Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আপসহীন এক মানবতাবাদী

সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষের দৃষ্টি ছিল অন্তর্ভেদী, সেই দেখাই তাঁর লেখাকে দিয়েছে বাড়তি সমীহ। তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বৃত্তে ছিলেন সমাজের বিশিষ্টরা। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ক তাঁর সাংবাদিক সত্তাকে কখনও আচ্ছন্ন করেনি। লিখেছেন দেবাশিস ভট্টাচার্যসাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষের দৃষ্টি ছিল অন্তর্ভেদী, সেই দেখাই তাঁর লেখাকে দিয়েছে বাড়তি সমীহ। তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বৃত্তে ছিলেন সমাজের বিশিষ্টরা। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ক তাঁর সাংবাদিক সত্তাকে কখনও আচ্ছন্ন করেনি। লিখেছেন দেবাশিস ভট্টাচার্য

গৌরকিশোর ঘোষ।

গৌরকিশোর ঘোষ।

শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৭ ০৮:১০
Share: Save:

নিউজরুমে বাঁদিক ঘেঁষে পরপর কয়েকটি কিউবিকল। তারই প্রথমটিতে তিনি। বাংলা টাইপরাইটারে এক আঙুলে খটখট শব্দ তুলে টাইপ করছেন। ঠোঁটে চুরুট ঝোলানো। যতক্ষণ লেখা চলবে ততক্ষণ ঘরে প্রবেশ নিষেধ। কাজ শেষ হলেই ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে টেবিলের কাছে দাঁড়াবেন গৌড়ানন্দ। বলবেন, ‘‘আজ কী লিখলাম জানিস তো...’’ আনন্দবাজারে তখন বেরোত

তাঁর সাপ্তাহিক কলাম ‘গৌড়ানন্দ কবি ভনে’।

নিজেকে এমন ভাবেই সহজ করে নিতে পারতেন গৌরকিশোর ঘোষ। বয়স বা পদের গুরু-দূরত্ব তাঁকে কোনও দিন অনুজদের কাছে অচেনা করে রাখেনি। আনন্দবাজারে চাকরি করতে এসে গৌরদাকে কাছের মানুষ ভাবতেও তাই সময় লাগেনি। হাফ পাঞ্জাবি বা ফতুয়ার মতো জামা, ধুতির কোঁচা মাটিতে ঠেকে না। ভারী ফ্রেমের চশমার আড়ালে উজ্জ্বল দৃষ্টি, আর অবিন্যস্ত গোঁফের ফাঁকে একটু ফিচেল হাসির রেখা। সবমিলিয়ে এটাই হল গৌরদার মলাট। পাতা ওল্টালে ভরপুর গল্প, মজা, অভিজ্ঞতার নানা কাহিনিতে শিখে নেওয়ার উপকরণ।

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর গৌরকিশোরবাবু

দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে গৌরদার সঙ্গে যোগাযোগের বিশেষ প্রয়োজন হতো না। তিনি থাকতেন শিখর চুড়োয় তাঁর লেখালিখি নিয়ে। নিতান্ত মামুলি রিপোর্টার আমি বা আমরা দৌড়ে বেড়াতাম নিজেদের অ্যাসাইনমেন্টে। কিন্তু সেই ফাঁকটা ভরাট করে কাছে আসার রাস্তাটা খুলে দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। তাই অল্প দিনেই তিনি কাছের মানুষ।

চাক্ষুষ পরিচয়ের আগেই অবশ্য গৌরকিশোর ঘোষ আমার মতো অনেকের চোখে হিরো। যেমন হিরো বরুণ সেনগুপ্ত। জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদী সাংবাদিকতা এবং দু’জনকে গ্রেফতার করে জেলে পোরার খবর আমাদের কলেজ বেলায় আলোড়ন ফেলেছিল। কয়েক বছরের মধ্যে আনন্দবাজারে তাঁদের সঙ্গে এক ছাদের তলায় কাজ করতে আসার সুযোগ হয়ে যায়। যদিও তার অল্প দিনের মধ্যে ‘আজকাল’ সংবাদপত্রের প্রথম সম্পাদক হয়ে চলে গিয়েছিলেন গৌরকিশোর। ফিরে আসেন কিছু দিন পর। আলাপ আরও জমে তার পর থেকে।

নতুনদের জন্য সব সময় গৌরদা’র একটা পছন্দের প্রশ্ন ছিল, রাইটার্স থেকে আনন্দবাজার অফিসে হেঁটে আসার সহজ পথ কোনটা? আলাপের সূচনা হতো এ ভাবে। গৌরদা বুঝিয়ে দিতেন, কেমন করে রাইটার্স থেকে কোণাকুণি রাস্তা পেরিয়ে স্টিফেন হাউজের ভিতর দিয়ে শর্টকাট
করে ম্যাঙ্গো লেন থেকে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট টপকে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে ঢুকে পড়তে হয়। তারপর সব চলত তরতরিয়ে।

ক্যালকাটা ইনফরমেশন সেন্টারে সাহিত্যবাসরে তরুণ সান্যাল, গৌরকিশোর ঘোষ, পরিমল গোস্বামী, প্রবোধচন্দ্র সেন, সতীকান্ত গুহ

অভিজ্ঞতার অফুরান ভাণ্ডারি ছিলেন গৌরকিশোর। জন্ম যশোহরে। ম্যাট্রিক পাশ করেন নবদ্বীপের স্কুল থেকে। ইন্টারমিডিয়েটের পরে প্রথাগত শিক্ষা আর এগোয়নি। ১৯৫৩ সালে সাংবাদিকতায় আসার আগে অন্তত বারো বছর জীবনের নানা ঘাটে জল খেয়েছেন। আক্ষরিক অর্থেই একসময় জাহাজে খালাসির কাজ করেছেন তিনি। তা ছাড়া কখনও ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কখনও হোটেলের বেয়ারা, কখনও নাচের দলের ম্যানেজার, কখনও বা মাস্টারি— কত কী! শেষ পর্যন্ত সীমান্তে শুল্ক আদায় অফিসে কেরানির চাকরি থেকে সাংবাদিকতায়। শুরু ‘সত্যযুগ’ কাগজে। সেখান থেকে আনন্দবাজারে।

গৌরদা ছিলেন প্রধানত রিপোর্টার। দেখার চোখ ছিল অন্তর্ভেদী। একই জায়গায় দশজন যা দেখবেন, গৌরদা দেখবেন অন্যরকম। আর সেই দেখাটাই তাঁর লেখাকে দিয়েছে বাড়তি সমীহ। আমাদেরও বলতেন, ‘‘যখন কোথাও যাবি, নিজের মতো করে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করবি। যাতে রিপোর্টে নিজস্ব ছাপ থাকে। অন্যদের থেকে আলাদা করা যায়।’’

একবার কোনও ত্রাণ কর্মসূচিতে রাজ্য সরকার কলকাতা থেকে রিপোর্টারদের একটি জেলায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে দরিদ্র ক্ষেতমজুরদের আর্থিক সাহায্য করা হল। মন্ত্রী, আমলাদের হাসিমুখের ছবি উঠল। সবাই উচ্ছ্বসিত। গৌরকিশোর ঘোষ লিখলেন, ‘দুইল্যা শেখের কপাল ফিরল!’ তাঁর রিপোর্ট থেকে দেখা গেল, জনৈক দুইল্যা শেখ সরকারি সাহায্য নেবেন বলে একদিন আগে দূর গ্রাম থেকে বাসে চেপে জেলা শহরে এসেছেন। রাতে হোটেলে থেকেছেন। দু’বেলা ভাত এবং চা-জলখাবার খেয়েছেন। পরদিন দুপুরে সরকারি সাহায্যের টাকা নিয়েছেন এবং সেই রাতও বাধ্য হয়ে হোটেলে থেকে-খেয়ে তৃতীয় দিন বাসে চেপে ফিরে গিয়েছেন। তাতে তাঁর যা খরচ হয়েছে, সরকারি সাহায্যে সেই খরচ পোষায়নি। রিপোর্ট বেরনোর পর সরকারের মুখ চুন। বিনোবা ভাবের একটি নীরস বক্তৃতার রিপোর্টে গৌরদার লেখার প্রথম লাইন ছিল, ‘‘বিনোবা ভাবে আজ তাঁর প্রিয়তম বিষয় নিয়ে বললেন। মানুষ।’’

শুধু লেখার হুল নয়, নিছক মজায় বস-দের জ্বালাতন করাতেও গৌরকিশোরের জুড়ি মেলা ভার। চিফ রিপোর্টার তো দূরস্থান, খোদ সম্পাদককেও সেই জ্বালা সইতে হয়েছে। তবে সবই বিশুদ্ধ রসিকতা। আর বড়রা সেটা বুঝতেন, উপভোগও করতেন।

কেমন ছিল সেইসব মজা? গৌরদার কাছে শোনা একটি ফোন-কাহিনি বলি। একবার নাইট ডিউটিতে তাঁর কাছে খবর এল, আনন্দবাজার প্রতিষ্ঠানের তখনকার ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ প্রকাশিত কোনও লেখার জন্য সম্পাদক সুধাংশু বসুর বিরুদ্ধে অন্য কোনও রাজ্যের আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। গৌরদা তখন জুনিয়র রিপোর্টার। দুষ্টুমি বুদ্ধিতেও ঠাসা। মাঝরাতে সরাসরি ফোন করলেন আনন্দবাজারের তৎকালীন সম্পাদক চপলাকান্ত ভট্টাচার্যকে। শীতের রাতে বাড়ির দোতলা থেকে একতলায় নেমে ফোন ধরলেন চপলাবাবু। গৌরদা জানতে চাইলেন, খবরটি কি লেখা হবে? সম্পাদক পরামর্শ দিলেন, ‘‘সুধাংশুবাবুকে ফোন করে জেনে নাও। ওঁরা যা করবেন, সেটাই করো।’’ নির্দেশ পালন করলেন রিপোর্টার এবং জেনে গেলেন, খবরটি লিখতে হবে না।

কিন্তু তাতে তো মজা সম্পূর্ণ হয় না। অতএব কিছুক্ষণ পর আবার চপলাবাবুর বাড়িতে ফোন বাজল। আবার লেপ থেকে উঠে নীচে নেমে এসে ফোন ধরলেন তিনি, ‘‘কী হল?’’ গৌরদা অমায়িক ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘সুধাংশুবাবু খবরটা লিখতে বারণ করছেন।’’ সম্পাদক এবার ঈষৎ বিরক্ত, ‘‘আমি তো আগেই বলেছি, উনি যা বলবেন করো। এটা বলার জন্য ফোন করার কী দরকার?’’ কিন্তু তাতেও কি মিটল? না। সম্পাদকের বাড়িতে ফের ফোন গেল নাছোড়বান্দা গৌরদার। এবার প্রশ্ন, ‘‘যদি স্টেটসম্যান খবরটা লেখে, তা হলেও কি আমরা লিখব না?’’ সম্পাদক এবার বুঝে ফেলেছেন গৌর তাঁর সঙ্গে রসিকতা করে বারবার ফোন বাজিয়ে শীতের রাতে উপর থেকে নীচে নামাচ্ছেন। এ বার ফোন ধরেই তিনি হেসে ফেললেন। বললেন,‘‘গৌর, আর দুষ্টুমি কোরো না। অনেক রাত হয়েছে। এ বার বাড়ি যাও।’’

রাজ্যপাল ধর্মবীরের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন গৌরকিশোর ঘোষ ও সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

চিফ রিপোর্টার শিবদাস ভট্টাচার্য নাকি গৌরকিশোরের জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁকে ‘জব্দ’ করতে দুর্গম নন্দাঘুণ্টি শৃঙ্গ অভিযান রিপোর্ট করতে পাঠিয়েছিলেন। ভাগ্যিস পাঠিয়েছিলেন! তাই বাংলা সংবাদপত্রে একটি পর্বত অভিযানের ওইরকম রিপোর্ট স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৬০। আনন্দবাজার পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতায় পর্বত অভিযান, নন্দাঘুণ্টি। গৌরদার বড় মেয়ে সাহানা তখন নিতান্ত শিশু। ছোট মেয়ে সোহিনী সদ্য জন্মেছে। স্ত্রী এবং মায়ের উপর সংসারের ভার ছেড়ে দিয়ে গৌরকিশোর পাহাড়ের পথ ধরলেন। সঙ্গী চিত্র সাংবাদিক বীরেন সিংহ। পাহাড়ে যাওয়ার কোনও অভিজ্ঞতা গৌরদার ছিল না। ভয়ে ভয়ে যাত্রা শুরু। শেষ সাফল্যের চূড়ায়।

সাহানার কাছে জেনেছি, ওই অভিযানের সময় যোশীমঠে রামকৃষ্ণ সারদা মঠের সন্ন্যাসিনী প্রব্রাজিকা শ্রদ্ধাপ্রাণার (লক্ষ্মীদি) সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল গৌরদার। সাধারণভাবে দেব-দ্বিজে ভক্তি প্রদর্শন তাঁর ধাতে ছিল না। এ সব ক্ষেত্রে একেবারেই মুক্তমন ছিলেন গৌরকিশোর। কিন্তু লক্ষ্মীদির সঙ্গে ওই দেখা হওয়ার একটা ছোট্ট উপসংহার আছে। জরুরি অবস্থার সময় তিনি যখন প্রেসিডেন্সি জেলে, তখন একদিন ভোরবেলায় সেলের সামনে হাঁটতে বেরিয়ে গৌরদার হঠাৎ মনে হল, তিনি যেন সামনে লক্ষ্মীদিকে দেখছেন, ঠিক যেমনটি দেখেছিলেন যোশীমঠে। উজ্জ্বল, হাসিমুখ। সেই ঘটনার অল্প পরেই জেল থেকে ছাড়া পান গৌরকিশোর।

১৯৭৫ সালে পুজোর ঠিক আগে গৌরকিশোর ঘোষকে গ্রেফতার করা হয়। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় তখন মুখ্যমন্ত্রী। ‘কলকাতা’ পত্রিকায় কিশোর ছেলেকে লেখা বাবা গৌরকিশোরের একটি চিঠি বেরিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে জরুরি অবস্থার অন্ধকারের কথা। প্রতিবাদ করা হয়েছে বাক্‌স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে। ততদিনে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে গৌরদার প্রতিবাদী অবস্থান সকলের জানা হয়ে গিয়েছে। গণতন্ত্রের ‘মৃত্যু’ হয়েছে বলে মাথা কামিয়ে অশৌচ পালন করেছেন তিনি। তখন থাকতেন বি টি রোডে, চুনিবাবুর বাজার সংলগ্ন আবাসনে। সেই ঠিকানায় সিদ্ধার্থশঙ্কর, বরকত গনি খান, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতো বহু নেতার যাতায়াত ছিল। সেখানেই একদিন বেশি রাতে ফ্ল্যাটের দরজায় কলিং বেল বাজিয়ে হানা দিল পুলিশ। ততক্ষণে গোটা তল্লাট ঘিরে ফেলেছে পুলিশের বিশাল বাহিনী। প্রথমে বাড়ি সার্চ করা হল। তার পর গৌরকিশোরকে পাইকপাড়া থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল পার্ক স্ট্রিট থানায়। সেই থানার ওসি কিন্তু গৌরদাকে লকআপে রাখেননি। জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে সরিয়ে নিয়ে সসম্মানে নিজের রেস্টরুমে শোওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। জেলে প্রথমে সাধারণ কয়েদির মতো রাখা হয়েছিল তাঁকে। পরে মামলা করে তিনি রাজবন্দির মর্যাদা আদায় করেন।

গৌরকিশোরকে একসময় সিআইএ-র এজেন্ট বলেও রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমেরিকান কয়েকজন বাদ্যযন্ত্রী একবার তাঁর বাড়িতে কনসার্ট করার পর সেই প্রচার আরও জোরদার হয়। বিষয়টি এতদূর গড়ায় যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তিনজন ছাত্র-প্রতিনিধি তাঁর চুনিবাবুর বাজারের ফ্ল্যাটে সরেজমিন তদন্তে গিয়েছিলেন। তাঁরা শুনেছিলেন, অতি বিলাসবহুল জীবনযাপন তাঁর। দামি আসবাব, আগাগোড়া কার্পেটে মোড়া বাতানুকূল ফ্ল্যাট। গিয়ে দেখেন ছোট্ট ঘরে তক্তাপোষের জীবনযাপন।

বাস্তবে বাড়ি-গাড়ি-সংসার বিষয়ে গৌরদা ছিলেন চরম উদাসীন। জীবনের প্রায় শেষ বেলায় উল্টোডাঙার বিধান নিবাসে নিজস্ব ফ্ল্যাট হয়েছিল। তার আগে ঠিকানা বদল করেছেন বারবার। চুনিবাবুর বাজারের আগে থাকতেন বরাহনগরে। সেই বাড়ির নীচের তলায় ছিল একটি ব্যাঙ্ক। রসিকতা করে বলতেন, ‘‘আমার কি টাকার অভাব? আমি তো ব্যাঙ্কের ভল্টের উপরেই শুয়ে থাকি!’’

স্ত্রী শীলার সঙ্গে

বরাহনগরে থাকাকালীন নকশালদের কোপের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৭০। নকশাল আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আদর্শের দোহাই দিয়ে খুনের রাজনীতি গৌরকিশোর মানতে পারেননি। তাঁর লেখায় তীক্ষ্ণ আক্রমণ ছিল ওই হঠকারিতার বিরুদ্ধে। নকশালরা ডাক দিল, ‘গৌরকিশোর ঘোষের মুন্ডু চাই।’ শুভানুধ্যায়ীরা অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন বরাহনগরের মতো ‘উপদ্রুত’ এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। গৌরদা রাজি হননি। লেখাও থামাননি। বরং রাতবিরেতে কাজকর্ম সেরে একাই হেঁটে ঢুকতেন পাড়ার রাস্তায়। এই মানুষটিই আবার নকশালদের বিরুদ্ধে পুলিশের নির্বিচার দমন নীতির প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন। ‘রূপদর্শী’র কলমে বারবার লিখেছিলেন, পুলিশ যেভাবে নকশাল-নিধন চালাচ্ছে তা অমানবিক। ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর উত্তেজনার আঁচ পৌঁছেছিল কলকাতার কিছু কিছু এলাকায়। গৌরদা বিভিন্ন সংবেদনশীল পাড়ায় ঘুরে বাসিন্দাদের অবস্থা দেখে তা লিখতেন। লোকদের বোঝাতেন সম্প্রীতি রক্ষার গুরুত্ব।

রাজনৈতিক বিশ্বাসে গৌরকিশোর ছিলেন‌ ‌র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট। মানবতাবাদী, সংস্কাররহিত, উদারপন্থী। ধর্ম, সম্প্রদায়, আচার, নিয়ম কোনও কিছু নিয়ে তাঁর কোনওরকম গোঁড়ামি ছিল না। প্রচলিত রীতি-নিয়মকে কিছুটা অবজ্ঞাই করেছেন নিজের জীবনেও। যেমন, বিয়ে। বাড়ির অমতে বিয়ে করলেন। কলেজ স্ট্রিটে রেজিস্ট্রি সেরে বন্ধু অরুণ সরকারের বাড়িতে ফুলশয্যা হল। পরে একদিন আত্মীয়-বন্ধুদের নিয়ে অনুষ্ঠান। তাতে প্রবেশ মূল্য পাঁচ টাকা! টিকিট না কেটে ঢোকা যাবে না। গৌরদার বাবাকেও টিকিট কাটতে হয়েছিল। আমন্ত্রিত রাজশেখর বসু গৌরদাকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, ‘‘তোমার বিয়ে নিয়ে আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ সেই মেয়েটিকে নিয়ে, যে তোমাকে পছন্দ করল।’’

সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ সাহিত্যেও কৃতী। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের স্বীকৃতিতে বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ১৯৮১ তে ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পাওয়ার বহু আগে ১৯৭০ সালে সাহিত্যক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হন গৌরবাবু। ঠিক তার আগের বছর, ১৯৬৯ সালে, প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘সাগিনা মাহাতো’। চা বাগানের শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন। তাঁদের নেতা সাগিনা। যা পরে চলচ্চিত্রে আরও পরিচিতি পায়। কেন্দ্রীয় চরিত্রে দিলীপকুমার। তাঁর অন্যান্য বইয়ের মধ্যে আছে ‘পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদ তরণী, হা হা’, ‘প্রেম নেই’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ প্রভৃতি।

এ ছাড়াও ‘ব্রজদার গুল্পসমগ্র’ রসিক গৌরকিশোরের এক অনবদ্য সৃষ্টি। ব্রজনাথ রায় ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক। সাবলীল ভঙ্গিতে উদ্ভট গুল দিতে জুড়ি ছিল না তাঁর। সেইসব মজার কথা আরও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গৌরদা তাঁর ‘রূপদর্শী’র কলমে ধারাবাহিক ভাবে লিখতে শুরু করেন। পরে সেটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। আরও পরে সিনেমা তৈরি হয় ‘ব্রজবুলি’ নামে। ব্রজদার ভূমিকায় উত্তমকুমার।

সঙ্গীতেও যথেষ্ট আগ্রহ ছিল গৌরকিশোরের। ছিল পুরনো রেকর্ড সংগ্রহের নেশা। তাঁর মেয়ে সাহানা বলেছেন, সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে বাইরে’ ছবি করার সময় একটি পুরনো গানের রেকর্ড খুঁজছিলেন। গৌরদার কাছে রাইচাঁদ বড়ালের একটি রেকর্ড ছিল। খবর পেয়ে লোক মারফত সত্যজিৎ সেটি নিয়ে যান। শচীন দেববর্মণের সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল গৌরদার। এতটাই যে, দক্ষিণ কলকাতার সাউথ এন্ড পার্কে তাঁর বাড়িতে কয়েকবার সপরিবার গৌরকিশোরকে ডেকে চর্ব্যচুষ্য খাইয়েছেন শচীনকর্তা। বিষয়টি এতটাই ‘বিরল’ যে, চিত্র পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় একবার ঠাট্টা করে গৌরদাকে বলেছিলেন, ‘‘আপনাকে কর্তা বাড়িতে ডেকে খাওয়াচ্ছেন, ভাবতেই পারছি না! আমরা তো এত দিন ঘুরেও কিছুই পাইনি!’’

নন্দাঘুণ্টি অভিযানের পর নতুন দিল্লিতে অভিযাত্রী দলের সঙ্গে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু (পিছনের সারিতে মাঝে গৌরকিশোর)

এই শচীনকর্তাকে নিয়েই একবার সন্তোষকুমার ঘোষের সঙ্গে মন কষাকষি হয়ে গেল গৌরদার। বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন উপলক্ষে শচীনকর্তা এসেছিলেন কলকাতায়। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় গৌরদাকে অনুরোধ করলেন শচীনকর্তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে। কণিকাকে (মোহর) নিয়ে গৌরদা গেলেন কর্তার দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে। শুনে সন্তোষবাবু চটে লাল! গৌর কেন মোহরকে নিয়ে যাবে? গৌরদাকে বললেন, ‘‘তুমি গানের কী বোঝো? শচীন দেববর্মণের সঙ্গে মোহরের আলাপ করানোর আগে গান বুঝতে হয়!’’ ফলে তুমুল ঝগড়া এবং বেশ কিছুদিন বাক্যালাপ বন্ধ। গৌরদার কাছে শুনেছি, একবার এক বিশিষ্ট জনের বাড়িতে তাঁরা দু’জন গিয়েছেন। বিহারি দারোয়ান ঢুকতে দিতে রাজি নন। সন্তোষবাবু যতই বোঝান তিনি আনন্দবাজারের নিউজ এডিটর, দারোয়ানের তাতে থোড়াই কেয়ার! অগত্যা গৌরদা এগিয়ে গেলেন। বললেন, ‘শুনিয়ে, হমলোগ আনন্দবাজার নিউজপেপার কা সাব এডিটর’। লম্বা স্যালুট ঠুকে দারোয়ান বললেন, ‘ও, সাহাব এডিটর! আইয়ে আইয়ে...’ সন্তোষদা রেগে গেলেন, ‘‘নিউজ এডিটরের চেয়ে সাব এডিটর বড় হল! ফিরে চলো। আমি ঢুকব না।’’ তাঁকে বুঝিয়ে সুজিয়ে সেবার গোল মেটালেন গৌরদাই।

এমনিতে দু’জনের সম্পর্ক ছিল আবেগে মাখা। যাকে বলে অম্ল-মধুর। কখনও জোয়ার, কখনও ভাটা। সন্তোষবাবুকে গৌরদা ডাকতেন সেজদা বলে। শ্রদ্ধা করতেন অগ্রজের মতোই। দীর্ঘ কয়েক দশক একসঙ্গে কাজ করেছেন আনন্দবাজারে। এখানে ওখানে ঘুরেছেন, হাসি-ঠাট্টা-মজায় দিন কাটিয়েছেন। ঝগড়া হলে সেটাও মজার। এমনও হয়েছে, সন্তোষবাবুর সঙ্গে গৌরদার কথা নেই, অথচ সন্তোষবাবুর বাড়িতে তিনি সপরিবার বে়রাতে গিয়েছেন। সেখানে খাওয়া-দাওয়া-গল্প সব হতো। শুধু তাঁরা দু’জনে পরস্পরের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন না। গৌর-তনয়া সাহানার স্মৃতিতে আছে, ‘‘ঝগড়া হলে সন্তোষজেঠু এবং বাবা কেউ কারও দিকে তাকাতেন না। কিন্তু আমরা ভাইবোনেরা, সন্তোষজেঠুর ছেলেমেয়েরা, জেঠিমা, আমার মা সকলে জমিয়ে মজা করতাম। খাওয়ার সময় সন্তোষজেঠু আকার-ইঙ্গিতে বাবার খাওয়ার তদারকিও করতেন। তবু কথা বলবেন না!’’

রিপোর্টার গৌরকিশোরের পরিচিতির জগৎ স্বাভাবিক ভাবেই ছিল বিস্তৃত। তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বৃত্তে জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ রায়, চারু মজুমদার, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন শিল্প-সংস্কৃতির বিশিষ্টেরা। সেখানে দল, মত, গোষ্ঠীর কোনও বাছবিচার ছিল না। তবে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক কখনও তাঁর সাংবাদিক সত্তাকে আচ্ছন্ন করেনি। যা উচিত বলে মনে করেছেন পরম বন্ধুর বিরুদ্ধে হলেও সে কথা লিখতে তাঁর দ্বিধা ছিল না। এই আপসহীনতাই গৌরকিশোর ঘোষের অন্যতম ব্র্যান্ডিং।

সাতাত্তর বছর বয়সে ২০০০ সালের ১৫ ডিসেম্বর জীবনাবসান হয় তাঁর। কিন্তু মানবতাবাদী ও সাংবাদিক গৌরকিশোর আজও কৃতিত্বে অমর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE