Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মেঘপাহাড়ের রেশমগাঁও

প্রকৃতি আর কাঞ্চনজঙ্ঘার মধ্যে কাটাতে চান দু’দিন?   মেঘ, পাহাড় আর সূর্যাস্তের নরম আভা জড়ানো কালিম্পংয়ের বুকে রেশমগাঁও ঘুরে এসে লিখছেন দেবাশিস চৌধুরীপ্রকৃতি আর কাঞ্চনজঙ্ঘার মধ্যে কাটাতে চান দু’দিন?   মেঘ, পাহাড় আর সূর্যাস্তের নরম আভা জড়ানো কালিম্পংয়ের বুকে রেশমগাঁও ঘুরে এসে লিখছেন দেবাশিস চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

তখনও নবান্নে প্রথম পাহাড় বৈঠক হয়নি। তবে তার দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যেই ফোনটা এল, ‘‘কেমন আছেন দাদা? কবে আসবেন?’’

পরিচিত কণ্ঠ। পরিচিত শহর থেকেই এসেছে ফোন। তাঁকে বললাম, ‘‘কিন্তু এখনও তো গোলমাল চলছে!’’

‘‘সব মিটে যাবে শিগগিরই। আপনারা কবে আসবেন বলুন। নভেম্বর না কি ডিসেম্বর?’’

টানা বন্‌ধের মধ্যেও এ ভাবেই ডাক দিয়েছে পাহাড়। গরমের ছুটিতে ভ্রমণের স্মৃতি তখনও টাটকা। তার চেয়েও টাটকা বিমল গুরুঙ্গের ডাকে পাহাড়ে জ্বালাময়ী আন্দোলন। জুনের গোড়ায় সেই আন্দোলন শুরু হয়। ঠিক তার কয়েক দিন আগেই গিয়েছিলাম রেশমগাঁও। কালিম্পং থেকে খাড়াই পথে উঠে নিরিবিলি একটি গ্রাম। যেখানে মেঘ-রোদের সঙ্গে অপেক্ষা করে থাকে প্রশান্তি।

মে মাসের একেবারে শেষে শিয়ালদহ থেকে যখন পদাতিক এক্সপ্রেসে উঠি, তখনও জানতাম না, পাহাড়ে পা রাখতে পারব কি না। আগে থেকে কোথাও বুকিং করা হয়নি। পরিচিত যত জনকে জিজ্ঞেস করেছি, জবাব এসেছে একটাই— ঠাঁই নাই! প্রথম দিনটা তাই কাটাতে হল লাটাগুড়ির এক রিসর্টে। কিন্তু এত কাছে এসেও পাহাড়ে যাওয়া হবে না! পরদিন সকালে মরিয়া হয়ে এখানে-ওখানে ফোন করতে করতে মিলে গেল ঠিকানা। কালিম্পঙের কাছেই একটি হোম স্টে-তে। গ্রামের নাম রেশমগাঁও।

করোনেশন ব্রিজ

তখনও জানি না, জায়গাটা কেমন। শুধু থাকার জন্য একটা ঘর মিলবে শুনে গাড়ি ধরে সোজা পাহাড়ে। ডুয়ার্সের অপূর্ব পথ হয়ে, করোনেশন সেতু পেরিয়ে, তিস্তাকে পাশে নিয়ে কালিম্পং। এবং সেই শহরও ছাড়িয়ে আলগারার পথে একটু এগিয়েই বাঁ দিকে ঘুরে খাড়াই রাস্তা। কিছু দূর গিয়ে সেই রাস্তায় আর পিচ নেই, শুধুই পাথর। তার পর সেই চড়াই, পাথুরে পথ, পথের পাশে ছবির মতো ছোট্ট স্কুল— সব সঙ্গে নিয়ে সোজা রেশমগাঁওয়ের হোম স্টে-তে। মেঘ তখন উঠোন জুড়ে অভ্যর্থনায় দাঁড়িয়ে।

কালিম্পং শহর থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরত্বে এই রেশমগাঁও রেশম চাষের জন্য বিখ্যাত। নিরিবিলিতে কয়েক দিন কাটানো, পাহাড়ে গ্রামের ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য রেশমগাঁও এক কথায় দারুণ। এখানেই একটি হোম স্টে-তে জুটে গেল ঘর। ঝকঝকে এই স্টে চালান এক প্রধান দম্পতি। সঙ্গে এক বাঙালি ভবঘুরে।

বিকেলে স্টে-র পিছনের দরজা দিয়ে বেরোতেই সামনে গ্রামের সরু একফালি পায়ে চলা পথ। তার এক প্রান্ত চলে গিয়েছে গ্রামের ভিতরে নানা শাখাপ্রশাখা নিয়ে। অন্য প্রান্ত গিয়েছে সেই দিকে, যেখানে পরদিন ভোরে আচমকা দেখা দেবেন ‘স্লিপিং বুদ্ধ’!

পাহাড়ি পথ

মে-জুন মাসে কালিম্পং যথেষ্ট গরম। রেশমগাঁওয়ে কিন্তু রেশমের মতোই হাল্কা ঠান্ডা। গরমকালে একটা চাদর জড়িয়ে দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। তবে শীতকালে ভারী গরম পোশাক চাই। সন্ধে যখন নামল, দেওয়ালের মতো উঁচু পাহাড়ের মাথায় ডেলো বাংলোয় জ্বলে উঠল আলো।

হিমালয় চমক দেখাল পরদিন সকালে। ভোর ভোর পথে নামতেই ভিজে যাচ্ছিল পায়ের পাতা। পশ্চিম প্রান্তে তখন মেঘ। মনে হচ্ছিল, ইস, যদি এক বার এই পরদা সরে যায়!

মেঘপাহাড়

ভাবতে ভাবতেই নীল দিগন্তে ম্যাজিক! হঠাৎই সরে গেল মেঘ। বেরিয়ে পড়ল কাঞ্চনজঙ্ঘা। তার পর ধীরে ধীরে প্রায় পুরো ঘুমন্ত বুদ্ধ।

উত্তরবঙ্গ ও সিকিমের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেখা যায় বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পাহাড়টিকে। টাইগার হিল থেকে তার দর্শন এক রকম, পেলিং থেকে আর এক রকম। রেশমগাঁওয়ে পাহাড়ি গ্রামের সরু পথে দাঁড়িয়ে গাছ আর টিনের চালের বাধা টপকে যে ‘স্লিপিং বুদ্ধ’কে দেখা যায়, তাকে কিন্তু অনাঘ্রাত মনে হয়। তখনই হয়তো আপনার পাশ দিয়ে খেলতে খেলতে ছুটে যাবে গ্রামের তিনটি শিশু। মুখোমুখি পড়ে গেলে তারাই ভরিয়ে দেবে নির্মল হাসিতে। মনে হবে, সেই হাসিই যেন মিঠে রোদের মতো এতক্ষণ গায়ে জড়িয়ে ছিল আপনার।

ঝুলবারান্দা থেকে তিস্তা

সকালের সেই আমেজ না ফুরোতেই দুপুরে দলবল মিলে ভিলেজ ট্রেক। গ্রামের উতরাই ধরে নামতে নামতে কখনও ফুলের বাগিচা, কখনও স্থানীয় দোকানে দু’-এক মুহূর্তের বিশ্রাম। তার পর ফের হণ্টন। দম ফুরোলে আপনার জন্য পথের পাশে খাবারের দোকান। যার ঝুলন্ত বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে থুকপা খেতে খেতে নীচে তাকালে দুপুরের ধূসর রোদ ভেদ করে দেখা মিলবে তিস্তা উপত্যকার।

রেশমগাঁওয়ে নিস্তরঙ্গ জীবন। দুটো দিন সেখানে এমনই নিজস্ব রুটিনে কাটিয়ে দিতে পারেন। খাওয়া আর পাহাড়ি পথে ঘোরাতেই বেলা বয়ে যাবে। সকাল-দুপুর গ্রামের চড়াই-উতরাই ভেঙে যে মেদ কমাবেন, চারবেলা নানাবিধ খেয়ে তা পুষিয়ে যাবে।

যখন গিয়েছিলাম, গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন তখন ভবিষ্যতের গর্ভে। এর মধ্যে খবর এল, হোম স্টে-র মালিকের প্রিয় বন্ধু মারা গিয়েছেন। দু’দিন ধরে সেই শোক আমাদের গায়েও লেগেছে। ফেরার দিন গাড়িতে ওঠার সময়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘‘ফির আইয়েগা জরুর!’’ পাহাড়ির হৃদয় মিলে গেল বাঙালি পর্যটকের সঙ্গে।

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে যে কোনও ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি। তার পর গাড়িতে কালিম্পং হয়ে রেশমগাঁও

মনে রাখবেন
• গরমের সময়ে গেলেও সঙ্গে শীতের কাপড় রাখা জরুরি। দিনে হাল্কা ঠান্ডা থাকলেও সন্ধে থেকে শীত বাড়ে।
• শীতের সময়েও যাওয়া যায়। তখন ভারী শীতের কাপড় জরুরি। আর হ্যাঁ, বর্ষার সময় যাবেন না।
• পাহাড়ের রাজনীতি কোন পথে, দেখে নিন। না হলে রেশমগাঁও থেকে নামতে বিস্তর হাঙ্গামা পোহাতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE