বর্ষার ঠান্ডা আমেজে সুপের জবাব নেই। সারা দিনের ক্লান্তির পরে এক বাটি সুপ পেলে মন জুড়িয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাটির বদলে যদি সুপ দেওয়া হয় গ্লাসে, তা হলে কি সেই সুপ খাওয়ার কোনও সুখ খুঁজে পাওয়া যাবে? বোল থেকে ঘন তরল চামচে করে তুলে নেওয়ার যে মজা, তা কোনও ভাবেই গ্লাসে চুমুক দিয়ে খাওয়ার মাঝে নেই। এখানেই বদলে যায় খাবার পরিবেশন করার ধারণা। যেমন পাত্রে যে খাবার পরিবেশন করা যায়, তা যদি না দেওয়া হত, তা হলে থালা-বাটি-গ্লাস ইত্যাদির হাজারো রকমফেরই হত না! তাই রান্নার পরে খাবার পরিবেশন করে অতিথি বা প্রিয়জনের সামনে তুলে ধরাটা রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। সেই শিল্পকে আরও সূক্ষ্ম করে তুলতে দরকার অভ্যেস ও মননের।
প্রাথমিক পাঠ
কেমন ধরনের খাবার পরিবেশন করবেন, সেটা জেনে নেওয়া জরুরি। তবেই করা যাবে সঠিক পাত্রের নির্বাচন। অর্থাৎ যে প্লেটে বাদশাহী পোলাও রাখবেন, সেই একই প্লেট নিশ্চয়ই ব্যবহার করবেন না স্টেক রাখার জন্য!
পাত্র, রং ও মেটিরিয়াল
বাঙালি ব্যঞ্জন, চাইনিজ় কিংবা কন্টিনেন্টাল, কেমন ধরনের খাবার পরিবেশন করছেন, তা জেনে পাত্র বাছাই জরুরি। সেই ভেবে বাছুন থালা, বাটির আকার। আবার সেরামিক, গ্লাস, পোড়া মাটি, চিনে মাটি, মেলামাইন, কাঠ বা বাঁশ— কী ধরনের পাত্রে কী খেতে দিচ্ছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনও কুইজ়িনেই সেরামিকের বড্ড কদর। আর রঙের ক্ষেত্রে সাদার কদর সর্বজনীন। কারণ, সাদা রঙের পাত্র কনট্রাস্ট তৈরিতে সাহায্য করে। তাই সাদা পাত্রে লাল রঙের রোগন জোশ কিংবা হলদেটে মাস্টার্ড সস দুটোই সমান মানাবে।
অন্য ভাবে দেখার পালা সাধারণ জিনিসকেই অসাধারণ করে তুলতে পারে পরিবেশন। তবে পরিবেশনের ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, কোন পদ কিসের সঙ্গে মানায় ভাল। সন্ধেবেলা বাড়িতে আসা অতিথিকে শিঙাড়া দিতেই পারেন। তা হলে প্লেট নয়, বাছুন বেতের ছোট ঝুড়ি বা শ্যালো বোল। ট্রে-র এক দিকে ঝুড়ি বা বাটি ভর্তি শিঙা়ড়া, পাশে থাকুক ছোট ছোট প্লেট, ডয়েলি পেপার এবং টং। অতিথিকে যেন শিঙা়ড়া হাতে করে তুলতে না হয়। ছোট বাটিতে বাহারি ডিপ দিতে ভুলবেন না।
• সাধারণ লুচি আর আলুর তরকারি দিন অন্য ভাবে। লম্বাটে প্লেটের উপরে সমান দূরত্বে কয়েকটি লুচি রাখুন। প্রত্যেক লুচির উপরে সাদা আলুর তরকারি দিন টপিং হিসেবে। রং যোগ করতে প্রত্যেক টপিংয়ের উপরে শুকনো লঙ্কা দিতে পারেন। আবার বেতের ঝুড়িতেও আলগা করে সাজিয়ে রাখতে পারেন ফুলকো লুচি। তা হলে পাশের মাঝারি বাটিতে থাকুক তরকারি এবং তা তোলার জন্য সুন্দর হাতা বা সার্ভিং স্পুন। থাক ছোট ছোট থালা ও বাটি রাখুন, লুচি ও তরকারি তুলে খাওয়ার জন্য।
• ফুচকার পরিবেশনে ছোট ছোট শট গ্লাসে রাখুন তেঁতুলগোলা জল। প্রত্যেক গ্লাসের উপরে আলুর পুরভরা একটি করে ফুচকা। উপরে থাক ধনেপাতার কুচি।
• বাড়িতে এগ রোল পরিবেশন করতে গেলে একঘেয়েমি দূর করতে ছোট ছোট ও গোলাকার রোল কেটে চৌকো প্লেটে পরিবেশন করুন। প্রতি টুকরোর উপরে সস দিন। পাশে রাখুন এক টুকরো পাতিলেবু।
• চা দেওয়ার জন্য প্রথাগত কাপ-প্লেটের থেকে বেরিয়ে আসুন। ছোট ছোট চাইনিজ় বোল রাখুন বাহারি কোস্টারের উপরে। কেটলি থেকে চা ঢালুন সেই বোলে। কেটলি ঢেকে রাখুন টি কোজ়ি দিয়ে।
• পিৎজ়া পরিবেশন করতে গেলে অবশ্যই থাকুক কাঠের পিৎজ়া প্লেট। ব্রেডের ক্ষেত্রেও তা করতে পারেন।
• শরবত গ্লাসের ভিতরে ঢেলে উপরে চাপা দিন কুরুশে বোনা কাপড়। ব্যবহার করতে পারেন পাথরের গ্লাসও। মকটেলের ক্ষেত্রে ব্যবহার করুন মেসন জার।
• সাদা প্লেটের উপরে ভাত না রেখে কলাপাতা কেটে নিন থালার আকারে। প্লেটের উপরে সেই সবুজ কলাপাতা রেখে তার উপরে ভাত পরিবেশন করুন। ভাতের উপরে গন্ধরাজ লেবু ও লঙ্কা রাখতে ভুলবেন না। পোলাও বা বিরিয়ানি পরিবেশন করতে রাখতে পারেন হান্ডি কিংবা তামার সুদৃশ্য হাঁড়ি।
• বাড়িতে অনেক অতিথি এলে আলাদা পরিবেশন না করে বুফের ব্যবস্থা করতে পারেন। টেবিলের উপরে রানার রেখে মাঝে পরপর ক্রকারিতে সাজিয়ে রাখুন নানা পদ।
• রুটির জন্য ক্যাসারোল নয়, ব্যবহার করুন ঝুড়ি। বেতের ঝুড়ির মধ্যে পাতলা সুতির কাপড় রাখুন। তার মাঝে গরম রুটিগুলো রেখে কাপড়ের মুখ বেঁধে রাখুন।
• অল্প পরিমাণে ফ্রায়েড রাইস আর মাছ, চিকেনের পদ থাকলে থালা ব্যবহার না করে নিন একটি বড় বাটি। শ্যালো বোলের মাঝে অর্ধেক থাকুক রাইস, বাকি অর্ধেক জুড়ে সাইড ডিশ। পাশে স্যালাড। বাটির উপরে চপস্টিক বা কাঁটা রাখুন।
• যে কোনও পকোড়া বা ফ্রিটার্স পরিবেশন করতে ব্যবহার করুন শট গ্লাস। প্রত্যেক গ্লাসের ভিতরে প্রথমে ডিপ বা সস দিন। তার উপরে গেঁথে দিন একটি করে চপ বা ফ্রিটার্স। উপরে থাক পেঁয়াজের রিং ও পাতিলেবুর টুকরো।
• জিলিপি পরিবেশন করতে গেলে একটি ব়ড় প্লেটে সাজিয়ে রাখুন গরম জিলিপি। পাশের বাটিতে থাক ঘন রাবড়ি বা কয়েক স্কুপ আইসক্রিম। ঘরে পাতা ঠান্ডা দইও দিতে পারেন। টংয়ের সাহায্যে জিলিপি তুলে উপরে চামচে করে দিন দই, রাবড়ি বা আইসক্রিম।
• কেক পরিবেশনের ক্ষেত্রে যে আকারের কেক, টিসু পেপার মুড়ে রাখুন অন্য আকারে। অর্থাৎ চৌকো ব্রাউনির নীচে থাক ত্রিকোণ টিসু। কেটে কেটে প্লেটে তুলে দেওয়ার জন্য অবশ্যই টং ব্যবহার করুন।
• আইসক্রিম পরিবেশনের সময়ে ড্রাই ফ্রুটস, চকলেট সস বা কোকো পাউডার ছড়িয়ে দিতে পারেন। আইসক্রিমের বাটির নীচে অবশ্যই টিসু পেপার রাখবেন। ঘরোয়া তাপমাত্রায় এসে বাটির গায়ে জমা জল টিসু পেপার শোষণ করে নেবে।
• খাওয়ার শেষে মুখশুদ্ধির জন্য কাঠের ট্রেতে একটি মাঝারি প্লেটের উপরে ছোট ছোট বাটিতে জোয়ান, মশলা, এলাচ, লবঙ্গ রাখুন।
অতিথি আপ্যায়ন প্রাথমিক শর্তই হল ভাল রান্না। আবার খাবার পরিবেশন করার মধ্যেই ফুটে ওঠে আপনার রুচি। এখানে রইল কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। আপনার নিজস্ব উদ্ভাবনী গুণেই এতে যোগ করতে পারেন অনন্য মাত্রা।
খাবারের ছবি: চন্দ্রিমা সরকার। মডেল: হিয়া; ছবি: দেবর্ষি সরকার; মেকআপ: প্রিয়া গুপ্ত; পোশাক: আনোখি, ফোরাম; লোকেশন ও ফুড পার্টনার: দ্য ওয়াল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy