Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

প্রকৃতির লুকোনো রত্ন

হঠাৎই  খুঁজে পেলাম  উত্তরপ্রদেশে। বারাণসীর খুব কাছেই। নাম তার মির্জাপুর। পাহাড়, নদী, ঝর্নার মিলমিশে রোমাঞ্চকর অনুভূতির সাক্ষী...হঠাৎই  খুঁজে পেলাম  উত্তরপ্রদেশে। বারাণসীর খুব কাছেই। নাম তার মির্জাপুর। পাহাড়, নদী, ঝর্নার মিলমিশে রোমাঞ্চকর অনুভূতির সাক্ষী...

রাজদারি জলপ্রপাত

রাজদারি জলপ্রপাত

ঈপ্সিতা বসু
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সে দিন হঠাৎ কালবৈশাখীর দমকা হাওয়া আর একপশলা বৃষ্টিই যেন মন উড়ুউড়ু করে দিয়েছিল। আমাদের মতো যাদের পায়ের তলায় সর্ষে, হাতে তিন-চার দিনের ছুটি মানেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে কোথাও হারিয়ে যাওয়ার তাড়া...

যাই হোক, ইন্টারনেটের ভরসা করেই বেরিয়ে পড়লাম স্বল্পচেনা একটি শহরকে নতুন রূপে চিনব বলে। উত্তর প্রদেশের মির্জাপুরের সুখ্যাতি কার্পেট বুনন আর পিতলের নানান শৌখিন জিনিস তৈরির জন্য। সেখানে পৌঁছে বুঝলাম, প্রকৃতিই যেন কার্পেট বুনে রেখেছে যত্ন করে। গঙ্গার তীরে সুদৃশ্য ঘাটের সারি, ঘণ্টাঘর, মন্দিরের চাতাল... সব মিলিয়ে মির্জাপুর মনের মণিকোঠায় রয়ে গিয়েছে আজও।

হাওড়া থেকে মির্জাপুর সুপারফাস্ট ট্রেনে বারো থেকে তেরো ঘণ্টার পথ। কাছাকাছি দূরত্বে বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে। গাড়ির কথা আগে থেকে বলে না রাখলে অসুবিধেয় পড়তে হতে পারে। হাতে টানা রিকশা বা অটোই এখানকার প্রধান বাহন।

চলতি পথের পাশে পাশে

হোটেলে বসেই তাড়াহুড়োয় প্ল্যান ছকে নেওয়া। মির্জাপুর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র জলপ্রপাত। সব দেখতে গোটা দু’দিন লেগে যাবেই। প্রথম গন্তব্য রাজদারি জলপ্রপাত। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে জায়গাটি পরিচিত বনভোজনের জায়গা হিসেবেই। গাড়ি ছুটল কিছুটা পিচ মোড়া পথে। তার পর কখনও অনুচ্চ পাহাড় ও জঙ্গল, আবার কখনও পথের বুক চিরে পাশাপাশি ছুটে চলা ঘোলাটে জলের নদীকে সাক্ষী রেখে। যেন সেলুলয়েড থেকে বেরিয়ে আসা এক চলমান ছায়াছবি। পাহাড়ের পাকদণ্ডী পেরিয়ে গাড়ি থামল এক আশ্চর্য জগতে। পরতে পরতে জড়িয়ে তার সৌন্দর্য। চোখ জুড়নো সবুজের সমুদ্র। কালচে রঙের পাহাড়ের ধাপে ধাপে আপন ছন্দে তরতরিয়ে নামছে একটি ঝর্না। অনেক দূর থেকে তার এক সৌন্দর্য চোখে পড়ে। আর পাহাড়ের ঢালের কাছে গেলেই ধরা দেয় অন্য রূপ।

বাসনের গায়ে হাতের কাজ

গাড়িচালকের কথায়, ভরা বর্ষায় নাকি রাজদারি ভারতের অন্য যে কোনও জলপ্রপাতের কাছে ঈর্ষণীয় হয়ে ওঠে! তখন সে যেমন লাস্যময়ী, তেমনই ভয়ঙ্কর। আর তখনই মনে প্রশ্নের আনাগোনা, বারাণসীর খুব কাছে হয়েও পাহাড়, নদী, ঝর্নায় মোড়া এই শহরটি পর্যটন মানচিত্রে অপরিহার্য হয়নি এখনও! অথচ উত্তর প্রদেশের এই ছোট্ট শহরটি যে কোনও পরিচিত ঘোরার জায়গাকে টেক্কা দিতে পারে অবলীলায়। সে দিন কৃত্রিম কংক্রিটের জঙ্গল ছেড়ে প্রকৃতির কাছে বিছিয়ে দিয়েছিলাম নিজেকে। বিনিময়ে প্রকৃতি উপহার দিয়েছিল অনেক বেশি। আজও কর্পোরেট দুনিয়ায় হাঁপিয়ে উঠলে, কল্পনায় ভেসে যাই জলপ্রপাতের কিনারে।

গঙ্গার ঘাট

সেখান থেকে ফের পাহাড়ের পাকদণ্ডী পেরিয়ে পিচগলা পথে চড়াই-উতরাই ভেঙে উন্ডহাম ফলস। দু’পাশে খাড়াই পাহাড় আর নীচ দিয়ে বয়ে চলা নদী। আর সে একেবেঁকে চলতে চলতে আছড়ে পড়ছে পাথুরে ঢালে ক্রমান্বয়ে। আর তার কোলে জলকেলিতে ব্যস্ত ছোট-বড় সকলেই। নদীর দু’পাশে পাহাড়ি রাস্তায় অনেকটা হাঁটা পথ, যেন আক্ষরিক অর্থেই অন্তহীন। বনাঞ্চলে ট্রেকারদের স্বর্গরাজ্য। জলপ্রপাতে স্নান। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত রোমাঞ্চকর অনুভূতির সাক্ষী থাকল উন্ডহাম... ধারেকাছে এ রকম আরও অনেক জলপ্রপাতের সন্ধান মিলল। কিন্তু সময়ের অভাবে সেগুলো উপেক্ষিত হয়ে রইল আমাদের কাছে। তবে বুড়ি ছোঁয়া হলেও সিরসি ড্যাম দেখে ফিরেছিলাম। সূর্য তখন পাটে। পিছনে রয়ে যায় আবছায়া পাহাড় আর ঘন বনপথ। কিন্তু মনে তখনও দামাল দস্যি ড্যামের রেশ।

চুনার দুর্গ

পরদিনের সফরে বিন্ধ্যবাসিনী। অনুচ্চ টিলায় বিন্ধ্যাচল নিবাসিনী মহাদেবী বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দির। খুবই জাগ্রত। বহু দূর থেকে মন্দিরে আসা ভক্তদের তালিকায় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে চিত্র তারকারাও রয়েছেন। বিন্ধ্যবাসিনী থেকে পাথুরে পথে বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভাঙলেই বিন্ধ্যপর্বতে যোগমায়া মহাদেবী অষ্টভুজার বাস। পাশেই সীতাকুণ্ড। জনশ্রুতি, বনবাস কালে ফেরার সময় সীতাদেবীর তৃষ্ণা মেটাতেই কুণ্ড খুঁড়েছিলেন লক্ষ্মণ। আজও এই কুণ্ড তৃষ্ণা মেটায় পথশ্রান্ত পর্যটক থেকে মন্দিরে আগত ভক্তদের। পাশেই স্মৃতিস্বরূপ রাম-সীতার মন্দির। এখান থেকে আরও কয়েক ধাপ সিঁড়ি চড়লে অনুচ্চ আর একটি পাহাড়চুড়োয় অষ্টভুজার মন্দির। নামে মন্দির হলেও আসলে গুহার দেওয়ালে দেবীমূর্তি। বিন্ধ্যবাসিনী দুর্গাই এখানে অষ্টভুজা। ফেরার পথে গঙ্গার ঘাটে নৌকো ভ্রমণের অভি়জ্ঞতা... সেও ভোলার নয়।

শৌখিন পিতলদান

শেষ দিনটা ছিল অন্য রকমের। গন্তব্য চুনার ফোর্ট। বেলে পাথরের এই দুর্গের নির্মাতা কে, ইতিহাস বলতে না পারলেও হর্ষবর্ধনের আমলে চুনার প্রথিতযশা হয়, এ কথা জানা যায়। লাল সুরকির পথ উঠেছে দুর্গ বরাবর। ভূগর্ভস্থ বন্দিশালা, ফাঁসির মঞ্চ, পাতালঘর, গভীর ইঁদারা ও ৫২ পিলারের গড়া সোনওয়া মহল দেখতে দেখতে দুর্গের শীর্ষে পৌঁছলে দূর থেকে বয়ে চলা গঙ্গা ও চুনার শহরের অপরূপ ছবি ভেসে ওঠে।

বাহারি কার্পেট

ফেরার পথে চুনার থেকে সংগ্রহ করেছিলাম রেড ক্লে পটারি আর মির্জাপুরের বিখ্যাত কার্পেটের ক্ষুদ্র সংস্করণ। ট্রেনের জানালায় যখন আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হল মির্জাপুর স্টেশনটি... মনে হল, প্রকৃতিপ্রেমিক নয়, জায়গাটি হতে পারে যে কোনও শিল্পীর ক্যানভাস, কবির বিষয়বস্তু বা ছবির শুটিং স্পট। প্রকৃতির বুকে এমন লুকিয়ে রাখা রত্নের কথা ভাবলেই মন যেন পালাই পালাই...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE