেছিলেন। তবে দুই সন্তানের জন্ম তাঁর জীবনে এমন এক পূর্ণতা এনে দিয়েছিল যে, খেদের জায়গা তেমন ভাবে তৈরি হয়নি। ১৯৩৪ সালে জন্ম তাঁর প্রথম সন্তান রঞ্জনের আর তার চার বছর পর ১৯৩৮ সালে জন্মায় মেয়ে কমলা।

ছেলে ডা. রঞ্জন মজুমদারের মনে পড়ে, “যখন স্কুলে পড়ি, সেই সময় প্রথম মায়ের বই বেরোল ‘বদ্যিনাথের বড়ি’। তখন আমার সাত বছর বয়স। আমার বোন পড়ত ডায়াসেশনে। আমি বাড়ি থেকে ট্রামে ভবানীপুর এসে বেলতলায় আমার স্কুল বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট অবধি হেঁটে যেতাম। স্কুলে বেরোনোর সময় তাড়াহুড়ো করে মায়ের মেখে দেওয়া গলা ভাত, আলু সিদ্ধ, ডাল সিদ্ধ পেট ভরে খেয়ে যেতাম। হাঁটতে গেলে পেটে ব্যথা করত। সেই ব্যথাটা আজও মনে আছে। বিকেলবেলা কাজের লোক গিয়ে আমাকে নিয়ে আসত। এই অভ্যেসেরই বদল ঘটেছিল এক দিন। সে দিন হঠাৎ তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেল। আমি একা ফিরেছিলাম। স্কুল থেকে ফিরলে মা-ই দরজা খুলতেন। সে দিন অন্য রকম হল, বাড়ি ফিরে দেখি মা নেই! শুনলাম রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন, মা তাই জোড়াসাঁকোয় গিয়েছেন।”

সুকুমার রায়ের মতো রবীন্দ্রনাথও ছিলেন লীলার জীবনে বিরাট নির্ভরতার মানুষ। তাঁর অটোগ্রাফের খাতায় রবীন্দ্রনাথ যেন তাঁকে জীবনের নির্দেশ দিয়েই লিখেছিলেন, ‘পারিস যদি প্রেমের আখর, রাখিস জীবন মাঝে।’ সুকুমারের মতোই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মুহূর্তও লীলা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন তাঁর লেখায়।

রঞ্জনবাবুর কথায়, “মা ছিলেন ইউনিক একজন মানুষ। বাবা তো শুধু টাকা দিয়েই নিশ্চিন্ত। মা সংসারের পুরো ঝক্কিটা একা সামলাতেন। ’৪২-এ কলকাতায় বোমা পড়ল। মা আমাদের নিয়ে চলে গেলেন কৃষ্ণনগর। বাবা থেকে গিয়েছিলেন চেম্বার ছিল বলে। আমাদের স্কুল বন্ধ। কৃষ্ণনগরে একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। ওখানে গিয়ে আমার আর বোনের খুব অসুখ করত। মা সব সামলাতেন।’’

তারই মধ্যে ‘মৌচাক’, ‘রামধনু’, ‘রংমশাল’ পত্রিকায় ছোটদের জন্য ও ‘বৈশাখী’, ‘পরিচয়’ পত্রিকায় বড়দের জন্য গল্প লিখে গিয়েছেন অনিয়মিত ভাবে। যদিও কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছেন, “ও সব ছোটদের জন্য আজগুবি লেখা বন্ধ করো এক্ষুনি,” তবু ‘বদ্যিনাথের বড়ি’ বেশ নাম করে ফেলেছিল। পারিবারিক সমস্যা ও কাজের চাপে সাহিত্যচর্চা তেমন ভাবে এগোচ্ছিল না। কারণ তাঁর মনে হত, ‘সংসারটা বাস্তবিক একটা ইয়ে’। তবে ‘মাঝেমাঝে হঠাৎ একটা গোটা গল্প একেবারে তৈরি হয়ে আমার কলমের আগায় ছাড়া পাবার জন্য আঁকু-পাঁকু করত...বুঝতাম সব নষ্ট হয়ে যায়নি।’

লীলার স্বামীও ছিলেন ঘোর সংসারী। পুত্র রঞ্জনের স্মৃতিতে আছে, “রবিবার সকালে বাবা যেতেন যদুবাবুর বাজারে। পরনে শর্টস আর বাজার যাওয়ার জন্য বিশেষ জুতো। অনেক সময়ই আমি থাকতাম ড্রাইভারের ভূমিকায়। বাবার হাতে থাকত মায়ের করে দেওয়া লম্বা একটা লিস্ট। বাবার নির্দিষ্ট কিছু দোকান ছিল, যেখান থেকে সব কেনাকাটা করতেন। কিন্তু তাও প্রথমে সারা বাজারটা এক বার পাক মারবেন। ফেরার পর মা লিস্ট মিলিয়ে বাজারের থলি নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতেন। তার পর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে তরকারি কোটার পর্ব শুরু হত। রান্নার লোক মাকে সাহায্য করত। রবিবারের খাওয়াটা টিপিক্যাল বাটি সাজিয়ে, পাত পেড়ে... সারা জীবন বাবাকে দেখেছি কাঁটা দিয়ে খেতেন। ইলিশ মাছ পর্যন্ত। কেবল রবিবারটা হাত দিয়ে খেতেন। মা দেশি-বিদেশি সব রান্নাই চমৎকার করতেন। মা ‘রান্নার বই’ লিখেছিলেন অনেক পরে, বোন কমলার সঙ্গে।”

ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে

এরই মধ্যে এক দিন হঠাৎ কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এলেন তাঁর ‘রংমশাল’ পত্রিকার জন্য একটি কিশোর উপন্যাস লেখার অনুরোধ নিয়ে। তখন লীলার মনে হল, ‘এ আবার কেমন কথা? উপন্যাস লিখেছি নাকি কখনো?’ তবু রাতে সেই কথা ভাবতে ভাবতে ঝপ করে একটা গল্প জন্মাল। লেখা হয়েছিল ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’। এর কয়েক বছর পরে ১৯৪৭ সালে এক দিন মেট্রো সিনেমার সামনে ‘মানিক অর্থাৎ সত্যজিৎ বলল, “আমায় তোমার সব ছোট গল্পগুলো দেবে? বই হবে।” ‘বদ্যিনাথের বড়ি’র সব গল্প ও আরো কিছু গল্প নিয়ে গেল মানিক। সিগনেট প্রেস থেকে বেরিয়েছিল ‘দিনদুপুরে’ বইটি ১৯৪৮ সালে। আর ঐ একটি বই দিয়েই চিরকালের মতো বাংলা সাহিত্যের বিপদসঙ্কুল পাথুরে পথে সেই যে একটু দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে গেলাম, তার থেকে আর নামিনি।’

এই সময়পর্বে তাঁর জীবনে নেমে এসেছিল মৃত্যুর পরম্পরা। ছোট জ্যাঠামশায় কুলদারঞ্জন, বাবা প্রমদারঞ্জন, তাঁর প্রিয় মণিদা সুবিনয় ও মা সুরমাকে হারান পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে। তবু জীবনকে থামতে দেননি। অসীম ছিল তাঁর উদ্যম। রঞ্জন জানালেন, “বালিগঞ্জের বাড়িটা মা তৈরি করিয়েছেন। শান্তিনিকেতনে আমাদের যে বাড়ি ছিল, সেটাও একা দাঁড়িয়ে থেকে তৈরি করিয়েছেন মা। ১৯৫৪ সাল সেটা। মনে আছে, কলকাতা থেকে ট্রেনের সাধারণ কম্পার্টমেন্টে জানালার ফ্রেম, গ্রিল— এ সব নিয়ে গিয়েছেন। ওই সব ভারী ভারী জিনিস কী করে যে উনি একা নিয়ে যেতেন, আজ ভাবলে অবাক হই।” শান্তিনিকেতনের এই বাড়ির নামকরণের মধ্যে লীলা ধরে রেখেছিলেন তাঁর গোটা পরিবারকে। সুধীর, রঞ্জন, কমলা ও লীলার আদ্য অক্ষর সাজিয়ে সে বাড়ির নাম হয়েছিল ‘সুরকলি’।

১৯৫৬ সালে লীলা কলকাতা বেতারের চাকরিতে যোগ দেন। আর সূচনা হয় তাঁর জীবনের সবচেয়ে সফল পর্বের। পরবর্তী সাত বছর আকাশবাণীর কর্মজীবনে এক দিকে যেমন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, প্রেমেন্দ্র, শৈলজানন্দর মতো ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কাজ করার আনন্দ পেয়েছিলেন, তেমনই ‘মহিলা মহল’ অনুষ্ঠানে তাঁর ‘ঠাকুমার চিঠি’, ‘ইষ্ট কুটুম’-এর গল্প যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘গল্পদাদুর আসর’-এ পঠিত হয় ‘হলদে পাখির পালক’ ও ‘টাকার গাছ’। অভিনীত হয় ‘বক বধ পালা’ নাটক। লেখেন ‘লঙ্কাদহন পালা’। বেতারের কাজকর্ম সব সময় পছন্দ না হলেও এই মাধ্যমটি লীলা মজুমদারকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলি। ছোট গল্প, নাটক, উপকথা, জীবনী সাহিত্য ও আরও অনেক কিছু দিয়ে তিনি বাঙলির ছেলেবেলাকে ভরিয়ে দেন।

ডায়েরির ছেঁড়া পাতা

তাঁর ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরাও ছিল তাঁর লেখার ভক্ত। রঞ্জন জানালেন, “সকাল সাড়ে নটা-দশটা বাজলেই মায়ের ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যেত। কারও প্রবেশাধিকার থাকত না।” পুত্রবধূ স্বপ্না খেয়াল করতেন লীলা চিন্তা করার সময় সেলাই করতে ভালবাসতেন। “হাতের কাছে যা পেতেন তার ধারটা মুড়ে সেলাই করতে শুরু করে দিতেন। বলতেন, ‘আই স্পিন দ্য স্টোরি।’ মনের দিক দিয়েও খুবই আধুনিক ছিলেন মা। আমাদের বিয়ের পর বলেছিলেন, ‘তুই আমার ভাঙা নৌকাটা জোড়া লাগালি,’ যা আজও আমি আগলে রেখেছি মনের গভীরে।”

১৯৬১ সালটা লীলা মজুমদারের জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য বছর। সে বছর রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালন হচ্ছিল সারা দেশ জুড়ে। আকাশবাণীতেও কর্মব্যস্ততা। আকাশবাণীর হয়ে শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের প্রযোজক নিযুক্ত হন অমল হোম। লীলার ‘ননীকাকা’। কিন্তু কাজ আরম্ভ হওয়ার পর অমল হোম হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এর ফলে লীলাকে তাঁর কাজ শেষ করার জন্য নিযুক্ত করা হয়। দ্বিতীয় ঘটনাটি হল, সত্যজিতের চেষ্টায় ‘সন্দেশ’-এর প্রকাশ পাওয়া। ‘সন্দেশ’কে ফিরে পেয়ে লীলা যেন নতুন করে বেঁচে উঠেছিলেন। পত্রিকাটির যৌথ সম্পাদিকাও হন। লিখতে শুরু করেন তাঁর অন্যবদ্য কিশোর উপন্যাস ‘টংলিং’। তার পর ক্রমশ লিখতে থাকেন ‘হট্টমালার দেশে’, ‘বালী-সুগ্রীব কথন’, ‘নেপোর বই’।

সম্পাদক হিসেবে লীলা ছিলেন কড়া ধাতের। ‘সন্দেশ’-এর আর এক সম্পাদক নলিনী দাশের ছেলে অমিতানন্দ জানালেন, “এমন কিছু ‘সন্দেশ’-এ উনি ছাপতে দিতেন না, যা কোনও ভাবে ছোটদের মনে খারাপ প্রভাব ফেলে। এক বার একটা লেখায় ছিল এক জন দোকানদার অসৎ উপায়ে মুনাফা করছে। সেই লেখাটা কম্পোজ হয়ে নেগেটিভ পর্যন্ত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু উনি দেখার পর বললেন, এ লেখা চলবে না।”

১৯৬৭-তে ছোট ভাই যতিরঞ্জনের অকালমৃত্যুর অভিঘাতে গজেন্দ্রনাথ মিত্রর পরামর্শে লিখতে শুরু করেন তাঁর প্রথম আত্মজীবনী ‘আর কোনখানে’। তারও দশ বছর বাদে ১৯৭৭-এ মণীন্দ্র রায়ের অনুরোধে ‘অমৃত’ পত্রিকার জন্য লেখেন ‘পাকদণ্ডী’। তবে শতায়ু লীলা সারা জীবন ধরে যত লেখা লিখেছেন, তার সব ক’টির হদিস পাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন তাঁর জীবনীকার, ভাইপো প্রসাদরঞ্জন রায়। তাঁর হিসেব মতো লীলা মজুমদারের মোট ২৮৯টি বইয়ের উল্লেখ সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি অপ্রকাশিত এবং এর বাইরেও দু’-একটি বই থাকা সম্ভব।

লীলা পুরস্কার পেয়েছেন অঢেল। ভারত সরকারের শিশু সাহিত্য পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, ভুবনেশ্বরী পদক, ভুবনমোহিনী দাসী সুবর্ণ পদক, দেশিকোত্তম, ডি-লিট প্রমুখ।

প্রথম অসুস্থতার খবর জানিয়ে চিঠি

১৯৭৫ সাল থেকে তিনি পাকাপাকি ভাবে শান্তিনিকেতনে থাকতে শুরু করেন। শিলংয়ে শৈশব কাটিয়ে বার্ধক্যের শান্তিনিকেতন যেন তাঁর জীবনের এক বৃত্তকে সম্পূর্ণ করেছিল। এখানে এসে ফিরে পেয়েছিলেন ছেলেবেলার বন্ধু পূর্ণিমা ঠাকুরকে। পূর্ণিমা ঠাকুরের ছেলে সুপ্রিয় ও মেয়ে ঈশিতা জানালেন, “যত দিন মা ছিলেন, লীলামাসির সঙ্গে যোগাযোগ কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। এখানে চলে আসার পর তো মা প্রায়ই যেতেন ওঁর বাড়িতে। ওঁর নতুন বই বেরলেই আমাদের দিতেন।” সুপ্রিয় ঠাকুর যখন পাঠভবনে কাজ নিলেন, খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন তাঁর লীলামাসি। ‘সন্দেশ’-এর জন্য এক বার গল্পও লিখিয়ে নিয়েছিলেন তাঁকে দিয়ে।

শান্তিনিকেতনের স্থানীয় মানুষ, কর্মী, ছাত্র, অধ্যাপক থেকে উপাচার্য, প্রখ্যাত কবি, অভিনেতা থেকে গায়িকা সকলের আনাগোনা ছিল তাঁর বাড়িতে। ওই আড্ডাখানা থেকে তিনি ‘সন্দেশ’-এর জন্য নতুন লেখকদের খুঁজে বের করতেন। আর ছিলেন যিনি, তাঁকে লীলা ডাকতেন ‘নো প্রবলেম দাদা’ বলে। তিনি হলেন সাংবাদিক ও বিশ্বভারতীর কর্মী স্বপনকুমার ঘোষ। তাঁকে দিয়েও পুরনো দিনের খেলোয়াড়দের নিয়ে একটা সিরিজ লিখিয়েছিলেন তিনি ‘সন্দেশ’-এ। “এই লেখা বাবদ কখনও পাঁচ, দশ, পনেরো টাকা পেতাম। মানি অর্ডারে টাকাটা আসত। এক বার মাকে ওই টাকা দিয়ে একটা মুগার চাদর কিনে দিয়েছিলাম। সেটা জেনে সুধীরদা বলেছিলেন, ‘তুই অনেক ভাগ্যবান রে। আমি আমার মাকে কখনও সে ভাবে কিছু দিতে পারিনি’।
একটা সময় খুব কষ্ট করে বড় হয়েছিলেন সুধীরদা।”

‘পাকদণ্ডী’ বইয়ের শেষে লীলা ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, ‘বিধাতা যতদিন রাখেন, যেন কাজ করে যেতে পারি আর যখন ডাক দেবেন, সব ছেড়েছুড়ে কলম নামিয়ে যেন চলে যেতে পারি’। বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। পুত্র রঞ্জনের কাছে শান্তিনিকেতন থেকে ফোনে প্রথম খবরটা দিয়েছিলেন স্বপনই। “মা বাথরুমে পড়ে গিয়েছেন। এই ঘটনার তিন-চার মাস পর দেখা গেল, মা লিখতে পারছেন না। লিখতে গেলে পেনটা হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা জানালেন, হাই প্রেশার, মাথায় ব্লাড ক্লট। চিকিৎসায় কিছুটা ভাল হয়ে বাড়ি ফিরে এলেও, আবার পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙেন। সেটাও ভাল হতে না হতেই হার্ট অ্যাটাক হয়। ক্রমশ অবস্থা এমন হয় যে কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়ে আসে। কাউকে চিনতে পারতেন না।”

শতবর্ষে পা দিলেও দীর্ঘ রোগভোগের পর প্রায় বন্দি জীবনযাপন করে লীলা মজুমদার আমাদের ছেড়ে চলে যান ৫ এপ্রিল, ২০০৭। বাঙালি কিন্তু চায়নি তাঁর এই প্রস্থান। কবির ভাষায় তাদের মনের কথা আজও প্রতিধ্বনিত হয়, “ও লীলাদি কথা রাখুন/
আরও অনেক বছর থাকুন/সকল জনার সঙ্গে মিশে/নইলে আমরা বাঁচি কীসে!”

ঋণ: প্রসাদরঞ্জন রায়, আনন্দবাজার আর্কাইভ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE