Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মনাস্ট্রি ঘেরা মরুভূমির পাহাড়

পায়ে পায়ে বরফ। পাহাড়ের নিঃশব্দ আশ্রয়। নদীর মুখরিত প্রশয়। পরের ছুটিতে ভরে নিন হিমাচলের কাজা, ছিতকুলের দুর্গম পথের গন্ধ। ঘুরে এলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় পায়ে পায়ে বরফ। পাহাড়ের নিঃশব্দ আশ্রয়। নদীর মুখরিত প্রশয়। পরের ছুটিতে ভরে নিন হিমাচলের কাজা, ছিতকুলের দুর্গম পথের গন্ধ। ঘুরে এলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

কাজা

কাজা

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৭ ০১:০৩
Share: Save:

থমকে গেল ভোরের হাওয়া। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার নরেশ স্টিয়ারিং বন্ধ করে বললেন,

‘‘আর গাড়ি যাবে না। কুনজুম পাসের রাস্তা বন্ধ।’’

পথের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লাহোল-স্পিতি উপত্যকার মরুভূমি পাহাড়। এখানে পাহাড় ধূসর, খয়াটে। এক লহমায় মনে হয়, মিশরীয় সভ্যতার কোনও নিদর্শন দেখছি! সে রকমই এক এলাকায় নিঝুমপুরে আমাদের গাড়ি বন্ধ হল। এক পা সরলেই পৌঁছে যাব নীচের খাদে। সামনে অজগর সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথের গায়ে পাহাড়ি ঝোরা উঠে এসেছে। সঙ্গে ধুপধাপ শিলাবৃষ্টি, গাড়ি আর এগোবে না। এমনকী, পিছোবেও না! পরিবার, সঙ্গে ছ’বছরের মেয়ে আর এক বন্ধু দম্পতি। কলকাতায় অনেকেই বলেছিল, ‘ও সব দুর্গম পাহাড়ে রিস্‌ক নিতে নেই। যে কোনও মুহূর্তে ল্যান্ড স্লাইড।’ কে শোনে কার কথা! বাচ্চা-বড় সকলের হিল সিকনেসের ওষুধ। জল আর বান্ধবীর ব্যাগ ভর্তি ড্রাই ফ্রুটস নিয়ে হিমাচলের কাজা রিসর্ট থেকে ব্রেকফাস্ট সেরে সেই কোন সক্কালে বেরিয়ে পড়েছি। কী না, মেয়েকে বরফ দেখাব! কাজা থেকে ৮ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে কুনজুম পাস। ওখানেই নাকি বরফের ছোঁয়া মিলবে।

ধাঙ্কার মনাস্ট্রি

অগত্যা সূ্র্যের আলোর অপেক্ষা। পথ শুকোলে যাত্রা শুরু। স্পিতি উপত্যকার কেন্দ্রবিন্দু কাজা (৩৬০০ মিটার)। লাহোল-স্পিতি এলাকার চন্দ্রভাগা পর্বত শ্রেণি দেখব বলেই কুনজুম পাস দেখার রিস্‌ক নিয়েছিলাম আমরা। অবশেষে সূ্র্যের আলো পাহাড়ের দরজা খুলে দিল। শুকনো পথে আমরা পৌঁছলাম জনমানবহীন কুনজুম পাসে। পাহাড় আর হিমেল বাতাসের কোলাকুলি। পাহাড়ের শরীর ফুঁড়ে হঠাৎই বেরিয়ে এসেছে জলরাশি, তৈরি হয়েছে এক সুন্দর হিমপ্রবাহ। পায়ের তলায় নতুন বরফ! সামনে বৌদ্ধ দেবালয়, সঙ্গে ফ্লাস্কের গরম কফি। জীবনের কাছে আর যেন কিছুই চাওয়ার থাকে না! কাজা যাওয়ার পথেই আর এক বিস্ময়! হাজার বছরের পুরনো ধাঙ্কার মনাস্ট্রি। ঠান্ডা পাথর আর কাঠের গায়ে সেখানে রোমাঞ্চের ইতিহাস খেলে বেড়ায়! এ রকমই এক অমোঘ মুহূর্তে তৈরি হয় আত্মদর্শনের সুযোগ।

ছিতকুল

পাহাড় না সমুদ্র, ছোটবেলার সেই খেলা খেলতে খেলতেই আমরা দিল্লির বিমানবন্দর থেকে গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম সিমলায়। এক রাত্রি কাটিয়ে সারাহান। ছাতিম, ল্যাভেন্ডার আরও নানা পাহাড়ি হার্বসের গন্ধ নিয়ে ছ’ ঘণ্টার পথ কখন যে পেরিয়ে গেল, বুঝলাম না! আপেল আর অ্যাপ্রিকটের খেতভরা পাহাড়। আসতে আসতে আইস পিক চোখে ভাসতে লাগল। যত উপরে উঠছি, চার দিক থেকে বরফে ঢাকা পিক ঘিরে ধরছে আমাদের। সারাহানে যখন পৌঁছলাম, পাহাড় তখন নদীর কাছে মাথা নুইয়েছে। মেঘগন্ধের সারহানে যার দিকে সবচেয়ে আগে চোখ গেল, তা হল ভীমাকালীর মন্দির। সতীর কান পড়েছিল নাকি এখানেই। সে যেন মাথা তুলে শাসন করছে শৃখণ্ড মহাদেব শৃঙ্গকে। তিব্বতি কাঠের কাজের ৮০০ বছরের পুরনো এই মন্দিরে যেন নিরন্ধ্র মায়া! ছাড়তেই চায় না। সারাহানের পুরনো কাঠের বাড়ির আদল দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল, এর সঙ্গে যেন আমাদের চেনা শান্তিনিকেতনের কাচের মন্দিরের গঠনে কোথাও মিল আছে!

ভীমাকালী মন্দির

কেটে গেল এক রাত। সারাহানের ছবি লেন্সবন্দি করে ৭ ঘণ্টার রাস্তায় এ বার সাংলার পথে। পাহাড় আস্তে আস্তে রূপ বদলাতে থাকে। বাদামি পাহাড়। কোথাও আলোর পাহাড়। কোথাও মেঘের ছায়ায় ঢাকা গহন সবজেটে পাহাড়। সঙ্গে বাস্পা নদী ধূসর, নীলাভ। আমাদের গন্তব্য সোনার পাতে মোড়া ভারতের শেষ গ্রাম ছিতকুল। পর্যটকরা সাধারণত সাংলায় থাকেন। কিন্তু এই ভুল করবেন না। ছিতকুলের সৌন্দর্য তার কাছে গিয়েই দেখতে হয়। মনে হয়, পৃথিবী যেন এখানেই শেষ! নদী মুখরিত ছায়া পাহাড়, সোনালি পাহাড়, কেবলই আলোর খেলা... তার পাশেই চিন-তিব্বতের বর্ডার। নদীর পাশেই তাঁবু। আর সেখান থেকেই শুয়ে শুয়ে সারা দুপুর নদী পাথরের রং-বদল দেখা। এক দিকে কৈলাশ আর এক দিকে ধৌলাদ্বার পর্বতরাশি। দূরে গ্রামের ছোট্ট একটা স্কুল, পাহাড়ের মাঝে বড় একা হয়ে আছে। এখান থেকেই এক অলীক প্রেক্ষাপটে ম্যাজিক রিয়্যালিজমের জন্ম! মনে হয়, কলকাতার জাগতিক যা কিছু সব মিথ্যে। প্রকৃতি দু’হাত বাড়িয়ে ডাকছে। বলছে, আমার কাছে সমর্পণ করো। আমি তোমায় স্বপ্ন দেব...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE