Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শেকল ছেঁড়া অশ্বমেধের ঘোড়া

‘অদ্য শেষ রজনী’। ব্রাত্য বসুর পরিচালনায় ‘পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গ’-র নতুন নাটক। দেখে এসে লিখছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়বেলগাছিয়া নাট্যশালা ঠিক কোথায় আমার জানা নেই। আদৌ আজও তার কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা তাও অস্পষ্ট আমার কাছে। তেমনই অজানা ছিল মোহিত মৈত্র মঞ্চ, পাইকপাড়া। সপ্তাহ শেষের এক শেষ বিকেলে একটু আগেই পৌঁছে গেলাম দূরত্ব বুঝতে না পেরে। পাইকপাড়ার ফুটপাথে চা খাওয়া ছাড়া আর কোনও মাপমতো কাজ মাথায় আসছিল না। খুঁজছিলাম একটা খালি চায়ের দোকান। পর পর চার পাঁচটা আছে।

নাটকে অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও অঙ্কিতা মাঝি

নাটকে অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও অঙ্কিতা মাঝি

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

বেলগাছিয়া নাট্যশালা ঠিক কোথায় আমার জানা নেই।

আদৌ আজও তার কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা তাও অস্পষ্ট আমার কাছে।

তেমনই অজানা ছিল মোহিত মৈত্র মঞ্চ, পাইকপাড়া।

সপ্তাহ শেষের এক শেষ বিকেলে একটু আগেই পৌঁছে গেলাম দূরত্ব বুঝতে না পেরে। পাইকপাড়ার ফুটপাথে চা খাওয়া ছাড়া আর কোনও মাপমতো কাজ মাথায় আসছিল না। খুঁজছিলাম একটা খালি চায়ের দোকান। পর পর চার পাঁচটা আছে। প্রায় একটা স্বপ্নদৃশ্যের মতো যত এগোচ্ছি প্রতিটি চায়ের দোকানে দু’চার জন চেনা মুখ! সব ক’টি চায়ের দোকানেই! সবাই ডাকছে চা খেতে! অথচ আমি একটা ফাঁকা চায়ের স্টল খুঁজছি! বুঝলাম এঁরা সবাই আমার মতোই এসেছেন নাটক দেখতে। এক ভাঁড় চায়ের শেষে আমাদের সবার ঠিকানা পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গ-র ‘অদ্য শেষ রজনী’। পরিচালনা ব্রাত্য বসু।

দীর্ঘদিন পর নাটক দেখছি। নতুন এক অডিটোরিয়াম। বিরাট হল। এক তলায় হরিসভা চলছে। দুই ও তিন জুড়ে অপূর্ব এক বন্দোবস্ত। ‘বোস’-এর শব্দব্যবস্থা, অঢেল আলো, বিস্তৃত মঞ্চ, চমৎকার ব্যালকনি। সব কোণ থেকেই মঞ্চ সমান দৃশ্যমান। উত্তর কলকাতার মঞ্চ তালিকায় আরেকটি নতুন নায়কের নাম উজ্জ্বল হয়ে উঠল ব্রাত্য বসুর দৌলতে। ‘মোহিত মঞ্চ’।

লেট লতিফ বাঙালির একটা সাহেবিয়ানা অটুট। গ্রুপ থিয়েটার বা থিয়েটারের ফাস্ট, সেকেন্ড ও থার্ড বেল। মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর জন্যও যা এক সেকেন্ড দেরিতে বাজে না। বাজবেও না। নাটক শুরু হল এক ‘ব্লো-হট’ ক্যাবারের দৃশ্য দিয়ে!!! বারবধূ?

প্রয়াত অসীম চক্রবর্তীকে চেনে না এমন নাট্যকর্মী খুব কম এবং ওঁকে না-চেনার ভান করেন তেমন নাট্যকর্মীও খুব কম নয়।

আমাদের সভ্যতা জন্ম দিয়েছে নির্বাসিত জর্জদা, দেবব্রত বিশ্বাসকে। ‘রবীন্দ্র-মাফিয়া’-দের আস্ফালনে দেবব্রত বিশ্বাসের ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ আর বাংলার বেশ কিছু থিয়েটার দাদাদের প্রতিবাদ ও অবজ্ঞায় মুছে গিয়েছিল অসীম চক্রবর্তীর ব্যাপ্তি ও অবদান।

এক কথায় বলব, ‘অদ্য শেষ রজনী’ এক প্রচণ্ড উচ্চারণের বিরুদ্ধে। এই নাটক প্রতিষ্ঠা করল অসীমবাবুকে গ্রুপ থিয়েটারের ‘জর্জদা’ হিসেবে। নাটকে তাঁর নাম অমিয় চক্রবর্তী।

সাহিত্য ও নাটক নিয়ে অগাধ জ্ঞান ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বাংলার দর্শক হজম করতে পারেনি। বুঝতে পারেনি তাঁর মনের চলাচল। এই নাটকে যা ব্রাত্যবাবু বিশেষ করে দ্বিতীয় অর্ধে বারবার তুলে ধরেছেন। যেন বারবার ইন্টারপ্রেট করছেন শ্রী চক্রবর্তীর ‘মেন্টাল স্পেস’টাকে। যেখানে শিল্পী ও শিল্প মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে। তাই এক সামাজিক অনর্থের চেহারা নিচ্ছে। গ্রুপ থিয়েটারের সম্ভ্রান্ত চাপা রাজনীতির আড়াল সরিয়ে অসীম অমিয়র সেই কবেকার ছাড়া অশ্বমেধের ঘোড়া হঠাৎ শিকল খুলে ছুটতে থাকে। সাধুবাদ জানাই পাইকপাড়ার গর্ব এই দলটিকে।

মঞ্চনির্মাণে ট্রামটির নানা ব্যবহার চমৎকার। কত কী না হয়ে গেল ওই একটি কল্পযান। দেওয়ালে সেকালের পোস্টার আর দু-একটি আসবাব ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। তবু কোনও কিছুর অভাবও নেই যেন!

প্রচণ্ড ইচ্ছে করলেও বিস্তারিত লিখে ফেলার বেইমানিটি আমার পক্ষে করা অসম্ভব।

আমার বহু ছবির সমালোচনায় সাংবাদিককে ১০০ শব্দের চাপে প্রাণ খুলে পুরো গপ্পো লিখে দিতে দেখেছি। আগে রাগ হত, এখন খুব মজা হয়।

এটা অনেকটা বাড়ির সেই লোকটার মতো, যে কোনও কথা পেটে রাখতে পারে না। তাই এটুকুও বলব— এক অসম্ভব প্রতিভার উদ্ভাসকে রুদ্ধ করার রাজনীতি ও সেই শিল্পীর সৃষ্টি ও বাস্তবের ভারসাম্যের অভাবের এক মনতাজ এই নাটক বা নাট্য।

মঞ্চ, আলো ও আবহ নিয়ে সামান্য এক-আধটা কথা লেখা যাক।

চক্রবর্তীবাবুর ভূমিকায় অনির্বাণ ভট্টাচার্য অসম্ভব দক্ষ, কৌশলী ও প্রতিভাবান। নানান মেজাজ, চরিত্র ও দিন-রাত এত সুন্দর আলাদা করতে পারেন! অভিনেতা ভাল হলেও শরীর বহুক্ষেত্রে তৈরি থাকে না। অনির্বাণকে আস্তিকের মতে ঈশ্বর এক চমৎকার উপস্থিতি দান করেছেন। ওঁর শরীর দুমড়ে মুচড়ে, ভেসে, গড়িয়ে বইতে থাকে দু’ঘণ্টা ধরে টানা। কোত্থাও কোনও নুড়ি পাথরেও ঠেকে না।

অনির্বাণভাই, এই প্রাপ্তি নিয়ে দয়া করে সচেতন হবেন না। নইলে প্রতি নাটকে দুমড়ে মুচড়ে, ভাসতে ইচ্ছে করবে দক্ষতার লোভে। তেমনি আপনার কণ্ঠ। চেনা মানুষের দৈনন্দিন কণ্ঠস্বর আপনার, গভীরতাও পরিমাপ মতো। তাই অমিয় জীবন্ত হয়ে ওঠে নাটকের মধ্যে নাটকের দৃশ্যে।

তবে বাস্তবের দৃশ্যগুলোতে, বিশেষ করে স্ত্রীর সঙ্গে গলা আমার কানে একটু নকল সুরে বাজল। এক জন অভিনেতা বিসেবে আপনাকে দেখে ঈর্ষা হয়েছে এটুকু মানতে লজ্জা নেই। তবে দেখুন না নাটকের অভিনয় দৃশ্যগুলো ছাড়া যদি একটু স্বাভাবিক কথোপকথনের চলন রাখা যায়। এ একান্তই ব্যক্তিগত মত ও পরিচালকের সম্মতি গ্রাহ্য।

এমনটা মনে হওয়ার দোষ আমার নয়, দোষ অঙ্কিতা মাঝি বা মালা। অমিয়র স্ত্রীর চরিত্রে ইনি তাঁর স্বাভাবিক অভিনয় ও অনায়াস বাচনভঙ্গিতে আমায় মুগ্ধ করলেন। ওঁর দীর্ঘ অভিনয় জীবন কামনা করি। নাটক আজ বিশ্বময় তার নাটুকেপনা ত্যাগ করে একদম রাস্তার বাস্তবে এসে উচ্চারিত হচ্ছে। অঙ্কিতা সেই ইস্কুলের ছাত্রী।

মুখ্য চরিত্রে অর্থাৎ রজনীর ভূমিকায় দেবযানী চট্টোপাধ্যায় বাংলার একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী। অনবদ্য দক্ষতায় বারবনিতার বাস্তব ও অভিনয় জীবনকে ফুটিয়েছেন দেবযানী। সমালোচক বিষ্ণু দত্তের চরিত্রে সত্রাজিৎ সরকার বেশ মজার। ইন্দ্রজিৎ ও মৌলি রায় যথাযথ।

বিশেষ প্রশংসা করব নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের। অমিয়র জটিল জীবনযাত্রা, গ্রিনরুমের গন্ধ, রাতের কলকাতা, নিম্নবিত্ত-উচ্চবিত্তের উঁচু নিচু বন্দোবস্ত, সময়, সমাজ ও রাজনীতি চমৎকার ভাবে বেঁধেছেন দু’ঘণ্টায়। অমিয়র ভাবনার জগতের নির্মাণের প্রশংসা নাট্যকার না পরিচালকের প্রাপ্য তা জানি না, তবে এই সন্ধ্যার সেরা প্রাপ্তি।

শেষে বলি, পরিমার্জনের কথা।

এই নাটক দেখার পর আমার স্ক্রিপ্ট থেকে বাদ পড়া দৃশ্যগুলিও পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। ওখানেও তো অমিয়র অজানা টুকরো পড়ে রইল।

আজকের নাট্যজগতে ব্রাত্য বসু একটা স্তম্ভ। প্রতিবাদের গলা যার ছাত্রজীবন থেকেই আলাদা হয়ে বাজত। বারবার তাঁর নাটকে বিভিন্ন রাজনৈতির পরিস্থিতিতে স্বতন্ত্রভাবে শোনা গেছে তাঁর কণ্ঠস্বর।

এই নাটকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

নাম না করেও রুচিসম্পন্ন বেত্রাঘাতে ব্রাত্যবাবু চিরপটু। মঞ্চে ওই দু’ঘণ্টা সময়কে ও অতগুলি চরিত্রকে নিজের কব্জায় রেখেছিলেন তিনি। এমন একটি মঞ্চকে রাখালদাসের মতো খুঁড়ে উদ্ধার করার জন্যও সাধুবাদ। বাংলার নাট্যপ্রেমী মানুষরা পাইকপাড়ার অডিটোরিয়াম পূর্ণ করে প্রমাণ তো করল একটা সত্যি, যে আপনি যেই হোন, ব্রাত্য নন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE