Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

হিমালয়ের মরুভূমিতে

ধূসর, রুক্ষ পাহাড়ের মধ্যে সর্পিল রাস্তা। তা পেরিয়েই উপত্যকা, নীল হ্রদ। না দেখলে লাদাখের সৌন্দর্য বিশ্বাস করা কঠিনধূসর, রুক্ষ পাহাড়ের মধ্যে সর্পিল রাস্তা। তা পেরিয়েই উপত্যকা, নীল হ্রদ। না দেখলে লাদাখের সৌন্দর্য বিশ্বাস করা কঠিন

মানালি-লে হাইওয়ে

মানালি-লে হাইওয়ে

সুজিষ্ণু মাহাতো
শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

জুলে!

লাদাখ ঘুরে ফিরে আসার পরে কথাটা ভোলা যায় না। ওই এক কথারই হরেক মানে। আলাপের প্রথমে বা বিদায়ের সময়— ‘জুলে’ বলার সঙ্গেই লাদাখিদের হাসিমুখ মন ছুঁয়ে যায়।

লাদাখ শব্দের অর্থ ‘গিরিবর্ত্মের দেশ’। তা মালুম হয় মানালি থেকে গাড়িতে লে গেলে। ‘লাদাখ’ নামক ভৌগোলিক অঞ্চলে রয়েছে জম্মু-কাশ্মীরের লে জেলা। লাদাখের ভৌগোলিক বৈচিত্র, বিশালত্ব অনুভব করতে হলে অবশ্যই মানালি থেকে সড়কপথে লে গিয়ে শ্রীনগর দিয়ে ফেরা বা উল্টোটা করা উচিত। অনেকে অবশ্য সময় বাঁচাতে বিমানেও যান।

মরুভূমি বলতেই একটা ছবি ভেসে ওঠে আমাদের মনে। লাদাখে মরুভূমির অন্য রূপ। হিমালয়ের মরুভূমি। বরফঠান্ডা হাওয়া হিমালয়ে ধাক্কা খেয়ে তৈরি করেছে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল। পাহাড়ের গায়ে হাওয়ার ঘর্ষণে তৈরি হওয়া অদ্ভুত সব ভূমিরূপ সেখানে। মানালি থেকে কেলং, জিসপা, দারচা, জিংজিংবার, ভরতপুর, সারচু, পাং হয়ে গাড়ি চলবে জনমানবহীন প্রান্তর দিয়ে। পেরোতে হবে রোটাং, টাংলাং লা-সহ ষোলো-সতেরো হাজার ফুট উচ্চতার একাধিক গিরিবর্ত্ম বা ‘পাস’।

পাহাড়ের রূপ

পাথরের যে কত রকম রং ও রূপ হতে পারে, তা লাদাখ না ঘুরলে বোঝা যায় না। মানালি থেকে লে অবধি প্রায় ৪৮০ কিমি পথ অধিকাংশ পর্যটকই দু’দিনে যান। কিন্তু তিন দিনে গেলে পথের যাবতীয় সৌন্দর্য ভাল ভাবে উপভোগ করা যায়। লে পৌঁছে দিন দুয়েক সেখানেই ঘুরে নেওয়া যায়। লে শহরে হেঁটে ঘুরলে তার মেজাজটা বোঝা যায়। লে প্যালেস, একাধিক গুম্ফা, থ্রি ইডিয়টস ছবিতে দেখা স্কুল... সব ঘুরে নেওয়া যায়।

মারমট

লে থেকেই যাওয়া যায় বলিউডের দৌলতে বিখ্যাত প্যাংগং হ্রদে। অনেকে প্যাংগং দেখে এক দিনেই ফিরে আসেন। কিন্তু প্যাংগং হ্রদের ধারে স্প্যাংমিক গ্রামে তাঁবুতে রাত কাটানোই শ্রেয়। চাঁদনি রাতে প্যাংগং হ্রদের সৌন্দর্য অনির্বচনীয়। প্যাংগং ছাড়াও লে থেকে সিন্ধু নদের পাশ ধরে রাস্তা পেরিয়ে যাওয়া যায় সো-মোরিরি হ্রদের ধারে কোরজোক গ্রামে। সেখান থেকে খানিক দূরে সো-কার হ্রদ। এই তিন হ্রদেই দেখা মেলে বহু পরিযায়ী পাখির। সো-কার হ্রদের কাছে কালো গলার সারস দেখতে আসেন দেশবিদেশের পর্যটকরা। প্যাংগং বা সো-মোরিরি যাওয়ার পথে দেখা মিলবে মারমটের। কাঠবেড়ালিরই এক প্রজাতি এই প্রাণী মাটি খুঁড়ে গর্ত করে থাকে।

প্যাংগং হ্রদ

লে থেকে নুব্রা ভ্যালি গেলে দেখা মিলবে দু’কুঁজের উট বা ব্যাকট্রিয়ান ক্যামেলের। পেরোতে হবে খারদুং লা। ৫০০০ মিটারেরও বেশি উচ্চতার খারদুং লা-ই নাকি বিশ্বের সর্বোচ্চ পাস, যা দিয়ে গাড়ি যাতায়াত করে। এই পথেই যেতে হয় বিখ্যাত সিয়াচেন হিমবাহ।

লে থেকে শ্রীনগরের রাস্তায় গেলে বা এলে অধিকাংশই কার্গিলে রাত্রিবাস করেন। সেই পথেই দেখে নেওয়া যায় দা, হানু। ‘আর্যগ্রাম’ বলে পরিচিত এই সব গ্রামেই নাকি এখনও ভারতে যুদ্ধ করতে আসা গ্রিকদের বংশধরেরা বাস করেন বলে কথিত। অনেকে ওই সব গ্রামে হোম স্টে-তেও থাকেন। কার্গিল-লে পথে পড়বে লামায়ুরু মঠ। আর ম্যাগনেটিক হিল, যেখানে পাহাড়ের টানে নিজে নিজেই এগিয়ে যায় আস্ত গাড়ি।

লে প্যালেস

আসলে লাদাখে নিসর্গ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বন্যপ্রাণ মিলিয়ে এত রকম পর্যটন-আকর্ষণ যে, তালিকা করা অসম্ভব। তবে একটা কথা মনে রাখা একান্ত জরুরি, তা হল দূষণ নিয়ে সচেতনতা। এখন মরসুমে (জুন-সেপ্টেম্বর) লাদাখে পর্যটকদের ঢল নামে। ভিড়ে স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রও বিপন্ন। তাই এমন কোনও কাজই করা উচিত না যাতে সেখানকার মানুষজন, পরিবেশ, পশুপাখি প্রাণী কোনও কিছুরই ক্ষতি হয়।

এই দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের মতো পর্যটকদেরই। তবে নাফেরার আগে ধূসর পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে সূর্য আপনার দিকে তাকিয়ে বলবে— জুলে!

মনে রাখতে হবে

•লাদাখ যাওয়ার পথ ও লে শহর-সহ আশপাশের সব গন্তব্যেরই উচ্চতা সমতল থেকে অনেক বেশি। তাই সেখানে সাধারণ মানুষের শরীরের মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। যাওয়ার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে যাওয়া শ্রেয়।

•বিমানে লে পৌঁছলে শরীরকে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য কমপক্ষে একটা দিন রাখা উচিত। নইলে অ্যাকিউট মাউন্টেন সিকনেসে (এএমএস) আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গাড়িতে যেহেতু পথের উচ্চতা ধীরে ধীরে বাড়ে, শরীরও মানিয়ে নেওয়ার সময় পায়। অতিরিক্ত উচ্চতায় যেহেতু অক্সিজেন কম, তাই উৎসাহের বশে বেশি দৌড়ঝাঁপ, হাঁটাহাঁটি করা ঠিক নয়। ধীরেসুস্থে ঘোরাই ভাল।

•সীমান্তে চিন থাকায় গোটা লাদাখ অঞ্চলেই নিরাপত্তার কড়াকড়ি রয়েছে। মোটামুটি সমস্ত জায়গাতেই ইনারলাইন পারমিট লাগে। তাই লে শহরে পৌঁছেই প্রয়োজনীয় নথি দিয়ে এগুলির ব্যবস্থা করে নেওয়া দরকার। যে কোনও হোটেল বা গাড়িচালকেরাই এগুলিতে সাহায্য করতে পারবেন।

•মনে রাখতে হবে, লাদাখ অন্য যে কোনও পর্যটন গন্তব্যের মতো একেবারেই নয়। পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এখানে বিপদের সম্ভাবনা যথেষ্ট। তা ছাড়া ভারত-পাকিস্তান এবং ভারত-চিন দুই সীমান্ত এলাকারই খুব কাছে অবস্থিত হওয়ায় নিরাপত্তাজনিত কারণেই পরিস্থিতি যখন-তখন বদলাতেও পারে। তাই স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী, গাইড, হোটেলকর্মী, গাড়িচালকেরা যা বলবেন, সেটাই মেনে চলা উচিত।

কীভাবে যাবেন

দিল্লি থেকে বিমানে লে যাওয়া যায়। আর সড়কপথে গেলে হিমাচল প্রদেশের মানালি হয়ে বা কাশ্মীর পৌঁছে শ্রীনগর থেকে যাওয়া যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Travel and Tourism Ladakh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE