Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নীল-সবুজের দ্বীপ

ঘরের কাছে নীল জলরাশি, রুপোলি তটভূমি আর সবুজ অরণ্য সমৃদ্ধ এই নিরক্ষীয় দ্বীপপুঞ্জের হাতছানি উপেক্ষা করা কঠিন। ঘুরে এসে লিখলেন সুনীতা কোলে ঘরের কাছে নীল জলরাশি, রুপোলি তটভূমি আর সবুজ অরণ্য সমৃদ্ধ এই নিরক্ষীয় দ্বীপপুঞ্জের হাতছানি উপেক্ষা করা কঠিন। ঘুরে এসে লিখলেন সুনীতা কোলে

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৭ ২৩:৩৯
Share: Save:

সাদা বালির সমুদ্রতট, স্বচ্ছ নীল জল আর ইতিহাসের মিশেলে আন্দামান হাতছানি দিচ্ছিল বহু দিন ধরেই। একদিন হঠাৎই কাটা হয়ে গেল বিমানের টিকিট। পরের কয়েকটা মাসে করে ফেলা গেল বাকি ব্যবস্থা। তার পর ফেব্রুয়ারির এক ভোরে মা-বাবার সঙ্গে যাত্রা শুরু। আন্দামানের আকর্ষণে এসেছে একঝাঁক মার্কিন স্কুলপডুয়া। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস আর সানস্ক্রিনের উপযোগিতা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত রইল তারা। ঘণ্টা দুই পরেই জানালা দিয়ে দেখা যেতে লাগল উজ্জ্বল তটভূমি-ঘেরা ছোট ছোট দ্বীপ। আমরা পৌঁছে গিয়েছি পোর্ট ব্লেয়ারে।

হ্যাভলকে সূর্যাস্ত

প্রথম দিনের ঘোরার তালিকায় প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই সেলুলার জেল। এই জেলের সঙ্গে জড়িয়ে বহু মর্মান্তিক কাহিনি। এখন তিনটি উইং থাকলেও আগে সাইকেলের চাকার মতো ছড়ানো সাতটি অংশ ছিল। তৈরি করা হয় মোট ৬৯৩টি কুঠুরি। শুধু রাজনৈতিক বন্দিদের রাখার জন্য কী বিপুল আয়োজন! মাঝের ওয়াচ টাওয়ারে ফলকের পর ফলক জুড়ে শুধুই বাঙালি বন্দিদের নাম।

নীল দ্বীপ

বন্দিদের দিয়ে করানো হতো অমানুষিক পরিশ্রম। তাঁদের এমন ভাবে রাখা হতো, যাতে কোনও ভাবেই বার্তা আদানপ্রদানের সুযোগ না মেলে। তবু অত্যাচারের প্রতিবাদে ১৯৩৩ সালে বেশ কিছু বন্দি শুরু করেন অনশন। জোর করে খাওয়াতে গিয়ে তিন জনের মৃত্যুও হয়। দেশ জুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদ। তার পরেই বন্দিদের ধীরে ধীরে ফিরিয়ে আনা হয় মূল ভূখণ্ডে। এ সবই জেনে নেওয়া গেল সুসজ্জিত সংগ্রহশালা এবং মনোগ্রাহী ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ শো থেকে।

সেলুলার জেল

পরের দিনের গন্তব্য হ্যাভলক আইল্যান্ড। গাড়িচালক বারবার সাবধান করে দিলেন, বেরোতে যেন দেরি না হয়। এক বার ফেরি চলে যাওয়া মানে পুরো দিনটাই নষ্ট। অন্য ফেরির টিকিট মেলাও মুশকিল। তাই সময় মতো জেটিতে পৌঁছে, সিকিওরিটি চেকিং সেরে উঠে পড়া গেল কাচে মোড়া ফেরিতে। বন্দর এলাকা না পেরোনো পর্যন্ত লাইফ জ্যাকেট পরে থাকতেই হবে। সিট ছেড়ে ওঠাও নিষেধ। আধঘণ্টা বসে থাকার পরে অনুমতি মিলল ডেকে যাওয়ার। দু’-চারটে ছোটখাটো আবছায়া দ্বীপ ছাড়া তখন চারদিকে শুধুই জল। মাঝেমধ্যে দেখা মিলছে উড়ুক্কু মাছ ও সামুদ্রিক পাখির। একটু পরেই চালিয়ে দেওয়া হল জনপ্রিয় গান। মধুচন্দ্রিমায় আসা দম্পতিদের সঙ্গে তালে তালে পা মেলালেন অনেকেই। দু’ঘণ্টার যাত্রাপথ যেন কেটে গেল এক লহমায়।

সামুদ্রিক মেরিন মিউজিয়াম

এ বার পালা সমুদ্রে পা ভেজানোর। রিসর্ট থেকে নারকেল গাছে ঘেরা আঁকাবাঁকা পথে খানিক এগোলেই বিজয়নগর বিচ। দিগন্ত বিস্তৃত সবজেটে নীল জল ছোট ছোট ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছে পায়ের কাছে। অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে স্বচ্ছ, অগভীর জল। সেখানে ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছ, প্রবাল ও পাথরের স্তূপ। বালিতে লুকিয়ে কাঁকড়া-শামুক। এই সৈকত স্নানের জন্য তেমন উপযোগী নয়। পাথরের মধ্যেই অবশ্য অনেক দূরে সাঁতার কাটতে দেখা গেল এক জনকে। দুপুরে ভোজের আকর্ষণ অবশ্যই সি-ফুড। কাঁকডা, চিংড়ি, টুনা, রেড স্ন্যাপার, স্কুইড— আয়োজন লোভনীয়। শুধু বেছে নেওয়ার পালা।

বিকেলে পৌঁছলাম এশিয়ার শ্রেষ্ঠ সমুদ্রসৈকতের খেতাব পাওয়া রাধানগর বিচে। এখানে পাথরের লেশ মাত্র নেই। মাইলের পর মাইল শুধু সাদা বালি আর নীল জল। সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করলেও সমুদ্রস্নানে ব্যস্ত অনেকে। একটা সুন্দর তৃপ্তির ভাব নিয়ে পরদিন ভোরে ফের বিজয়নগর বিচে যেতেই চমক! ভাটার টানে জল নেমে গেছে বহু দূর। আগের দিন যেখানে একজনকে সাঁতার কাটতে দেখে ভেবেছি তিনি অসমসাহসী, সেখান পর্যন্ত তো বটেই, আরও দূরে পৌঁছে গেলাম হেঁটেই। বালির ছোট ছোট গর্তের জলে সামুদ্রিক ঘাসের ফাঁকে তখন মাছ, কাঁকড়ারা ধৈর্য ধরে জোয়ারের অপেক্ষায়। এক জায়গায় বৃত্তাকার ঝালর জাতীয় কয়েকটা জিনিস দেখে ক্যামেরা তাক করতেই সেগুলি সুড়ুৎ করে বালিতে সেঁধিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে ফের আবির্ভাব ঘটল তাদের। পরে জেনেছি ওগুলো এক প্রজাতির সি-ওয়র্ম।

প্রাকৃতিক ব্রিজ

পরের গন্তব্য নীল আইল্যান্ড। এই ছোট দ্বীপটির জনসংখ্যা খুবই কম। এখানকার সৈকতে ছড়িয়ে অজস্র সাদা প্রবাল। ইতিউতি ছড়ানো নানা রঙের ঝিনুক, ছোট শাঁখ। এ সব অবশ্য সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ। সন্ধের পরে সঙ্গী হল ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ। পরদিন গেলাম প্রাকৃতিক পাথরের ব্রিজ দেখতে। স্থানীয়দের কাছে এটি পরিচিত ‘হাওড়া ব্রিজ’ নামে। এর পর পালা গ্লাস বটম বোটে প্রবাল দর্শন করার। নানা রঙের ও বিচিত্র আকৃতির প্রবাল, মাঝে আনাগোনা রঙিন মাছের। দেখা মিলছে সমুদ্রশশা জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণীরও। অসাধারণ বললেও কিছু বলা হয় না। নৌকার দুলুনি ও জলের ঝাপটা অবশ্য ছবি তোলার চেষ্টায় দাঁড়ি টেনে দিল। পরে সূর্যাস্তের সঙ্গী হয়ে ফিরে এলাম পোর্ট ব্লেয়ারে।

সফরের শেষ দিনে যাওয়া হল আশপাশের তিনটি দ্বীপে। ভাইপার আইল্যান্ডে ছিল ইংরেজদের জেল। এখনও রয়ে গিয়েছে ফাঁসি দেওয়ার জায়গাটুকু। গোটা আন্দামানের মধ্যে রস আইল্যান্ডেই প্রথম বসতি স্থাপন করা হয়েছিল। ক্লাবঘর,
স্কুল, পাম্প হাউস থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাপানি বাঙ্কার— সযত্ন সংরক্ষিত সবই। চড়াই ভেঙে উঠলে রয়েছে প্রেসবাইটেরিয়ান গির্জার ধ্বংসাবশেষ এবং সমাধিক্ষেত্র। পাশেই পাহাড় সটান ঝাঁপ দিয়েছে সাগরে। গাছের পাতা, গির্জার ভাঙা জানালার ফাঁকে
হু হু হাওয়া— ইতিহাস যেন এখানে কথা বলে।

রঙিন মাছের জলকেলি

শেষ ঘোরার জায়গা নর্থ বে আইল্যান্ড। এখানে রয়েছে নানা ওয়াটার স্পোর্টের আয়োজন। স্কুবা ডাইভিংয়ের টিকিট কেটেও তা বাতিল করতে হল শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার জন্য। মনখারাপ নিয়ে অগত্যা চলে গেলাম দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু জায়গায়। সেখানে প্রহরায় রয়েছে লাল-সাদা লাইটহাউস— ঠিক যেমনটা কিনা গল্পে থাকে।

পরদিন বিমানের জানালা দিয়ে শেষবারের মতো দেখা আন্দামানকে। ছেড়ে এলাম তাকে ফের আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।

টুকটাক ইনফো

কখন যাবেন

অক্টোবর থেকে মার্চ।

কী ভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ার পর্যন্ত বিমান রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার। রয়েছে জাহাজে যাওয়ার সুযোগও।

কোথায় থাকবেন

পোর্ট ব্লেয়ার ও হ্যাভলকে রয়েছে সরকারি অতিথিশালা-সহ নানা বাজেটের বহু হোটেল। নীল দ্বীপে থাকার জায়গা অবশ্য একেবারেই হাতেগোনা।

খেয়াল রাখুন

সি সিকনেসের ওষুধ-সহ অন্য ওষুধ অবশ্যই সঙ্গে নিন। দ্বীপগুলোয় ঘোরার জন্য আগে থেকেই ফেরির টিকিটের বন্দোবস্ত করে রাখুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tours and Travel Andaman and Nicobar islands
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE