কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়।
আগামী ১৮ জুলাই তাঁর জন্মদিন। এ দেশের প্রথম মহিলা স্নাতক ও ডাক্তারের। তিনি কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী, বিদুষী এই মহিলাকে আধুনিক সময় কতটা মনে রেখেছে! অথচ কী দৃপ্ত পদক্ষেপে, অসম্ভবের বেড়া টপকে তিনি এ দেশের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েটের শিরোপা পান ১৮৮২ সালে। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় তিনিই প্রথম মহিলা ডাক্তার, যিনি ডাক্তারি শাস্ত্রের তিন-তিনটি বিলিতি ডিগ্রি লাভ করেন! একবার ফিরে দেখা যাক অনমনীয় এই মহিলার সেই মহৎ কীর্তি।
কাদম্বিনীর জন্ম হয় ১৮৬১ সালে। তাঁর বাবা ব্রজকিশোর বসু ছিলেন ভাগলপুর স্কুলের হেডমাস্টার। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম এবং নারীশিক্ষায় অত্যন্ত উৎসাহী। সেখানে তিনি নারীমুক্তির জন্য ‘ভাগলপুর মহিলা সমিতি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি মেয়েকে ভাগলপুর থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। তৎকালীন সমাজ নারীশিক্ষাকে মোটেই সুনজরে দেখেনি। কিন্তু তেজি কাদম্বিনী সেই চোখরাঙানিকে অবজ্ঞা করে ১৮৭৩ সালে ভর্তি হন কলকাতার হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে। সেই বছরই স্কুলটি স্থাপিত হয়েছিল (পরবর্তী কালে স্কুলটির নাম হয় বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়)। আর সেখান থেকেই ১৮৭৮ সালে তিনি এন্ট্রান্স পাশ করেন। তার পর ভর্তি হন বেথুন কলেজে। সেখানে পড়াশোনা করেন বিজ্ঞান নিয়ে। স্নাতক হন ১৮৮২ সালে। তাঁরই সঙ্গে গ্র্যাজুয়েট হন আরও এক বাঙালি মহিলা চন্দ্রমুখী বসু। এই দুই কৃতী মহিলাই প্রথম ভারতীয় নারী, যাঁরা গ্র্যাজুয়েট হওয়ার দুর্লভ সম্মান অর্জন করতে পেরেছিলেন।
স্নাতক হওয়ার পর ডাক্তারি পড়ার জন্য মনস্থির করেন কাদম্বিনী। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। কলকাতার অভিজাত সমাজ নানাভাবে তাঁকে ব্যঙ্গ করতে শুরু করে। তিনি যাতে ডাক্তারি পড়তে না পারেন, চলল তার জন্য নানা অপচেষ্টাও। ছাড়ার পাত্রী ছিলেন না কাদম্বিনীও। আবার সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৮৮২ সালে ভর্তি হন মেডিক্যাল কলেজে। তখন শুধু রক্ষণশীল সমাজই নয়, তাঁর বিরোধিতা করতে থাকে মেডিক্যাল কলেজের টিচিং স্টাফও। বঙ্গবাসী কাগজে তাঁর মাথা নত করে দেওয়ার জন্য একটি কার্টুন প্রকাশিত হয়, যাতে দেখানো হয়েছিল, কাদম্বিনী তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাকে দড়ি বেঁধে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। তার নীচে লেখা ছিল কুরুচিকর নানা মন্তব্য।
বঙ্গবাসী কাগজের সম্পাদক মহেন্দ্রলাল পালের এহেন অসভ্যতাকে মোটেই প্রশ্রয় দেননি কাদম্বিনীদেবী বা তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। আদালতে অভিযোগ জানান তাঁরা। বিচারে মহেন্দ্রবাবুর ছ’মাসের জেল এবং একশো টাকা জরিমানা হয়। একটি মেয়ের এ হেন সাহস রীতিমত তোলপাড় ফেলে দেয় সমাজে।
কাদম্বিনী ডাক্তারি পাশ করেন ১৮৮৬ সালে। তিনি এবং আনন্দী গোপাল জোশী প্রথম ভারতীয় মহিলা ডাক্তার, যাঁরা ওয়েস্টার্ন মেডিসিন নিয়ে প্র্যাকটিস করার যোগ্যতা অর্জন করেন। এর পর কাদম্বিনী ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন এবং এলআরসিএস এবং জিএফপিএস ডিগ্রি লাভ করেন। তিনিই
ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক, যিনি ডাক্তারি শাস্ত্রের একাধিক বিদেশি ডিগ্রি অর্জনের দুর্লভ দক্ষতা দেখান।
বিলেত থেকে ফিরে জনসেবায় মন দেন বিদুষী এবং অকুতোভয় এই নারী। চিকিৎসা করার জন্য ছুটে যেতেন গ্রামান্তরে। পাশাপাশি যোগ দেন রাজনীতিতেও। ১৮৮৯ সালে তিনি এবং স্বর্ণকুমারী বসু যুগ্মভাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেন। সেই সময় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় অ্যানি বেসান্তের। যোগ দেন স্বাধীনতা আন্দোলনে।
কিন্তু অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে শরীর আর তাঁর সঙ্গ দিচ্ছিল না। অবশেষে ১৯২৩ সালের ৩ অক্টোবর, জরুরি কয়েকটি অপারেশন সেরে সন্ধেয় বাড়ি ফেরেন তিনি। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে ক্লান্ত দেহে স্নানঘরে ঢোকেন। সেখানেই সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়। আর চোখ খোলেননি কাদম্বিনী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy